কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইকে আরও সক্ষম করে তোলার পথ বাতলে এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল যিনি ঝুলিতে পুরেছেন, সেই জেফ্রি হিন্টনই মানুষকে সতর্ক করলেন এআই নিয়ে।
নিজের আবিষ্কারের ভবিষ্যৎ ঝুঁকি নিয়ে জেফ্রি হিন্টনই শুধু নয়, তার আগে নোবেলজয়ী আরও বিজ্ঞানী সতর্ক করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাদের শঙ্কা শেষে সত্যও হয়েছিল।
সেই তালিকায় এবার নাম উঠল জেফ্রি হিন্টনের; যিনি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ‘মেশিন লার্নিং’কে বা যন্ত্রকে শেখাতে মৌলিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য জন জে হপফিল্ডের সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থ বিজ্ঞানের নোবেল পাচ্ছেন।
গত ৮ অক্টোবর নাম ঘোষণার পরপরই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে সবাইকে সতর্ক করেন হিন্টন।
তিনি বলেন, “এটাকে (এআই) শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তবে শারীরিক শক্তিতে মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বদলে এটি মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতায় ছাড়িয়ে যাবে। আর আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কারও সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই।”
যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ভবিষ্যৎ দেখছেন অনেকেই, তখন তারই ‘গডফাদার’ হিসাবে খ্যাত হিন্টনের এই সতর্কবার্তা বেশ গুরুত্ববাহী।
কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিন্টন এক সময় গুগলে কাজ করতেন। তবে এআইর সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করে তিনি এই টেক জায়ান্ট কোম্পানি ছেড়েছিলেন।
তবে হিন্টন এটাও মনে করেন যে এআই হতে পারে সমাজবদলের হাতিয়ার, তবে তা ইতিবাচক অর্থে। কারণ এর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বহু গুণ বাড়ানো সম্ভব।
তবুও তার ভয় এআইকে নিয়েই; যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তাকে ছাপিয়ে যায়।
“আমি উদ্বিগ্ন সার্বিক পরিণতি কী দাঁড়ায়, তা ভেবে। যখন সিস্টেম আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তা ধারণ করবে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ন্ত্রণ সে নিয়ে নেবে।”
হিন্টনের আগে নোবেলজয়ী যে বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারের ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছিলেন, দেখে নেওয়া যাক তাদের।
পারমাণবিক অস্ত্র
১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছিলেন ফ্রেডরিখ জুলিও ও আইরিন জুলিও-কুরি। কৃত্রিম তেজষ্ক্রীয় পরমাণু আবিষ্কারের জন্য নোবেল জিতেছিলেন এই দম্পতি। তাদের এই আবিষ্কার চিকিৎসায় বিশেষ করে ক্যান্সারের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই আবিষ্কারই তৈরি করে দেয় পারমাণবিক বোমা তৈরির পথ।
পুরস্কার জয়ের পরপরই জুলিও সতর্ক করে বলেছিলেন, তার আবিষ্কার থেকে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা বিস্ফোরক ধরনের কিছু বানিয়ে ফেলবে।
তার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভার এখন বিশ্বকে অস্তিত্বের হুমকির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯৪৫ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন আর্নস্ট চেইন ও অ্যাডওয়ার্ড ফ্লোরের সঙ্গে যৌথভাবে। পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য তারা সেবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, যা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষের কার্যকর অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
ফ্লেমিং তখন বলেছিলেন, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধক ল্যাবরেটরিতে তৈরি করার কোনও বিষয়ই না। সামনে সময় আসবে যথন দোকান থেকে যে কেউ পেনিসিলিন কিনতে পারবে।
আর তখনই যে বিপদ হবে, সেই সতর্কবার্তা দিয়ে এই বিজ্ঞানী বলেছিলেন, হয়ত দেখা যাবে কেউ কেউ প্রয়োজনীয় মাত্রায় পেনিসিলিন নিচ্ছে না, কম শক্তির সেই ডোজের কারণে তখন ব্যাকটেরিয়া উল্টো প্রতিষেধক প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে।
ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠা এখন বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপ্রয়োজনে অ্যান্টবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধে এখন জোর দিচ্ছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
কৃত্রিম ডিএনএ
কৃত্রিম ডিএনএ উদ্ভাবনের জন্য ১৯৮০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন পল বার্গ। তার আবিষ্কার জিন প্রযুক্তির গবেষণায় এনে দিয়েছিল গতি। তবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ভবিষ্যতে কোন দিকে বিশ্বকে নিয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কার কথাও বলেছিলেন তিনি।
জিন থেরাপি হল চিকিৎসার একটি পদ্ধতি, যেখানে একটি রোগ সৃষ্টিকারী ত্রুটিপূর্ণ জিনকে একটি স্বাভাবিকভাবে কার্যকর জিন দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।
১৯৮০ সালের নোবেল বক্তৃতায় বার্গ জিন থেরাপির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেছিলেন, এই পদ্ধতির অনেক জটিলতা এবং অজানা দিক রয়েছে।
“আমার মনে হয়, যদি আমরা কখনও এই দিকে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের মানব জিনগুলো কীভাবে বিন্যস্ত হয় এবং কীভাবে তারা কাজ করে এবং নিয়ন্ত্রিত হয়, সে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন।”
জিন প্রযুক্তির ব্যবহার এখন বিস্তৃত হয়েছে। মানুষ এখন উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানবদেহে নিজেদের জিনে পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে। সেই সঙ্গে এর নৈতিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জিন এডিটিং
চার বছর আগে রসায়নের নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছিলেন জেনিফার ডাওনা ও এমানুয়েল শার্পেন্টিয়ার। জিন পুনর্বিন্যাসের কৌশল আবিষ্কারের জন্য তাদের নোবেল দেওয়া হয়েছিল। তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে বলা হয় ক্রিসপার-ক্যাশ৯।
নোবেল ভাষণে ডাওনা বলেছিলেন, তাদের আবিষ্কার প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। জনস্বাস্থ্য, কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
তবে তিনি মানব বীজ কোষে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। মানবের জিনগত পরিবর্তনের নৈতিকতা নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এর অপব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতিও ঘটতে পারে।
মানব ভ্রূণে জিনগত পরিবর্তন এনে অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়ে চীনের বিজ্ঞানী হি জিএনকুইকে কারাগারেও যেতে হয়েছে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন