শান্তিতে এবারের নোবেল পুরস্কার পেয়েছে জাপানের পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদানকিও।
এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের নিয়ে গঠিত একটি তৃণমূল সংগঠন।
পরমাণু অস্ত্রমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ার জন্য কাজ করা সংগঠনটি ‘হিবাকুশা’ নামেও পরিচিত।
নোবেল কমিটি বলেছে, বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার প্রচেষ্টা এবং পরমাণু অস্ত্র যে আর কখনও ব্যবহার করা উচিৎ নয়, তা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের মাধ্যমে তুলে ধরার জন্যই সংগঠনটিকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
১৯৪৫ সালের আগস্টে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলায় সঙ্গেই সঙ্গেই প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল এবং আহত হয়েছিল বেশ কয়েক লাখ মানুষ।
পরবর্তী কয়েক মাসে আহতদের মধ্যেও প্রায় একই সংখ্যক মানুষ মারা যায়। ধারণা করা হয়, সে বছরের মধ্যেই সবমিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম পারমাণবিক বোমাটি ফেলে, তখন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিল।
বোমাটি ফেলার পর বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় পুরো আকাশ ছেঁয়ে গেলে তা দেখে যুদ্ধবিমানটির পাইলট বলে ওঠেন, “হায় ঈশ্বর! এ আমরা কী করলাম!”
তিন দিন পরে যুক্তরাষ্ট্র নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমাটি ফেললে আরও প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় জাপান হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
আহতদের মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বেঁচে যান। তবে তাদের অনেকেই পারমাণবিক বিকিরণের ফলস্বরূপ ক্যান্সারসহ ভয়ানক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগছিলেন। এই জীবিতদের জাপানি ভাষায় ‘হিবাকুশা’ বলা হয়।
বেঁচে থাকা মানুষগুলোর ভাগ্য দীর্ঘকাল গোপন রাখা এবং উপেক্ষা করা হয়েছিল। অবশেষে ১৯৫৬ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় হিবাকুশা অ্যাসোসিয়েশনগুলো ‘দ্য জাপান কনফেডারেশন অব এ- অ্যান্ড এইচ-বম্ব সাফারার্স’ নামে একটি সংস্থা গঠন করে।
সেই সংগঠনটিকেই জাপানি ভাষায় সংক্ষেপে নিহন হিদানকিও বলা হয়। এই তৃণমূল আন্দোলনটিই পরে জাপানের বৃহত্তর হিবাকুশা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনে পরিণত হয়।
নিহন হিদানকিওর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমটি হলো- জাপানসহ বিশ্বজুড়ে বসবাসকারী সকল হিবাকুশার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষায় কাজ করা। দ্বিতীয়টি হলো- হিবাকুশাদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, অন্য কেউ যেন আর তার শিকার না হয় তার জন্য সচেতনতা তৈরি করা।
হিবাকুশাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সাক্ষ্য তুলে ধরার মাধ্যমে নিহন হিদানকিও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিপর্যয়কর মানবিক পরিণতি নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছে। তাদের স্লোগান— ‘আর কোনও হিবাকুশা চাই না’।
তাদের প্রচেষ্টার ফলে বিশ্বব্যাপী এমন একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যার সদস্যরা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিপর্যয়কর মানবিক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আদর্শ গড়ে ওঠে যে- পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই আদর্শটি ‘পরমাণু ট্যাবু’ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। হিবাকুশাদের সাক্ষ্য এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই ঐতিহাসিক সাক্ষীরা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে প্রচারণা চালিয়ে সারা বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধিতা এবং জোটবদ্ধতা তৈরি করতে সাহায্য করেন।
নোবেল কমিটির মতে, “হিবাকুশা আমাদেরকে অবর্ণনীয়কে বর্ণনা করতে, অকল্পনীয়কে কল্পনা করতে এবং পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে সৃষ্ট দুর্বোধ্য যন্ত্রণা ও কষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম করেছে।”
এই উপলব্ধির কারণেই গত প্রায় ৮০ বছরে আর কোনও যুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। নিহন হিদানকিও এবং হিবাকুশাদের অন্যান্য প্রতিনিধিদের অসাধারণ প্রচেষ্টা এই পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রেখেছে।
কিন্তু উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা চাপের মধ্যে রয়েছে। কারণ পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো তাদের অস্ত্রাগার আধুনিকীকরণ ও উন্নত করছে। নতুন অনেক দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে। এমনকি চলমান একটি যুদ্ধেও (রাশিয়া-ইউক্রেন) পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
নোবেল কমিটি বলেছে, মানব ইতিহাসের এমন মুহূর্তে পরমাণু অস্ত্র কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে বিশ্ববাসীকে ফের তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই তারা এবারের শান্তির নোবেলটি নিহন হিদানকিওকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নোবেল কমিটি বলে, “এখনকার পরমাণু অস্ত্রগুলোর ধ্বংসাত্মক শক্তি আগের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এখন পারমাণবিক বোমা হামলা চালালে কোটি কোটি মানুষ নিহত হবে এবং জলবায়ুতেও বিপর্যয় নেমে আসবে। পারমাণবিক যুদ্ধ বিশ্ব সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
