চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুনকে। অ্যামব্রোস ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক। আর রুভকুন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জেনেটিক্সের অধ্যাপক।
মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার এবং ট্রান্সক্রিপশন বা প্রতিলিপিকরণ-পরবর্তী জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে মাইক্রোআরএনএর ভূমিকা তথা জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের একটি মৌলিক নীতি আবিষ্কারের জন্য তাদেরকে এবারের নোবেল দেওয়া হয়।
মাইক্রোআরএনএ হল একটি অণুজীব যা প্রাণীদেহের কোষের ভেতরে জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। কোষের ভেতরেই থাকে জিন ও মাইক্রোআরএনএ। ১৯৯৩ সালে ভিক্টর অ্যামব্রোস ও তার টিম মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করেন। আর গ্যারি রুভকুন ও তার টিম জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে মাইক্রোআরএনএর কার্যপদ্ধতি উদঘাটন করেন।
ক্ষুদ্র আরএনএ অণুর একটি নতুন শ্রেণি মাইক্রোআরএনএ প্রাণকোষের ভেতরে থাকা জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের যুগান্তকারী আবিষ্কার জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের একটি সম্পূর্ণ নতুন মৌলনীতি প্রকাশ করে, যা মানুষ সহ বহুকোষী প্রাণীর বিকাশের জন্য অপরিহার্য। মানব জিনোম এক হাজারেরও বেশি মাইক্রোআরএনএ তৈরি করা জিন আছে।
তাদের গবেষণায়, সার্বিকভাবে জিন কীভাবে মানবদেহের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের কোষের জন্ম দেয় তা আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রক্রিয়াটি জিন নিয়ন্ত্রণ নামে পরিচিত। কয়েক দশক ধরে তারা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে আসছিলেন।
নোবেল পুরস্কার কমিটি তাদের এই আবিষ্কারকে বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের শীর্ষচূড়া হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এই আষ্কিারকে একটি “যুগান্তকারী আবিষ্কার” বলে প্রশংসা করে নোবেল কমিটি। কমিটি জানায়, তাদের এই আবিষ্কার “জিন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা প্রকাশ করেছে।”
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির বিবর্তন বিষয়ক জিনোমিক্সের অধ্যাপক লাভ ডালেন বলেন, “কোষ কীভাবে কাজ করে এবং তার মধ্য দিয়ে কীভাবে প্রাণের বিকাশ ঘটে তথা বহুকোষী প্রাণ বেড়ে উঠে ও বেঁচে থাকে তা বোঝার ক্ষেত্রে তাদের আবিষ্কার মৌলিক গুরুত্ব বহন করে।”
তিনি সিএনএনকে বলেন, “আবিষ্কারটি যুগান্তকারী ছিল এবং জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রকে কমবেশি প্রভাবিত করেছে।”
কোষ কীভাবে কাজ করে
নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমাদের কোষের ভেতরে থাকা ক্রোমোজোমের মধ্যে সঞ্চিত তথ্যগুলোকে আমাদের শরীরের সমস্ত কোষের জন্য একটি নির্দেশনা ম্যানুয়ালের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। প্রতিটি কোষে একই ক্রোমোজোম থাকে, তাই প্রতিটি কোষে ঠিক একই জিনের সেট এবং হুবহু একই নির্দেশাবলী থাকে।
তথাপি, বিভিন্ন ধরনের কোষের, যেমন পেশী ও স্নায়ু কোষের ভিন্ন ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। “এই পার্থক্য কীভাবে উদ্ভূত হয়” সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই এই দুই বিজ্ঞানী তাদের ক্যারিয়ার ব্যয় করেছেন।
মানবদেহের সব কোষে জিনের সংখ্যা ও এর কর্মপ্রক্রিয়ার নির্দেশনার সংখ্যা সুনির্দিষ্ট থাকলেও বিভিন্ন ধরনের ও বিশেষায়িত কোষ কীভাবে তৈরি হয় তারা সেই প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন।
নোবেল কমিটি বলেছে, “এই প্রশ্নের উত্তর জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিল, যা প্রতিটি কোষকে শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলী নির্বাচন করতে দেয় এবং প্রতিটি কোষের মধ্যে শুধুমাত্র সঠিক জিনটি সক্রিয় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে।”
মাইক্রোআরএনএ কর্তৃক জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতিতে ক্রমবর্ধমান জটিল প্রাণের বিবর্তনে সহায়তা করেছে। মাইক্রোআরএনএর অস্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ বা জিনের কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা হলে ক্যান্সার, শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং হাড়ের বিভিন্ন রোগসহ নানা জটিল ব্যাধি তৈরি হয়।
মাইক্রোআরএনএ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের কোনোটিতে মিউটেশনের ফলে ডিআইসিইআর১ সিন্ড্রোম দেখা দেয়। এটি একটি বিরল কিন্তু গুরুতর সিন্ড্রোম বা লক্ষণ যা বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত। প্রোটিনগুলো মাইক্রোআরএনএর সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরন নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাতে মাইক্রোআরএনএ জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে এমআরএনএকে টার্গেট করে নিষ্ক্রিয়করনের কাজ করতে পারে।
নোবেল অ্যাসেম্বলির সেক্রেটারি-জেনারেল টমাস পার্লম্যান বলেছেন, “মাইক্রোআরএনএগুলো ক্যান্সার সৃষ্টিতে খুব বেশি জড়িত। ক্যান্সারের চিকিৎসায় মাইক্রোআরএনএকে ব্যবহারের জন্য গবেষণা চলছে— মাইক্রোআরএনএর কার্যক্রম নকল করে বা মাইক্রোআরএনএকে ব্লক করে। এতে এখনো কিছু প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে তাই এখনো কোনও ওষুধ উদ্ভাবন করা যায়নি।”
তিনি বলেন, “শরীরবিদ্যার মৌলিক বোঝাপড়া তৈরিতে অবদান রাখার ফলস্বরুপ এর যে মৌলিক গুরুত্ব সে কারণে আমরা এই আবিষ্কারকে নোবেল দিচ্ছি। আমরা ঐতিহাসিকভাবে জানি যে, এমন বড় বড় আবিষ্কারগুলো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় উন্নতিতে সহায়ক হয়, তবে তাতে একটু সময় লাগে।”
কোষ, ডিএনএ, জিন, আরএনএ
কোষ প্রাণের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। তথা প্রাণীদেহের গঠন, বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ ও বংশগতির তথ্য বহনকারী ক্ষুদ্রতম একক। এটি প্রাণীর ক্ষুদ্রতম জীবিত একক অর্থাৎ একটি কোষকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবিত বলা যেতে পারে। কোষ নিজে নিজেই বেঁচে থাকতে পারে এবং প্রাণী দেহের টিস্যু তৈরি করে দেহটিকে গড়ে তোলো। একে প্রাণীদেহের বিল্ডিং ব্লক বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
ব্যাকটেরিয়া এবং এ ধরনের কিছু জীব এককোষী। কিন্তু মানুষসহ পৃথিবীর অধিকাংশ জীবই বহুকোষী। মানবদেহে লাখ লাখ কোটি কোষ থাকে। একটি কোষের আদর্শ আকার ১০ মাইক্রোমিটার এবং ভর ১ ন্যানোগ্রাম।
লাইভ সায়েন্সের প্রতিবেদন মতে, ১৫০০টিরও বেশি গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, গড়পড়তা একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষের শরীরে প্রায় ৩৬ লাখ কোটি (৩৬ এর পরে ১২টি শুন্য) কোষ থাকে। আর গড়পড়তা একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর দেহে ২৮ লাখ কোটি এবং ১০ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ১৭ লাখ কোটি কোষ থাকে।
একটি কোষের তিনটি প্রধান অংশ থাকে— ঝিল্লি, নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজম। ঝিল্লি কোষটিকে ঘিরে রাখে এবং কোষের ভেতরে এবং বাইরে চলাচল করা পদার্থগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
নিউক্লিয়াস হল কোষের অভ্যন্তরে একটি কাঠামো যাতে থাকে নিউক্লিওলাস এবং ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোম কোষের বেশিরভাগ ডিএনএ ধারণ করে। ডিএনএতে থাকা জিন থেকেই আরএনএ তৈরি হয়। নিউক্লিওলাসের কাজ কোষের রাইবোজোম তৈরি এবং একত্রিত করা।
