দেশের কোনও ব্যাংক বন্ধ হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছু ব্যাংকের অবস্থা ভালো হচ্ছে, কিছু ব্যাংক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কিন্তু কোনও ব্যাংক বন্ধ হবে না।”
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষ্যে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন বলেন, “ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে অনেকগুলো ব্যাংকে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা এখন সিম্পটম দেখে সংস্কারের পদক্ষেপ নিচ্ছি। ম্যানেজমেন্ট খারাপ ছিল, গভর্নেন্স করাপ্ট ছিল। কতগুলো ব্যাংক ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
“ইসলামী ব্যাংক দেশের বিগেস্ট ব্যাংক, এটা কিন্তু ফিরে আসার পথে। কিছু ব্যাংক হয়ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে। কিন্তু আমরা কোনও ব্যাংক বন্ধ করে দেব না।”
তিনি বলেন, “ব্যাংকিং খাতে সংস্কারগুলো মানুষের কল্যাণের জন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী সুবিধার জন্য। এমন না যে আমরা আবার টাকা ছাপিয়ে দিয়ে দিলাম। তারা (বিগত আওয়ামী লীগ সরকার) তো মহা আনন্দে টাকা ছাপিয়েছে।”
বাজেট ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন বলেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা আটকানো হবে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) কোনও কোনও প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
“আমাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) সাফল্যের সূর্য উদিত হয়েছে; আমাদের অর্জন খুব একটা খারাপ নয়। আমরা ছাপ রেখে যাব। কিছু সংস্কার করে যাব। পরবর্তী সময়ে যারা আসবেন, তারা বুঝবেন, এখান থেকে রাস্তা তৈরি করতে হবে। কল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।”
তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এর আগে এমন আশ্বাস বা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ পায়নি। এটা সরকারের অন্যতম সাফল্য।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “এটা এক দিনে হয়নি। সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে পেঁয়াজ, চাল, সয়াবিন তেল ইত্যাদিতে শুল্কহার কমানো হয়েছে। অবশ্যই আলু ও পেঁয়াজের দাম অতিরিক্ত বেড়েছে, যদিও তার অনেক কারণ আছে।”
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কষ্টের কথা স্বীকার করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলি। কিন্তু এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ছোট একটা ব্যাগে সামান্য বাজার পাওয়া যায়, তা আমিও টের পাই। কারণ, আমিও বাজারে যাই, দুঃখ লাগে।”
এনবিআরকে আধুনিকায়নের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন বলেন, “এনবিআরের সিস্টেমটা অতটা আধুনিক নয়; হয়ত কাস্টমসে কিছুটা আধুনিকায়ন হয়েছে। সিস্টেমটা যদি অটোমেটেড হয়, তাহলে ভ্যাট কালেকশন, আয়কর কালেকশন, কাস্টম ডিউটি কালেকশন সহজ হবে।
“এবার ই-রিটার্ন নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে চার লাখ ই-রিটার্ন চলে আসছে। কোম্পানির ই-রিটার্ন নিতে সময় লাগবে। ব্যবসায়ীরা এনবিআরকে একটু ভীতির চোখে দেখে। অটোমেটেড হলে সবকিছু হবে স্বচ্ছ।”
‘অর্থঋণ আদালতকে আরও সক্রিয় করা হবে’
সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা জানান, খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতকে আরও সক্রিয় করা হবে। একইসঙ্গে হাইকোর্টে হওয়া রিট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, “হাইকোর্টের রিট মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য দুটি বেঞ্চ রয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল ও গভর্নরের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে, যাতে এই বেঞ্চগুলো আগামী তিন মাস শুধু রিট মামলাগুলো পরিচালনা করে।”
ভালো ব্যবসায়ীদের ভীত হওয়ার কোনও কারণ নেই জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “যারা ঋণ নিয়ে ঠিকমতো ফেরত দেন এবং ঠিকমতো কর দেন, তাদের কোনও সমস্যা হবে না। তারাই ভীতু হয়ে আছে যারা বিগত সরকারের সময়ে নানাভাবে অনেক কিছু করেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজা ৮২২ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ছয় মাসে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বেড়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। আর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর- নয় মাসে ১ লাখ ৩৯ ৩৪৪ কোটি টাকা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ।
তিন মাস পর পর (প্রান্তিক) খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা; যা ছিল বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।
দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে তা আরও বেড়ে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায় ওঠে, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে।