বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে ২৫টি ক্যাডারের সদস্যরা প্রশাসন ক্যাডারের ‘আধিপত্যের’ কারণে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বলা হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের ‘আগ্রাসী মনোভাবের’ কারণে অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যরা পদোন্নতি, পদায়ন, বদলি, বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
শনিবার ঢাকার সেগুনবাগিচায় পূর্ত ভবন মিলনায়তনে ‘রাষ্ট্র সংস্কার : প্রেক্ষিত সিভিল সার্ভিস’ শিরোনামে এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ নামে বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তাদের একটি সংগঠন এ বৈঠকের আয়োজন করে।
১৯৯৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে উপ-সচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫ শতাংশ কোটা রেখে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ হয়ে আপিল বিভাগের আদেশে এ প্রজ্ঞাপনের বৈধতাও দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, সরকারের আরেকটি প্রজ্ঞাপনের কারণে উপসচিব থেকে তার ওপরের পদগুলোতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের কোনও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় না।
পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের অগ্রাধিকার রেখে কোটা ব্যবস্থার কারণে অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যরা মান-মর্যাদার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়তে হয়। উপসচিব থেকে তার ওপরের পদে পদোন্নতিতে কোটা প্রথা বাতিল, উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া, মন্ত্রণালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারভিত্তিক কর্মকর্তাদের পদায়নের দাবি তুলেছেন অন্য ক্যাডাররা।
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, “ক্যাডারে ক্যাডারে কোনও বৈষম্য থাকতে পারে না। যে বৈষম্য দূর করতে আন্দোলন হয়েছে, সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য সরকারকে ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের দাবিটি পূরণ করতে হবে।”
সরকার সেই দাবি পূরণ করতে না পারলে অবশ্যই রাস্তায় নামতে হবে- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের সুবিধা দিলে ন্যায্য-সমতাভিত্তিক বাংলাদশে তৈরি সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদেরই উচিত ক্যাডারের বৈষম্য দূর করতে এগিয়ে আসা।”
মেধার ভিত্তিতে পদায়ন হওয়া উচিত মন্তব্য করে সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, একজন চিকিৎসক কেন তার মন্ত্রণালয়ে প্রধান হতে পারবেন না? কৃষিবিদ কেন তার মন্ত্রণালয়ে প্রধান হতে পারবেন না?
“মন্ত্রণালয়গুলোতে আইন করে ঠিক করতে হবে যে, বাইরের ক্যাডারের কেউ আসতে পারবেন না।”
প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য সংখ্যা এক হাজারের মতো এবং অন্যান্য ক্যাডারের সংখ্যা ১০ হাজার। দাবি আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “দাবি আদায়ে তো আপনারা বাংলাদেশ অচল করে দিতে পারেন। আপনারা কর্মবিরতি পালন করেন। বলেন, ‘আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত, যে অন্যায়, যে জুলুম হচ্ছে, তা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত কাজ করবো না।’”
ক্যাডারে ক্যাডারে বৈষম্য দূর করতে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “এক নম্বর গ্রেডে সবাইকে যেতে দিতে হবে। আর তা যদি না হয়, তাহলে একটি ক্যাডার রেখে সব ক্যাডার বাতিল করতে হবে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যেখানে যে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন সেখানে সেই বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিপ্লবী সরকার নয়, গণঅভ্যুত্থানের সরকার হিসেবে অবহিত করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম বরবানী বলেন, “এ সরকার বিপ্লবী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সরকারের চরিত্রে বিপ্লবের ছিটেফোঁটাও নেই। যদি তা হত তাহলে গণঅভ্যুত্থানের তিন মাস পরে এসে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হওয়ার কথা ছিল না।”
গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে একটি প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে না যা ধ্বংস করা হয়নি। এর সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি এবং একটি ক্যাডার। ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদের দোসর হচ্ছে এই প্রশাসন ক্যাডার।
প্রশাসন ক্যাডারের কাছে ২৫টি ক্যাডারের সবাই বৈষম্যর শিকার মন্তব্য করে সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মাহফুজ আহমেদ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে পদ না থাকা সত্বেও পদ দেখিয়ে পদোন্নতি দেয়া হয়। আর অন্যান্য ক্যাডারে চলতি, অতিরিক্ত, সাময়িক দায়িত্বে রেখে দেওয়া হয়।
প্রশাসনের বাইরের ২৫টি ক্যাডারের সদস্যদের যুক্তি, সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদ এবং সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন অ্যান্ড কনডিশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৫ এর বিধান অনুযায়ী সরকার আরেকটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই কোটা বণ্টন পদ্ধতি পরিবর্তন করা যায়। একই সঙ্গে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ওই কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন ও বৈষম্যহীন প্রশান গড়তে পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর দাবি জানানো হয়।