সাইটোপ্লাজম হল কোষের ভিতরের তরল, যার অবস্থান ঝিল্লি এবং নিউক্লিয়াসের মাঝখানে। নিউক্লিয়াস এই তরলের মধ্যখানে থাকে। এই তরলে কোষের আরও কিছু ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে যেগুলোর নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গোলগি কমপ্লেক্স, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম। সাইটোপ্লাজমেই বেশিরভাগ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এবং বেশিরভাগ প্রোটিন তৈরি হয়।
কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে ক্রোমোজোম। ক্রোমোজম হল প্যাঁচানো সুতা-সদৃশ গোল কাঠামো যা ডিএনএ এবং সংশ্লিষ্ট প্রোটিন (যাকে হিস্টোন বলা হয়) দিয়ে গঠিত। ক্রোমোজোমের কাঠামোর ভিতরে ডিএনএগুলো কয়েলের আকারে পেঁচিয়ে থাকে।
ডিএনএ জিন আকারে জেনেটিক তথ্য বা নির্দেশনা বহন করে এবং তারা কোষ বিভাজন, বৃদ্ধি, বিকাশ এবং এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে বংশগত বৈশিষ্ট্য সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি কোষে জেনেটিক নির্দেশনার (ডিএনএ) একটি সম্পূর্ণ সেট থাকে, যা কোষটির কার্যাবলীর নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে।
জিন থেকে তৈরি হয় আরএনএ ও প্রোটিন। প্রোটিন এবং কার্যকরী আরএনএ অণু তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী বহন করে জিন। এগুলো কোষের গঠন, বিপাক এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এমআরএনএ প্রোটিন তৈরিতে কাজ করে। প্রোটিনগুলো কোষের বৃদ্ধি, যোগাযোগ এবং পরিবেশগত উদ্দীপনার প্রতি প্রতিক্রিয়া সহ কোষের কার্যাবলী নির্ধারণ করে।
এমআরএনএ ও মাইক্রোআরএনএ
জিন দুই ধরনের। প্রোটিন কোডিং জিন ও নন-কোডিং জিন। কোডিং জিন থেকে তৈরি হয় মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ-mRna), যা প্রোটিন তৈরিতে মধ্যস্থতা করে। আর নন-কোডিং জিন থেকে তৈরি হয় মাইক্রোআরএনএ (miRna), যা প্রোটিন তৈরির জন্য এমআরএনএ তৈরি করা জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ কাজ করে।
ভিন্ন ভিন্ন কোষের ভেতরে কোষের ধরন এবং তার বর্তমান চাহিদার উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট জিনগুলো ‘চালু’ বা ‘বন্ধ’ হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে জিন এক্সপ্রেশন বা জিনের অভিব্যক্তি।
ডিএনএতে যেই জেনেটিক ব্লুপ্রিন্ট থাকে সেটা থেকে প্রোটিন তৈরিতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করে এমআরএনএ। এটি ডিএনএ থেকে জেনেটিক নির্দেশনা বহন করে রাইবোজোমে নিয়ে যায় প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য।
ডিএনএতে সংরক্ষিত জেনেটিক তথ্য বা নির্দেশনা এমআরএন-তে প্রবাহিত হয় যে প্রক্রিয়ায় তাকে বলে ট্রান্সক্রিপশন বা প্রতিলিপিকরন।
রাইবোজোম হল রাইবোজোমাল আরএনএ (আরআরএনএ-rRna) এবং প্রোটিন দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র আন্তঃকোষীয় কাঠামো। রাইবোজোমের মধ্যেই প্রোটিন সংশ্লেষণ ঘটে এবং এমআরএনএ প্রোটিনে রুপান্তরিত হয়।
সংক্ষেপে বললে, কোষের নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোমের ডিএনএতে থাকা জিন তথা জেনেটিক তথ্য বা নির্দেশনা ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় এমআরএনএতে রুপান্তরিত হয়। এমআরএনএ সেই নির্দেশনা পৌঁছে দেয় কোষের নিউক্লিয়াসের অপর অংশ নিওক্লিওলাসের তৈরি রাইবোজোমে, যা এমআরএনএকে সংশ্লেষণ করে প্রোটিনে রুপান্তরিত করে।
এই প্রক্রিয়াতেই কোষ প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরিতে ডিএনএতে সঞ্চিত জেনেটিক তথ্য ব্যবহার করে। প্রতিটি অংশ— ডিএনএ, জিন, এমআরএনএ ও রাইবোজোম— জেনেটিক তথ্য বা নির্দশনা প্রবাহিত করা এবং প্রোটিন উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য, যা কোষের বেশিরভাগ কার্য সম্পাদন করে।
এভাবে জীবন্ত প্রাণীতে জেনেটিক তথ্য বা নির্দেশনা প্রকাশের প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হল আরএনএ এবং ডিএনএর মধ্যকার সম্পর্ক। তাদের মিথষ্ক্রিয়া জিনের অভিব্যক্তি, প্রতিলিপি এবং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।
জিন ও মাইক্রোআরএনএ
মাইক্রোআরএনএ প্রোটিন তৈরিতে কাজ না করে বরং জিন এক্সপ্রেশন বা জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রোটিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। মাইক্রোআরএনএ জিন ও প্রোটিনের মধ্যস্থতাকারী এমআরএনএকে টার্গেট করে কোন জিন প্রকাশিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। কোষীয় প্রক্রিয়াগুলোর সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে প্রোটিন-কোডিং জিনের অভিব্যক্তিকে সংশোধন করে।
মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ)-কে টার্গেট করে কোনও জিন থেকে কতটা প্রোটিন তৈরি হবে বা হবে না তা নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের প্রধান কাজ। এর মধ্য দিয়ে তারা কোষের মধ্যে জিনের অভিব্যক্তির সামঞ্জস্য বিধান বা সমন্বয় করে কোষীয় কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখে।
এমআরএনএ ট্রান্সক্রিপ্টের বা প্রতিলিপির সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল স্তরে জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে মাইক্রোআরএনএ। এমআরএনএর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মাইক্রো আরএনএ কোন জিন ‘চালু’ বা ‘বন্ধ’ হবে এবং কতটা প্রোটিন তৈরি হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে মাইক্রোআরএনএ কোষের কোনও বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনগুলোর সঠিক পরিমাণে উৎপাদন নিশ্চিত করে।
তারা প্রাথমিকভাবে মেসেঞ্জার আরএনএর সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে কাজ করে— হয় একে অবনমিত করে বা এর প্রোটিনে রুপান্তরে বাধা দিয়ে কোষে প্রোটিন উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে সঠিক পরিমাণে প্রোটিন উৎপাদিত হয়।
কোনো মাইক্রোআরএনএ এবং এর টার্গেট এমআরএনএ যদি পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিপূরক হয়, তাহলে মাইক্রোআরএনএ সেই এমআরএনএটির অবনতি ঘটাবে এবং কার্যকরভাবে প্রোটিনে রুপান্তরিত হতে সক্ষম এমআরএনএর পরিমাণ কমিয়ে দেবে।
আর কোনো মাইক্রোআরএনএ এবং এর টার্গেট এমআরএনএ যদি শুধুমাত্র আংশিকভাবে পরিপূরক হয় তাহলে মাইক্রোআরএনএটি সেই এমআরএনকে রাইবোজোম থেকে প্রোটিনে রুপান্তরিত হতে বাধা দেবে।
মাইক্রোআরএনএ-র সামগ্রিক প্রভাবকে প্রায়ই জিন সাইলেন্সিং বা জিনকে নিষ্ক্রিয়কারক হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কারণ তারা টার্গেট জিন থেকে উৎপন্ন প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়— হয় প্রোটিনে রুপান্তর প্রতিরোধ করে বা খোদ এমআরএনএটিকেই ধ্বংস করে।
আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং টিস্যুগুলো বিভিন্ন ধরণের কোষ নিয়ে গঠিত। সবকটিই কোষই তাদের ডিএনএ-তে অভিন্ন জেনেটিক তথ্য সঞ্চিত রাখে। কিন্তু এই বিভিন্ন কোষের মধ্যে প্রোটিনের স্বতন্ত্র সেটও থাকে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? উত্তরটি জিনের ক্রিয়াকলাপের সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে, এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিটি কোষের মধ্যে শুধুমাত্র জিনের সঠিক সেট সক্রিয় রাখে।
এটি পেশী কোষ, অন্ত্রের কোষ এবং বিভিন্ন ধরণের স্নায়ু কোষগুলোকে তাদের বিশেষ কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম করে। এ ছাড়াও, আমাদের দেহ এবং পরিবেশের পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে কোষীয় কার্যক্রমগুলোর খাপ খাইয়ে নিতে জিনের ক্রিয়াকলাপকেও ক্রমাগত ফাইন টিউন বা সূক্ষ্মভাবে সমন্বয় করতে হয়। অর্থাৎ, দেহের ভেতর ও বাইরের পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কোন জিনটি কাজ করবে আর কোনটি করবে না, তা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়।
যদি জিন নিয়ন্ত্রণ বিকৃত হয়, এটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা অটোইমিউনিটির মতো গুরুতর রোগের সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বোঝা বহু দশক ধরেই বিজ্ঞানীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল। সেই কাজটিই সম্ভব করেছেন ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন।
১৯৬০ এর দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানতেন। তখন একে বলা হত ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। সেসময় বিজ্ঞানীরা দেখেন, কিছু বিশেষায়িত প্রোটিন ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশে যুক্ত হয়ে জেনেটিক তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে নির্ধারণ করে দেয় কোন কোন জিন থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি হবে। এরপর হাজার হাজার ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর আবিষ্কৃত হয়। বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এটিই জিন নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ও মূল উপায়।
১৯৯৩ সালে এসে ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন জিন নিয়ন্ত্রণের এই নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন, যা বিবর্তনজুড়ে প্রাণের বিকাশে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এবং লাখ লাখ বছর ধরে এই প্রক্রিয়া সংরক্ষিত ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
‘অদ্ভুত’ থেকে মৌলিক আবিষ্কার
১৯৮০-এর দশকে এই বৈজ্ঞানিক জুটি গবেষণা করছিলেন কীভাবে বিভিন্ন ধরনের কোষ তৈরি হয়, তা নিয়ে। তাদের গবেষণার বিষয় ছিল সি. এলিগ্যানস (C. elegans) নামের মাত্র ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এক গোলকৃমি। এত ছোট হলেও এই গোলকৃমিতে আছে অনেক ধরনের বিশেষায়িত কোষ, যেমন স্নায়ু ও পেশি কোষ, যা অনেক বড় প্রাণীতেও পাওয়া যায়। এটি বহুকোষী জীবের মধ্যে টিস্যুগুলো কীভাবে বিকশিত এবং পরিপক্ক হয় তার অনুসন্ধানের জন্য এটি একটি দরকারি মডেল।
অ্যামব্রোস এবং রুভকুন যেসব জিন বিভিন্ন জেনেটিক প্রোগ্রামের সক্রিয়করণের সময় নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সময়ে বিভিন্ন ধরনের কোষের বিকাশ নিশ্চিত করে, সেসব জিন নিয়ে কাজ করছিলেন। তারা মিউট্যান্ট স্ট্রেইনের দুটি জিন লিন-৪ (lin-4) ও লিন-১৪ (lin-14) নিয়ে কাজ করছিলেন। লিন-১৪ জিন কোষের বিকাশে জেনেটিক প্রোগ্রামের সক্রিয়করণের সময় নিয়ন্ত্রণে অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। তারা বুঝতে পারেন লিন-৪ জিনটি লিন-১৪ এর কাজে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু সেটা ঠিক কীভাবে হয়, তা বুঝতে পারেননি।
অ্যামব্রোস লিন-৪ জিন নিয়ে আরও কাজ করতে গিয়ে, পদ্ধতিগত ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে জিনটির ক্লোনিং করেন, যা তাকে একটি অপ্রত্যাশিত অনুসন্ধানের দিকে পরিচালিত করে। তিনি দেখতে পান, লিন-৪ জিন থেকে তৈরি হয় একটি ক্ষুদ্র আরএনএ, যার মধ্যে প্রোটিন উৎপাদনের জন্য কোনও কোড নেই। এটিকেই পরে নাম দেওয়া হয় মাইক্রোআরএনএ। তিনি বুঝতে পারেন এই মাইক্রোআরএনএটিই লিন-১৪ এর কাজে বাধা দেয়। কিন্তু তা কীভাবে কাজ করে?
অন্যদিকে গ্যারি রাভকুন লিন-১৪ জিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন, লিন-১৪ জিন থেকে লিন-৪ জিন মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি থামাতে পারে না। বরং লিন-৪-এর প্রভাব পড়ে আরও পরে, জিন এক্সপ্রেশনের সময়, এমআরএনএ থেকে প্রোটিন উৎপাদন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে। আর লিন-১৪ জিনের এমআরএনএতে একটা বিশেষ অংশের উপস্থিতি থাকলেই শুধু লিন-৪ জিন লিন-১৪ জিনের কাজ থামাতে পারে।
অ্যামব্রোস আর রাভকুন তাদের গবেষণার ফলাফল তুলনা করে দেখলেন, লিন-৪ থেকে তৈরি মাইক্রোআরএনএ লিন-১৪ থেকে তৈরি এমআরএনএর বিশেষ অংশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এই যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই লিন-৪ জিন থেকে আসা মাইক্রোআরএনএ লিন-১৪ থেকে আসা মেসেঞ্জার আরএনএর কাজ বন্ধ করে দেয় এবং প্রোটিন উৎপাদনে বাধা দেয়।
অর্থাৎ এখানে জিনের নিয়ন্ত্রণ ট্রান্সক্রিপশন পর্যায়ে হয় না, হয় ট্রান্সক্রিপশনের পরের স্তরে। এর মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত হয় জিন নিয়ন্ত্রণের আরেকটি মৌলিক নীতি। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার তারা ১৯৯৩ সালে সেল জার্নালে দুটি নিবন্ধে প্রকাশ করেন।
কিন্তু তাদের এই আবিষ্কার তখনই খুব একটা সাড়া ফেলেনি। ধারণা করা হচ্ছিল, লিন-৪ আর লিন-১৪ এই জিন দুটি আসলে সি. এলিগ্যানস (C. elegans) এর বিশেষত্ব। এ রকম জিন বা জিন নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়া অন্য কোনো প্রাণীতে নেই। বিজ্ঞানী মহলের সেই ধারণায় পরিবর্তন আসে ২০০০ সালে।
সে সময় রাভকুনের গবেষণা দল লেট-৭ নামের জিন থেকে তৈরি হওয়া নতুন একটি মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করেন। আগে আবিষ্কৃত দুটি জিন শুধু ওই গোলকৃমিতে পাওয়া গেলেও লেট-৭ এর মাইক্রোআরএনএ তেমনটা নয়। নতুন এই মাইক্রোআরএনএ (আর একে কোড করা জিন) প্রাণের অভিযোজনের ধারায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি বছর ধরে ‘সংরক্ষিত’ এবং সব প্রাণীর মধ্যেই এটি পাওয়া যায়।
এই আবিষ্কার নতুন করে মাইক্রোআরএনএ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। এর ফলে মাইক্রোআরএনএ নিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলে এবং হাজার হাজার মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কৃত হয়।
বর্তমানে আমরা জানি, মানুষের জিনোমে এক হাজারেরও বেশি জিন বিভিন্ন মাইক্রোআরএনএ তৈরির নির্দেশনা বহন করে। আর বহুকোষী প্রাণীদের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকায় মাইক্রোআরএনএর ভূমিকা অপরিহার্য।
এরপর বিজ্ঞানীরা মাইক্রোআরএনএ ঠিক কীভাবে উৎপাদিত হয়ে আরেকটি এমআরএনএতে যুক্ত হয়ে এর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাও বের করেন। একটি মাইক্রোআরএনএ একসঙ্গে অনেক জিনের ওপর কাজ করতে পারে। আবার একটি জিনের ওপরও কাজ করতে পারে অনেক মাইক্রোআরএনএ। এর মধ্য দিয়ে তারা পুরো জিন নেটওয়ার্কের মধ্যে সমন্বয় এবং সুক্ষ্মভাবে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে।
পেন্ডলবেরি সিএনএনকে বলেন, তাদের এই আবিষ্কার ক্যান্সার এবং অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে। ক্যান্সার রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় মাইক্রোআরএনএ প্রোফাইলিং ব্যবহার করার জন্য ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে।
ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটির বায়োমেডিকেল সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক জ্যানোশ হেলার বলেন, তাদের এই আবিষ্কার “আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কী বিস্ময়কর যন্ত্রপাতি আমাদের কোষের ঘটে চলা কর্মযজ্ঞ শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন, লাইভ সায়েন্স, নোবেল প্রাইজডটওআরজি