মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানোর অনুমোদন পাওয়ার এক বছর পর নিউরলিংক প্রথমবারের মতো মানব মস্তিষ্কে তারহীন চিপ স্থাপন করেছে।
নিউরলিংকের প্রধান ইলন মাস্ক জানান, গত রবিবার একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি তথা হাত-পা ও শরীর নাড়াতে অক্ষম রোগীর মাথায় একটি চিপ স্থাপন করা হয়েছে। চিপটি আশানুরূপভাবে ওই রোগীর নিউরন স্পাইক বা স্নায়ু আবেগ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে ওই রোগীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে এবং তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন।
মানব মস্তিষ্ক যে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে সারা দেহে তথ্য আদান-প্রদান করে সেই প্রক্রিয়াই হচ্ছে নিউরন স্পাইক বা স্নায়ু আবেগ। এই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে মানবদেহের মোটর নিউরনগুলো, যেগুলোর মাধ্যমে মস্তিষ্ক মানুষের চলাফেরার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে।
চিপটিতে মানুষের মস্তিষ্কের মোটর নিউরনগুলোর কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করা থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক-কম্পিউটার সংযোগ স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকটি অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। তবে স্বাধীনভাবে কোনও বিজ্ঞানী বা সংস্থা মাস্কের এই দাবির সত্যতা যাচাই করে দেখেনি।
মাস্ক নিউরলিংককে তথ্যপ্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ বলে দাবি করেছেন। তবে নিউরলিংকের ব্রেইন চিপ ও এর পরীক্ষাকে ঘিরে নানা উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
নিউরলিংক ও ব্রেইন চিপ
নিউরলিংক একটি ব্রেনই চিপ স্টার্টআপ। মানুষের স্নায়ু ও মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণার জন্য ধনকুবের ইলন মাস্ক ২০১৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তারও আগে থেকেই মাস্ক মানব মস্তিষ্কে চিপ বসানো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন।
দীর্ঘ সাত বছর কাজ করার পর গত বছরের মে মাসে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিউরলিংককে মানুষের মস্তিষ্কে চিপ বসিয়ে পরীক্ষা চালানোর অনুমতি দেয়।
ইলন মাস্ক এমন একটি ব্রেন চিপ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন, যেটি মাথায় বসালে মানুষ শুধু চিন্তার মাধ্যমে ফোন ও কম্পিউটার ডিভাইসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মস্তিষ্ক কী ভাবছে এবং কী করছে, তা দেখার পাশাপাশি এই চিপ মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ডের সব তথ্য সংগ্রহ করবে। চিন্তার মাধ্যমে পাঠানো সংকেতগুলো যথাযথভাবে বুঝে ব্লুটুথের মাধ্যমে সংযুক্ত ডিভাইসে পাঠাবে।
চিপটির আকার একটি কয়েনের সমান, যা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাথার খুলিতে বসানো হয়। এতে রয়েছে অতি-পাতলা কিছু তার, যেগুলো মগজে প্রবেশ করে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস বা মস্তিষ্কের সঙ্গে কম্পিউটারের সংযোগ তৈরি করবে। এরপর মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করে তথ্যগুলো ব্লুটুথের মাধ্যমে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে পাঠাবে।
মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন, নিউরলিংকের প্রথম চিপটির নাম হবে ‘টেলিপ্যাথি’। চিপটি মস্তিষ্কে স্থাপন করে কেবল চিন্তার মাধ্যমেই ফোন বা কম্পিউটারের মতো ডিভাইসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
চিপটি মস্তিস্কের সেই অংশে স্থাপন করা হবে যা মানবদেহের মোটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে মানুষ তার স্নায়বিক রোগব্যাধি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
মাস্ক বলেন, যেসব মানুষ পক্ষাঘাতে হাত-পাসহ তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ব্যবহারের সক্ষমতা হারিয়েছেন প্রধানত তাদের জন্যই চিপটি বানানো হবে।
নিউরলিংকের মানব পরীক্ষা পর্যায়
গত রবিবার একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মাথায় একটি চিপ বসানোর মধ্য দিয়ে নিউরালিংকের মানব পরীক্ষার পর্যায় শুরু হয়েছে। এই পর্যায়ে চিপটিকে আরও উন্নত করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পাশাপাশি এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালি করা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। নিউরালিংকের ব্রেইন চিপের এই মানব পরীক্ষা পর্যায় চলবে ছয় বছর ধরে। তারপরই হয়তো এ সম্পর্কে চুড়ান্তভাবে কিছু জানা যাবে।
সোমবার এক্সে এক পোস্টে মাস্ক বলেন, “প্রাথমিক পরীক্ষায় চিপটি আশাব্যঞ্জকভাবে নিউরন স্পাইক সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।”
তার মানে, এর মাধ্যমে নিউরনগুলো শরীরজুড়ে একে অন্যকে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক সংকেত পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে। এসব সংকেতের মাধ্যমেই আমরা আমাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে কথা বলা পর্যন্ত দৈনন্দিন সব কাজ সম্পাদন করি।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউরোলিংক চিপটির মানব পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রোগীর সন্ধান শুরু করে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি মেরুদণ্ডের রোগে আক্রান্ত একজন রোগীকে বাছাই করে। কারণ, মেরুদণ্ড মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান একটি অংশ।
এর আগে নিউরলিংক কী ধরনের পরীক্ষা চালায়
এর আগে নিউরলিংক বানর ও শূকরের ওপর চিপটি পরীক্ষা করে দেখে। নিউরলিংক দেখায়, বেশ কয়েকটি বানরের মাথায় চিপটি বসানোর পর বানরগুলো এর মাধ্যমে সাধারণ ভিডিও গেম খেলতে বা কম্পিউটার স্ক্রিনে কার্সার সরাতে পারছে।
নিউরলিংক দাবি করেছে, মাথায় চিপ বসানোর ফলে কোনও বানরের মৃত্যু হয়নি। শুধু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া, খিঁচুনি উঠা এবং মাথা ফুলে যাওয়ার মতো কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
তবে ২০২২ সালের শেষদিকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, নিউরলিংকের মস্তিষ্কে চিপ বসানোর পরীক্ষায় ব্যবহৃত ভেড়া, বানর, শূকরসহ প্রায় দেড় হাজার প্রাণী মারা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ অবশ্য গত বছরের জুলাইয়ে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে জানায়, প্রাণীদের ওপর নিউরলিংকের চিপ নিয়ে গবেষণায় নিয়মের কোনও লঙ্ঘন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত এখনও চলছে।
কোন কোন কোম্পানি কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রে চলমান ক্লিনিকাল ট্রায়াল সংক্রান্ত অনলাইন তথ্যভাণ্ডারের তথ্য মতে, ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস (বিএমআই) বা ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) তৈরি তথা মস্তিষ্ক-কম্পিউটার সংযোগ স্থাপন নিয়ে অন্তত ৪০টি পরীক্ষা চলছে।
নিউরলিংক ব্রেইন চিপ বানিয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করলেও আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করছে।
অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক কোম্পানি সিনক্রোন ২০২২ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন রোগীর মাথায় তাদের একটি ব্রেইন চিপ বসিয়ে পরীক্ষা চালায়। সিনক্রোনের চিপ বসানোর জন্য মাথার খুলি কাটার প্রয়োজন হয় না।
সুইজারল্যান্ডের ইকোলে পলিটেকনিক ফেডারেল ইন লুজানে (ইপিএফএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠানও একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা হাঁটাচলা করতে অক্ষম হয়ে পড়া ব্যক্তির মস্তিষ্কে সফলভাবে একটি চিপ স্থাপন করে। এর মাধ্যমে ওই ব্যক্তি ফের হাঁটাচলা করতে সক্ষম হন। ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে ওই ব্যক্তি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে চলাচলের শক্তি হারিয়েছিলেন।
