যাদের নেতৃত্ব অভ্যুত্থান বাংলাদেশের গতিমুখ দিয়েছে বদলে, তাদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করল নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি।
নতুন এই দলে নেতৃত্ব দেবেন নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেন। নাহিদ আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন, আখতার পালন করবেন সদস্য সচিবের দায়িত্ব।
শুক্রবার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে এক সমাবেশের মাধ্যমে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই সমাবেশকে ‘ঐতিহাসিক’ বলছেন দল গঠনের উদ্যোক্তারা।
নতুন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনীম জারা সমাবেশে বলেন, “আজ আমরা কেবল একটি নতুন রাজনৈতিক দলই গঠন করছি না, আমরা নতুন এক রাজনীতির পথচলা শুরু করছি। আমরা নতুন ধরনের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করছি।”
সারাদেশ থেকে আসা অগুনতি সমর্থক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণের মধ্যে এই অনুষ্ঠান হয়।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে এই দল গঠিত হয়েছে। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজকও ছিল তারা।
বেলা ৩টার পর কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল পাঠের পর জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। তারপর দেখানো হয় জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত দুটি চলচ্চিত্র।
বক্তব্য পর্বের পর মঞ্চ থেকে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক পদে নাহিদ এবং সদস্য সচিব পদে আখতারের নাম ঘোষণা করেন অভ্যুত্থানে নিহত মো. ইসমাইল হোসের রাব্বির বোন মিম আক্তার।
এরপর আখতার প্রথমে কমিটির শীর্ষ ১০টি পদে ১০ জনের নাম ঘোষণা করেন। পরে যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সদস্য সচিব, যুগ্ম সংগঠদের নাম ঘোষণা করেন।
আহ্বায়ক নাহিদের পাশাপাশি নতুন দলে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করবেন সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব।
সদস্য সচিব আখতারের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব পদে দায়িত্ব পালন করবেন তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান সমন্বয়কারী পদে থাকছেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। যুগ্ম সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন আবদুল হান্নান মাসউদ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) এবং সারজিস আলম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) পদে দায়িত্ব পালন করবেন।
বেশ কয়েকজন যুগ্ম সদস্য সচিবের মধ্যে সালেহ উদ্দিন সিফাত দপ্তরের দায়িত্ব সামলাবেন।
নতুন দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আসেন নাহিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলনের শুরু থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন দল ছাত্র অধিকার পরিষদের যুক্ত থাকা নাহিদ পরে ওই সংগঠন ছেড়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামে একটি সংগঠনে যোগ দিয়ে এর সদস্য সচিব হন।
ছাত্র শক্তি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আখতার, যিনি নুরের সঙ্গে ডাকসুতে একই প্যানেল থেকে ভোট করে সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আখতারের ক্যাম্পাসের শিষ্য ও তার গড়ে তোলা সংগঠন ছাত্র শক্তির নেতারাই কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন সংগঠনে মূল ভূমিকা রেখেছিলেন।
আইন বিভাগে আখতারের সহপাঠী ও বন্ধু মাহফুজ আলম এই অভ্যুত্থানে নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রেখেছিলেন। মাহফুজ এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা।
অভ্যুত্থানের পর গত সেপ্টেম্বরে গড়ে ওঠা নাগরিক কমিটিতে সদস্য সচিবের পদ নেন আখতার। এই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
নতুন দলের দুই মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর হাসনাত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হন, সারজিস হন নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক।
নতুন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন একজন ভাস্কর। আরেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আদিব জুলাই আন্দোলনের সময় মাহফুজের মতো লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন। পরে তিনি নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হন।
নতুন দলের যুগ্ম সমন্বয়ক হান্নান মাসউদ জুলাই আন্দোলনের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন।
নতুন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিবদের মধ্যে তাসনিম জারা একজন চিকিৎসক; নাহিদা সারওয়ার নিভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।
আখতার তাদের আংশিক আহ্বায়ক কমিটির ১৫১ সদস্যের নাম ঘোষণা করেন।
তাদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, মনিরা শারমিন, অনিক রায়, মাহবুব আলম, সারওয়ার তুষার, মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন, তুজরুবা জাবিন, সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া, আতিক মুজাহিদ, আশরাফ উদ্দিন মাহদি, অর্পিতা শ্যামা দেব, তানজিল মাহমুদ, খালেদ সাইফুল্লাহ, জাবেদ রাসিম, এহতেশাম হক ও হাসান আলী।
যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন, আরিফ সোহেল, রশিদুল ইসলাম রিফাত, মাহিন সরকার, মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, আকরাম হোসাইন, এস এম সাইফ মুস্তাফিজ, সালেহ উদ্দিন সিফাত (দপ্তরে সংযুক্ত), আলাউদ্দিন মুহাম্মদ, ফরিদ উদ্দীন, মোহাম্মদ ফারহাদ আলম ভুইয়া, মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া, লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম তুহিন, মুশফিকুর সালেহিন, জাহিদুল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম মুসা, হুমায়রা নুর, মুশফিকুর রহমান জুহান, মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান, শাগুপ্তা বুশরা বিসমা, আহনাফ সাঈদ খান, আবু সাঈদ মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন, মীর আরশাদুল হক, ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, তারেক রেজা, মশিউর রহমান, জয়নাল আবেদিন শিশির, মোহাম্মদ মুনতাসির রহমান, গাজী সালাউদ্দিন তানভীর, তামিম আহমেদ ও তাহসিন রিয়াজ।
যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) মোহাম্মদ আতাউল্লাহ, মাহমুদা মিতু, মোল্লা রহমতুল্লাহ, এম এম শাহরিয়ার ও জোবায়ের আরিফ।
যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সাইফুল্লাহ হায়দার, আলী নাসের খান, সাকিব মাহদি, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, সাদিয়া ফারজানা দিনা, অলিক মৃ ও হানিফ খান সজিব।
যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম (যুব উইং), আব্দুল আহাদ, দিলশানা পারুল, আবু হানিফ, আব্দুস জাহের, মাজহারুল ইসলাম ফকির, গোলাম মোর্তজা সেলিম, আশিকিন আলম, জাহিদুল বারি, কৈলাশ চন্দ রবিদাস, ডেভিড রাজু, শেখ মো. শাহ মইন উদ্দিন, মারজুক আহমেদ ও সাদ্দাম হোসেন।
সমাবেশের কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশের পর নাহিদ দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তার আগে আখতার ছাড়াও বক্তব্য রাখেন নতুন কমিটির নেতা হান্নান মাসউদ, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অভ্যুত্থানে নিহত জাবিরের বাবা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সাইফুল্লাহ হায়দার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসনাত অপু।
সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয় মানিক মিয়া এভিনিউর পশ্চিম প্রান্তে পূর্বমুখী করে। মঞ্চের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রিত নেতারা ও জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের জন্য বসার ব্যবস্থা রাখা হয়।
বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে রাজধানীর সবচেয়ে বিশাল সড়কটি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। সড়কজুড়ে স্থাপন করা বড় স্ক্রিনেও সমাবেশে নেতাদের বক্তব্য দেখানো হয়।