তাসমান সাগর পাড়ের দেশ নিউজিল্যান্ড। এক লাখ বর্গমাইলের দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৫ মিলিয়ন। ঢাকা শহরেও বাস করে এর তিনগুণ মানুষ। সেই নিউজিল্যান্ড ছড়ি ঘোরাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনে। জনপ্রিয় বেশির ভাগ খেলাতেই দাপট তাদের।
কীভাবে সম্ভব এত কম জনসংখ্যা নিয়ে এত বেশি খেলায় সাফল্য পাওয়া? হ্যামিল্টনের ওয়াইকাতো হাই পারফর্ম্যান্স সেন্টারের স্টাফ কেইথ হার্ভে জানিয়েছেন, ‘‘এখানে খেলোয়াড়ের জন্ম হয় না, তৈরি হয়। উদীয়মান খেলোয়াড়দের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিতে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হয় এখানে।’’
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় যেমন জন্মগত প্রতিভাবান ফুটবলার পাওয়া যায়, নিউজিল্যান্ডে ব্যাপারটা এরকম নয়। নিউজিল্যান্ডে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ নেয় সেই প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী। সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মান সম্পন্ন কোচরা।
এরপর নিজেদের পছন্দের খেলা বেছে নিয়ে ওয়াইকাতো হাই পারফর্ম্যান্স সেন্টারের মতো নানা প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ পান তারা। এরই সুফল নিউজিল্যান্ড পেয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স, রাগবিসহ অন্যান্য খেলায়।
নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের বাবা যেমন খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেটে। সেখানে ভালো কিছু করতে না পেরে হয়ে যান সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। উইলিয়ামসনের মা ছিলেন বাস্কেটবল খেলোয়াড়। উইলিয়ামসনের তিন বোনই খেলেছেন ভলিবল, তাদের দুজন ছিলেন জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে। উইলিয়ামসন নিজে স্কুল ক্রিকেটে করেছেন ৪০টির বেশি সেঞ্চুরি। এরপর পাকাপাকিভাবে পেশা হিসেবে বেছে নেন ক্রিকেট।
ক্রিকেটে সাফল্যের পেছনে রয়েছে নর্থ আইসল্যান্ডের হক বে ক্রিকেট ক্যাম্প। গত ৩০ বছরে নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলের এমন কেউ ছিলেন না, যারা অংশ নেননি এই ক্যাম্পে। অথচ ৪৫ বছর আগে ১২টা দল নিয়ে একটা ক্যাম্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখানে। সেখানেই এ বছর ১৫০টা ক্রিকেট দল ২০০০ জন ক্রিকেটার নিয়ে খেলেছে ৪৫০টার বেশি ম্যাচ। খেলাগুলো হয়েছে ২০টি মাঠে।
স্কুল ক্রীড়ার অবদানের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের সাফল্যের পেছনে আছে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক আর ভৌগোলিক কারণও। টরাঙ্গা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক জন সায়েমসের ব্যাখ্যা, ‘‘জাতি হিসেবে আমরা ঔপনিবেশিক। এভাবে বিচ্ছিন্ন থেকে বিশ্বকে দেখাতে চাই আমরাও সফল হতে পারি, মাদারকান্ট্রি ইংল্যান্ডকেও পেছনে ফেলতে পারি।’’
অদম্য এই জেদের কারণেই হয়তো এই শতকে রাগবিতে ৮০ শতাংশ ম্যাচ জিতেছে নিউজিল্যান্ড। তারা রাগবি বিশ্বকাপের ১০ আসরের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন তিনবার, রানার্সআপ দুইবার।
ক্রিকেট ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা না জিতলেও সেমিফাইনাল খেলেছে সবচেয়ে বেশিবার। ফাইনালও খেলেছে দুবার (২০১৫ ও ২০১৯)। জিতেছে প্রথমবার টেস্ট বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। প্রথম দল হিসেবে ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতেছে ৩-০ ব্যবধানে। কদিন আগে শেষ হওয়া মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নও নিউজিল্যান্ড।
গত প্যারিস অলিম্পিকে নিউজিল্যান্ড পদক তালিকায় ছিল ১১ নম্বরে। তারা সোনা জিতেছে ১০টি। ফুটবলে বিশ্বকাপ খেলেছে ১৯৮২ ও ২০১০ সালে। ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপে তিন ম্যাচের হারেনি একটিতেও। এই তিন ড্র’র একটি ছিল ইতালির মতো ঐতিহ্যবাহী দলের সঙ্গে।
নিজেদের ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড উদারভাবে স্বাগত জানায় বিদেশি খেলোয়াড়দের। ক্রিকেটেই যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলা নেইল ওয়াগনার, গ্লেন ফিলিপস, ডেভন কনওয়েদের নিজেদের জাতীয় দলে জায়গা দিয়েছে কিউইরা। জিম্বাবুয়ে থেকে এসেছিলেন কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে খেলেছেন লুক রঙ্কি।
আইপিএলেরও আগে ২০০৫-০৬ মৌসুমে শুরু হয়েছিল নিউজিল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। টাকার খেলা আইপিএলের সঙ্গে কখনই প্রতিযোগিতায় যায়নি তারা। এর বদলে টাকা খরচ করেছে বয়স ভিত্তিক খেলা, মাঠ আর স্টেডিয়াম নির্মাণে।
কেন উইলিয়ামসনের শহর টরাঙ্গাতেই যেমন আছে একটা ক্রিকেট স্টেডিয়াম,দুইটা রাগবি মাঠ, হাইপারফর্ম্যান্স সেন্টার, অ্যাস্টোটার্ফসহ হকির মাঠ, অ্যাথলেটিক্সের টার্ফ। আছে সেইলিং ক্লাবও। শুধু উইলিয়ামসনের শহরেই নয়, মোটা টাকার বিনিয়োগে নিউজিল্যান্ড জুড়েই ক্রীড়াঙ্গনের এসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে দেশটির সরকার।
নিউজিল্যান্ডে তাই প্রতিভাবান খেলোয়াড় হিসেবে জন্ম না হলেও তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না!