মাথায় ইলেকট্রনিক চিপ স্থাপনের মাধ্যমে ওই ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের মধ্যে ফের সংযোগ স্থাপন করা হয়। চিপটির মাধ্যমে তিনি পা ও পায়ের পাতার সঙ্গে তার মস্তিষ্কের যোগাযোগ স্থাপন করে ফের হাঁটাচলা করতে পারেন। ২০২৩ সালের মে মাসে বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী নেচারের একটি লেখায় বিষয়টি বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়।
২০২২ সালে একটি পরীক্ষায় কম্পিউটারের সঙ্গে ২৫০-ইলেকট্রোড সংযোগের মাধ্যমে একজন নারী তার মন দিয়ে প্রতি মিনিটে ৭৮টি শব্দ টাইপ করতে সক্ষম হন। ওই নারী কথা বলার জন্য ব্যবহৃত মোটর নিউরনগুলোকে কীভাবে আদেশ দিচ্ছিলেন কম্পিউটারটিকে তা বুঝতে শেখানো হয়েছিল।
প্রিসিশন নিউরোসায়েন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান এমন একটি চিপ তৈরির চেষ্টা করছে যেটি মাথায় বসাতে খুব বেশি কাঁটাছেড়া করা লাগবে না। আর নিউরো নামের একটি কম্পানি অস্ত্রোপচার ছাড়াই মাথায় বসানো সম্ভব হবে এমন চিপ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উটাহ-ভিত্তিক ‘ব্ল্যাকরক নিউরোটেক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৪ সালেই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস বা মস্তিষ্কের সঙ্গে কম্পিউটারের সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিল।
মাস্কের লক্ষ্য হিউম্যান এআই
তবে এই সবগুলো প্রচেষ্টারই উদ্দেশ্য ছিল ব্রেইন চিপকে চিকিৎসার কাজে লাগানো। কিন্তু ইলন মাস্কের উদ্দেশ্য আরও বড় কিছু করা। তিনি এমন একটি ব্রেইন চিপ বানাতে চান যার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা দিয়ে স্মার্টফোন ও কম্পিউটারসহ নানা ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এজন্য তিনি একটি অ্যাপও বানানোর চেষ্টা করছেন।
মাস্ক এমন এক ভবিষ্যতের কল্পনা করছেন যেখানে স্টিফেন হকিংয়ের মতো মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শুধু চিন্তার মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।
মাস্ক জানান, তিনি এমন একটি ইনপুট-আউটপুট ডিভাইস বানাতে চান যা আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি দিকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। অন্য কথায়, এমন কিছু যার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে সরাসরি ডিজিটাল জগতের সঙ্গে যুক্ত করতে পারব।
নিউরলিংকের যাত্রা শুরু করার সময় মাস্ক ঘোষণা করেছিলেন, তিনি একজন মানুষের মন থেকে সরাসরি অন্য একজন মানুষের মনে বার্তা পাঠানোর প্রযুক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। তিনি এর নাম দেন, ‘সম্মতিমূলক টেলিপ্যাথি’।
মাস্ক বলেন, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এমন একটি পরিপূর্ণ ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস তৈরি করা যেখানে আমরা ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থেকে তথা অনলাইনে অনেকটা এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো কাজ করতে পারবো।
নিউরলিংকের ব্রেইন চিপ নিয়ে উদ্বেগ কেন
বিশেষজ্ঞরা অবলা প্রাণীদের ওপর নিউরলিংকের ব্রেইন চিপের পরীক্ষা চালানো নৈতিকভাবে ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রাণী ভাষার মাধ্যমে তাদের ওপর পরীক্ষা চালানোর সম্মতি জানাতে পারে না। এছাড়া মানুষের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি, যেমন ব্রেন হেমারেজ বা খিঁচুনি নিয়েও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তাদের আশঙ্কা, মাস্ক যে ধরনের চিপ বানানোর চেষ্টা করছেন এর মাধ্যমে মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকিও রয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষের ওপর নজরদারি চালানো এবং ব্রেইন হ্যাক বা অন্যের মাথার নিয়ন্ত্রণ দখল করাও সম্ভব হতে পারে। মস্তিষ্কে এই চিপ বসানোর পর ব্যবহারকারীরা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য ও স্নায়বিক কার্যকলাপের ওপর নিয়ন্ত্রণ কতটা ধরে রাখতে পারছেন বা পারবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত ও স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন, সি নেট