“আলফ্রেড নোবেলের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে ছিল এই বিশ্বাস যে, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তিরা দুনিয়াকে বদলে দিতে পারে। নিহন হিদানকিওকে এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি সেই সমস্ত জীবিত ব্যক্তিদের সম্মান জানাতে চায়, যারা শারীরিক কষ্ট এবং বেদনাদায়ক স্মৃতি সত্ত্বেও শান্তির জন্য আশা এবং প্রচেষ্টা গড়ে তুলতে তাদের ব্যয়বহুল অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেছেন।”
নিহন হিদানকিও পারমাণবিক হামলায় বেঁচে যাওয়া হাজার হাজার প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের বার্ষিক সম্মেলনসহ বিভিন্ন শান্তি সম্মেলনে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে বিশ্বকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
নোবেল কমিটি বলেছে, “ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে একদিন হিবাকুশারা আর আমাদের মাঝে থাকবে না। তবে স্মরণের একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি এবং অব্যাহত প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাপানের নতুন প্রজন্ম তাদের অভিজ্ঞতা ও বার্তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা বিশ্বজুড়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে এবং শিক্ষিত করছে। এভাবে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের নিষিদ্ধতা বজায় রাখতে সাহায্য করছে, যা বিশ্ব মানবতার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের পূর্বশর্ত।”
পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান জর্গেন ওয়াটনে ফ্রাইডনেস বলেন, “হিবাকুশার গল্প এবং সাক্ষ্যগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার কতটা অগ্রহণযোগ্য তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক। ২০২৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপকারের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছাই পূরণ করে।”
এর আগেও দুবার— ২০১৭ ও ১৯৯৫ সালে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী সংস্থা ও ব্যক্তিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
২০১৭ সালে শান্তিতে নোবেল পায় ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপন’ নামের সংগঠন। আর ১৯৯৫ সালে ‘পুগওয়াশ কনফারেন্সেস অন সায়েন্স অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয় পদার্থ বিজ্ঞানী জোসেফ রটব্ল্যাটকে।
পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত ম্যানহাটন প্রকল্পকে অনৈতিক ঘোষণা করে তা থেকে বেরিয়ে যাওয়া একমাত্র বিজ্ঞানী ছিলেন জোসেফ রটব্ল্যাট।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) পরিচালনক ড্যান স্মিথ সিএনএনকে বলেন, হিবাকুশাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ায় তিনি অনেক আনন্দিত।
স্মিথ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও মিখায়েল গর্বাচেভ যেমনটা বলেছেন- পারমাণবিক যুদ্ধে কেউ জয়ী হতে পারবে না, তাই তা হওয়া উচিতও নয়। আর হিবাকুশারা প্রতিদিন আমাদেরকে সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।”
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) তাদের এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, পারমাণবিক শক্তিধর ৯টি রাষ্ট্রের সবগুলোই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের আধুনিকায়ন করে চলেছে। এমনকি অনেকে ২০২৩ সালে নতুন পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত বা পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম অস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে।
পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো হল— যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েল।
সংস্থাটির অনুমান, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশগুলোর কাছে মোট ১২ হাজার ১২১টি বোমা ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ৫৮৫টি বোমা সম্ভাব্য ব্যবহারের জন্য সামরিক মজুদে রয়েছে।
স্মিথ বলেন, “স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরমাণু অস্ত্রগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলায় বিশ্বব্যাপী পরমাণু ওয়ারহেডের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা বছরের পর বছর অপারেশনাল পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা বাড়তে দেখছি।
“এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে এবং সম্ভবত আগামী বছরগুলোতে তা আরও ত্বরান্বিত হবে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”
২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর থেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বারবার পশ্চিমাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়ে আসছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ প্রধান পশ্চিমা শক্তিগুলো পারমাণবিক হামলার ভয়ে ইউক্রেনকে বিশেষ অস্ত্র পাঠানোর বা রাশিয়ার ভূখণ্ডের গভীরে হামলার অনুমতি দিচ্ছে না।
তথ্যসূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটওআরজি, সিএনএন, আল জাজিরা