Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫
নতুন শিক্ষাক্রমের ১ বছর

শিক্ষকরা ‘প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে’

শিল্পী : আনিসুর রহমান লিটন
শিল্পী : আনিসুর রহমান লিটন
[publishpress_authors_box]
স্কুলশিশুদের পাঠদান কিংবা গ্রহণ এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি আমূল বদলে দিয়ে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে শিক্ষার্থীরা এক বছর পার করল। সরকার এই শিক্ষাক্রম চালু করার পর থেকে শুরু হয় বিতর্ক। তা থেমে নেই এখনও। নতুন শিক্ষাক্রমে এক বছরে শিক্ষার্থীরা কী শিখল, শিক্ষকরা তাদের কতটুকু শেখাতে পারল, অভিভাবকদের উদ্বেগ কতটা কাটল- তা খুঁজতে চেয়েছে সকাল সন্ধ্যা। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এক বছর পার করলেও বিতর্ক ও সমালোচনা পিছু ছাড়েনি। এরইমধ্যে এ বছর থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও অষ্টম ও নবম শ্রেণিও যুক্ত হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সমালোচনার কেন্দ্রে আসছেন শিক্ষকরা। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন পদ্ধতিতে তাদের পাঠদানের যোগ্যতা নিয়ে। 

শিক্ষকরা বলছেন, একদিকে শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশ, অন্যদিকে অভিভাবকদের অভিযোগ, সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পচিশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৫ জনের মতো শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়াসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার নামি এক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক বলেন, “নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে শিক্ষা অধিদপ্তর নিজেও স্পষ্ট না। তার নিজেরাও জানেন না সঠিক স্ট্রাকচারটা কী? কীভাবে সেটার ইমপ্লিমেন্ট হবে?

“শিক্ষার্থীদের যেমন অ্যাডপ্ট করার বিষয় রয়েছে, তারা ধীরে ধীরে সেটা করেও নিবে। কিন্তু শিক্ষকরা তো এখন সেটা অ্যাডপ্ট করে উঠতে পারেনি। আমি নিজেও পারিনি। ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে, যুদ্ধে যাওয়ার আগে যে প্রস্তুতি এবং প্রয়োজনীয় এলিমেন্ট দরকার, সেটি নিশ্চিত না করেই আমাদের যুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

এবছর নতুন আরও চারটি শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমে যুক্ত হওয়ায় নতুন ধারায় নবম শ্রেণির ক্লাস নিতে হবে দিনাজপুরের পাকারহাটের একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমি হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক, আমাকে পড়াতে হবে জীবন ও জীবিকা বিষয়টি। আমি এখনও জানি না, কীভাবে কী করব? আমি নিজেই অন্ধকারে আছি, আমার ছাত্রদের কী করে আলোকিত করব?”

গত বছর যেসব সহকর্মী নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান করেছেন, তাদের কাছেও পর্যাপ্ত তথ্য পাননি বলে জানান সিরাজ।

নতুন কোনও পদ্ধতি প্রয়োগের আগে তা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণায় জোর দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মজিবুর রহমান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যে কোনও নতুন বিষয়ে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সেটি নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা। আর যখন বিষয়টি শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে, সেখানে এর গুরুত্ব আরও বিষয়। কারণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো আর যাই হোক, এক্সপেরিমেন্ট করা যায় না।”

গবেষণার পাশাপাশি বাস্তবায়নে যুক্ত প্রতিটি অংশীদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করা উচিৎ ছিল বলেও মনে করেন তিনি।

“অভিভাবক এবং শিক্ষকরা এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় দুই অংশীদার। কিন্তু শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে তাদের সাথে কী বসা হয়েছে? বসা হলে কয়জনের সাথে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা হয়েছে? তাদের সাথে আলোচনা করে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা হলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলে আমি মনে করি।”

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন মজিবুর।

প্রশিক্ষণ নামমাত্র

প্রচলিত প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক, বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের প্রচলিত যে নিয়ম ছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের উঠে এসেছে সামষ্টিক মূল্যায়ন ও শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি।

অর্থাৎ মূল্যায়ন হবে পাঠ চলাকালীন সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট, দলগত কাজ, সমস্যা সমাধানমূলক কাজ, মৌখিক উপস্থাপনা, রিপোর্ট তৈরি, মাঠ পরিদর্শন এসবের মাধ্যমে। এই শিখনকালীন মূল্যায়ন মূলত সারা বছরব্যাপী চলতে থাকে, যা যথার্থভাবে সম্পন্ন হলে অবশ্যই সর্বোত্তম মূল্যায়ন হবে এটি। যেখানে শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এই সার্বিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আঙুল উঠছে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে। শিক্ষকরাও বলছেন তাদের অপারগতার কথা।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মন্তব্য করা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে জানিয়ে ঢাকার হলিক্রস স্কুলের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নতুন এই শিক্ষাক্রমে পাঠদান প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো কেবল শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সীমিত নয়। সেই সঙ্গে শিক্ষকের মূল কাজ শেখানো নয়, বরং শিখনে সহায়তা করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষক হবেন একজন ফ্যাসিলিটেটর। আর এই জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, দক্ষতা ও পারদর্শিতা।

“কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষকদের সেই যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে কি না? আমি বলব, সেটা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। আর যেটুকু দেওয়া হয়েছে সেটিও পর্যাপ্ত নয়।”

শিক্ষা অধিদপ্তর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিলেও সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষকদেরও কাছ থেকেও নতুন শিক্ষাক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়সূচক মন্তব্য শুনতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল স্কুলের একজন শিক্ষক।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রশিক্ষণ হয়েছে, আমরা গিয়েছি, সাইন করে গল্প করে চলে এসেছি। আমার যিনি প্রশিক্ষক ছিলেন, তিনি নিজেই এই শিক্ষাক্রমের পক্ষে না। তিনি আমাদের বলেছেন, ‘এত চিন্তা নেই, এই শিক্ষাক্রম বেশিদিন টিকবে না, তাই বাড়ি গিয়ে পরিবারকে সময় দিন’।

‘প্রশিক্ষণের পাঁচ দিনের মধ্যে চারদিনই সবাই সাইন করে চলে এসেছি। একদিন শুধু ইন্সপেক্টর আসাতে তিনি প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভান করেছেন।”

প্রশিক্ষণে অংশ নেননি, এমন শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়। তেমন একজন বলেন, “স্কুল থেকে আমাদের সেদিন পিকনিকে নেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেই আমরা যাইনি। হেডমাস্টার সাহেব বলেছেন, আমাদের যে প্রশিক্ষক তিনি বলেছেন আমাদের উপস্থিতি কাউন্ট করে নিবেন, কাউকে যেতে হবে না।

“কিন্তু বিপদে পড়েছি, যখন ক্লাস শুরু করেছি। ছাত্রছাত্রীর নানা প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই আমার কাছে। খুবই বিব্রত হয়েছি। এরমধ্যে অ্যাপের মাধ্যমে রেজাল্ট আপডেট করতে হবে। আমার বোনের ছেলেকে খবর দিয়ে এনে সেটি করেছি।”

প্রকল্পে কর্মরত একাডেমিক সুপারভাইজারদের দিয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে উত্তরা হাই স্কুলের একজন শিক্ষক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যে নিজেই বিশেষজ্ঞ না, সে কীভাবে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের দক্ষ হতে সহযোগিতা করবে? আমি প্রথমদিন প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে এই অবস্থা দেখে পরে আর যাইনি।”

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ঘাটতি ছিল না বলে দাবি করছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যক্রম) মশিউজ্জামান। তার ভাষ্য, সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজটি শুরু হয়েছে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা তো হঠাৎ করে শুরু হয়নি। প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেই এই যাত্রা শুরু হয়েছে।

“শিক্ষকদের জন্য ডিসেম্বরে সাত দিনের ট্রেনিং ছিল। গতবছরেও আমরা ট্রেনিং করিয়েছি।

আমরা মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করেছি। অনলাইন, মাল্টিমিডিয়া, অফলাইন, মডিউল সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

শুধু শিক্ষক নয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সমমনা প্রধানদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি মন্তব্য করে সাবেক শিক্ষা ও আইসিটি সচিব এন আই খান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বয়স্করা দীর্ঘদিনের কোর্স পছন্দ করেন না, তাই তাদের জন্য বিশেষ ধরনের কোর্স ডিজাইন করতে হবে। সেই ডিজাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষক তৈরি করতে হবে।

“মনে রাখতে হবে, যাদের যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে, তাদের সেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এর বাইরেও কিছু মানুষকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আনতে পারলে ভালো।”

শিল্পী : আনিসুর রহমান লিটন

সহায়ক বইও বুঝতে সমস্যা

শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়াবেন আর কী পড়াবেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করে একটি শিক্ষক সহায়ক বই (টিজি) দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের।

ক্লাস শুরু হওয়ারও অনেক পরে সেই শিক্ষক সহায়িকা হাতে পেয়েছেন বলে অভিযোগ অনেক শিক্ষকের। আর পেলেও বেশিরভাগই বলছেন, সেই সহায়িকাই বুঝে উঠতে পারছেন না তারা।

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাকারিয়া ইমাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আসলে টিজি যেটি আমাদের দেওয়া হয়েছে, সেখানে বিস্তারিত লেখা আছে ঠিকই। তবে আমার মনে হয় তাড়াহুড়ো করে করাতে ভাষাগত জটিলতাসহ ডিজাইনেই একটু সমস্যা রয়েছে।

“আমার স্কুলের অনেকেই আমার কাছে এসেছে নানা টপিক নিয়ে, যেটা তারা বুঝতে পারছেন না। আমি কয়েকটির সমাধান দিয়েছি। কিছু কিছু আবার আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।”

জাকারিয়ার মতো একই অভিযোগ পাওয়া যায় ১২টি প্রতিষ্ঠানের ১৬ জন শিক্ষকদের কথায়।

কারিকুলাম উন্নয়ন ও পুনর্বিবেচনা বিষয়ক কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান বলছেন, টিজিতে সবই বুঝিয়ে দেওয়া আছে।

“এমনকি বছরের কোন মাসে কোন সপ্তাহে কী পড়াবেন, তা বলে দেওয়া আছে। আসলে এখন শহরাঞ্চলে যে বিরোধিতা হচ্ছে, এর পেছনে আছে কোচিং সেন্টার। কারণ, নতুন এই পদ্ধতিতে কোচিং সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।”

প্রতিষ্ঠান থেকে সহযোগিতা মেলে না

ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুলের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার একটি হেলথ ক্যাম্প করার কথা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে। সে সময় স্কুলে আরও অনেক অ্যাক্টিভিটি চলমান। সকাল থেকে অপেক্ষা করেও আমি কোনও রুম পাইনি। কিংবা স্কুল থেকেও মাঠে কিংবা অন্য কোথাও কোনো জায়গা করে দিতে পারেনি।

“এর আগে এই ক্যাম্পিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো সম্পন্ন করেছে। শেষে ৪০ মিনিটের জন্য একটি রুম পাই। কোনোরকম নামমাত্র সেই ক্যাম্পিং আমরা শেষ করি।”

একই ধরনের অভিযোগ করেন আরও পাঁচটি বিদ্যালয়ের ছয়জন শিক্ষক।

তাদের মধ্যে একজন বলেন, “টিজি অনুযায়ী আমরা কোনও অ্যাক্টিভিটি করতে চাইলে প্রতিষ্ঠান প্রধান হেলাফেলা করেন। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এত কষ্ট করতে হবে না’। আবার তারাই শিখনকালীন মূল্যায়নের কি আপডেট, সেটা নিয়ে প্রেশার দেন।”

সময়ের স্বল্পতা

শিক্ষকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াতে গেলে যেসময় প্রয়োজন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বেশি বলে তারা কুলিয়ে উঠতে পারেন না।   

ঢাকার ঝিগাতলার এক স্কুলের শিক্ষক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এখনকার পাঠদানের যে প্রক্রিয়া তাতে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। শিক্ষা অধিদপ্তর সেই ক্লাসগুলোর জন্য ৯০ মিনিট ধার্য করে দিয়েছে। তবে বাস্তবে সেই ৯০ মিনিটও তারা পান না।

“আমি নিজেই ৪৫ মিনিটের ক্লাস পেয়েছিলাম। ্বারবার বলার পরেও এটি ঠিক করা হয়নি। আমি কথা বলে দেখেছি, শুধু আমার স্কুলে না, অনেক স্কুলেই কম-বেশি এই সমস্যা রয়েছে। শেখানোর থেকেও প্রতিষ্ঠানগুলো ওন্যান্য ফরমালিটিজ ও সাজসজ্জার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়ায় আমাদের সেদিকেও ব্যস্ত থাকতে হয়।”

ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবার প্রতি মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান মোহাম্মদপুর বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসিব উদ্দিন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ক্লাসে শিক্ষার্থী সব মিলিয়ে ৬৮ জন। দলগত কাজের কথায় যদি বলি, সবাইকে ৫ মিনিট করে দিলেও কত সময় প্রয়োজন? যেহেতু শিক্ষার্থীদের জন্যেও বিষয়টি নতুন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের নানা প্রশ্ন থাকে, কৌতূহল থাকে। সেদিক থেকে ধরেন ক্লাসের ফিফটি পার্সেন্টকে আমরা কভার করতে পারি। বাকি ফিফটি পার্সেন্ট কিন্তু পিছিয়ে পড়ছে।”

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি প্রাথমিক, কিন্ডারগার্ডেন, এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন। শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৪৫ জন।

এই হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হয়ে যায় ১:৩৯ জন।

আবার ২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন, শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরে সারাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪২ জন।

এনসিটিবি সদস্য মশিউজ্জামান বলেন, “ব্যানবেইজের হিসাবে বাংলাদেশে এখন ৪২ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক আছেন। তবে কিছু কথিত ভালো স্কুলে ৮০-৮২ জনের জন্য একজন শিক্ষক। এরকম স্কুল আছে এক হাজার। আর বাকি ৩২ হাজার স্কুলে এই সমস্যা নেই। তাহলে আমি এক হাজারের জন্য ৩২ হাজারকে তো অবহেলা করতে পারব না।”

অভিভাবকদের অসহযোগিতা

নতুন শিক্ষাক্রমে শিশুদের কাজে অভিভাবকদেরও সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে। তবে অভিভাবকদের সহযোগিতা সেভাবে পাচ্ছেন না বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।

খুলনা সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী আরেফিন বারী সিদ্দিকী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নতুন যে শিক্ষাক্রম সেটির একটি তাতপর্যপুর্ণ দিক হলো শিক্ষার্থীদের শিখন সহায়তায় অভিভাবকদের নিয়মিত ওয়াকিবহাল থাকা। আমরা অনেক কাজ দিই যেখানে অভিভাবকদের পার্টিশিপেশনের ব্যাপার রয়েছে। তাদের সাথে আলোচনা করে শিক্ষার্থিরা সেই কাজ সম্পন্ন করবেন।

“আমার অনেক শিক্ষার্থী এসে অভিযোগ করেছেন তাদের প্যারেন্টসদের থেকে সেই সহযোগিতা তারা পায়নি, সেই সময়টা তারা পায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কমেন্ট করেছেন, ‘বই নিয়ে পড়ার নাম নাই, আজাইরা কাজে ব্যস্ত’। সেরকম তথ্যও পেয়েছি শিক্ষার্থীদের থেকে।”

নরসিংদীর চালাকচর উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সাদিয়া মেহজাবিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার এক ছাত্র কাঁদতে কাঁদতে এসে জানাল, রঙিন কাগজ কেনার টাকা চাওয়ায় তার বাবা তাকে চড় মেরেছে। পোস্টার বানাতে দেওয়া হয়েছিল তাদের।

“যদিও আমরা তাদের বলি যে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে তোমরা সেটাকে করবে। সবসময় অলটারনেটিভ অপশনও বলি। কিন্তু অন্যদের দেখে নিজের চিন্তার জগৎ থেকে তাদের আগ্রহ হয় এই সাজসজ্জার ব্যাপারে।”

অনেক পরিবার অস্বচ্ছল হতে পারে, সেটা স্বীকার করে নিয়েই এই িশক্ষক বলেন, তাতেও সন্তানের গায়ে হাত না তুলে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

খুলনার শিক্ষক আরেফিন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি শিক্ষক-অভিভাবক মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

এই পরিস্থিতির অবসান প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “নয়ত শিক্ষক ও অভিভাবক এই দুইয়ের মাঝে পড়ে বেকায়দায় থাকে শিক্ষার্থীরা। তাদের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।”

“অনুরোধ করব যে সন্তানের প্রতি আরেকটু মনোযোগী হন। কোনো প্রশ্ন বা সংশয় থাকলে সেই বিষয়ক শিক্ষক কিংবা স্কুলে যোগাযোগ করুন,” অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন এই শিক্ষক।

চতুর্থ পর্ব পড়ুন : অভিভাবকরা দিশাহারা

শেষ পর্ব পড়ুন : ধাক্কা সামাল দিতে পারছে কি কর্তৃপক্ষ

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন : শহুরে শিশুরা শিখছে অনেক, গ্রামে রান্নাতেই আটকে

প্রথম পর্ব পড়ুন : শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, কীভাবে শিখছে

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত