Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

কলাম

রাজনীতিমুক্ত নয়, রাজনীতি সবার জন্য উন্মুক্ত হোক

এ কে এম খাদেমুল হক। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

এই শতকের গোড়ার দিকে মুক্তি পাওয়া জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘নায়ক’-এ মুখ্যমন্ত্রীর পিএস-এর কণ্ঠে একটা সংলাপ আছে, নায়ক যখন নিজেকে ছাপোষা সাধারণ মানুষ, রাজনীতির পাঁকে জড়াতে চান না বলে মন্তব্য করেন, তখন হতাশ কণ্ঠে পিএস বলেন—‘‘সবাই শুধু রাজনীতিবিদদের গালি দিতে পছন্দ করে আর রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকতে চায়। কিন্তু ভালো মানুষরা যদি দূরে থাকে, তাহলে তো খারাপ মানুষরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, এটাই তো স্বাভাবিক!’’

গত কয়েক দিনে রাজনীতি থাকা না থাকা নিয়ে উত্তাল বুয়েট ক্যাম্পাস আর নেটিজেনদের মন্তব্য পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল সেই সংলাপটা। বুয়েটে বাংলাদেশের সেরা মেধাবীরা পড়েন, তাদের রাজনীতির কুচক্র থেকে দূরে রাখাই দরকার, এমন একটা আবহ দেখতে পাচ্ছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে। অনেকেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দিচ্ছেন, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নাকি সব রাজনীতিমুক্ত!

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-হার্ভার্ড এমনকি পাশের দেশ ভারতের জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের প্রায় সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অবশ্যম্ভাবী এক অনুসঙ্গ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা ছাত্র সংসদ। সেখানে প্রত্যেক ছাত্রের অধিকার আছে নিজের রাজনৈতিক মত প্রকাশের, দরকার হলে নিজেদের মতো করে সংগঠন তৈরি করে সেই মতের পক্ষে প্রচারণা চালানোর।

আসলেই কি তাই? বাস্তবতা কিন্তু মোটেই তা বলে না। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-হার্ভার্ড এমনকি পাশের দেশ ভারতের জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের প্রায় সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অবশ্যম্ভাবী এক অনুসঙ্গ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা ছাত্র সংসদ। সেখানে প্রত্যেক ছাত্রের অধিকার আছে নিজের রাজনৈতিক মত প্রকাশের, দরকার হলে নিজেদের মতো করে সংগঠন তৈরি করে সেই মতের পক্ষে প্রচারণা চালানোর। এই সংগঠনগুলো কি কেবলই ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রচারণা চালায়? তা-ও কিন্তু নয়। আজকে যাঁরা বুয়েটকে রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষে প্রবলভাবে সোচ্চার, তাদের অনেকেরই নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে গত কয়েকমাসের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলনের খবর মুগ্ধতার সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে। সে আন্দোলনের সঙ্গে তো শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ‘স্বার্থ’ সেভাবে জড়িত নয়!

আসলে স্বার্থ ঠিকই জড়িয়ে আছে—সে স্বার্থটা বিবেকের, মানবিকতার। যে মানুষটা সত্যিকারের শিক্ষা অর্জন করছেন, তার তো মানুষ হয়ে ওঠার দায় আছে! সেই দায় থেকেই ন্যায়ের পক্ষে, মানবতার পক্ষে প্রচারণা চালানোটা তার স্বার্থ; কারণ রাজনীতিকে নোংরা বিবেচনা করে এর পাঁক থেকে বিবেকবানরা যদি নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন, তাহলে এক সময় অন্যায়টাই প্রতিষ্ঠিত হবে আর সেদিন হয়ত আজকের ফিলিস্তিনিদের মতো করে ওই শিক্ষার্থী কিংবা তার কোনও নিকটজনকেও সেই অন্যায়ের শিকার হতে হবে।

বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তো কথাটা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। এ দেশ তো সে-ই দেশ, যেখানে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সব ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা এদেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তান; সবচেয়ে সুবিধাভোগীও বটে। এদেশের সাধারণ মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত টাকায় দেশের সেরা মানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় তারা, সে সুযোগ তো সবাই পায় না। এই শিক্ষার্থীদের ‘রাজনীতির পঙ্কিল জগৎ’ থেকে একদম দূরে সরিয়ে রাখার যুক্তিটা আমার কাছে কখনোই জোরালো মনে হয় না।

তাছাড়া, বুয়েট কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতিমুক্ত ছিল না। ২০১৯ সালে একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার সূত্র ধরে এই প্রতিষ্ঠানটিতে সাময়িকভাবে ‘রাজনীতি নিষিদ্ধ’ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ওই ঘটনার বিচার হয়েছে; আদালতের মাধ্যমে ঘটনাটির নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু এই রাজনীতিহীনতার আগে-পরে বুয়েটের শিক্ষার মানে আকাশ-পাতাল কোনও পার্থক্য তৈরি হয়েছে, বিষয়টি কিন্তু এমনও নয়। আগেও বুয়েট দেশসেরা ছিল, এখনও আছে।

বুয়েটের আবরার একা নয়, সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এই পঙ্কিল রাজনীতির শিকার; গেস্ট রুম, গণরুম আর সহমতভাই সংস্কৃতির সামনে তারা অসহায়। সরকার সমর্থক রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের এই দুর্বিনীত আচরণের নেপথ্যে আছে ক্ষমতার দাপট, প্রশাসনের নীরব পৃষ্ঠপোষকতা। ছাত্র-রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সবার আগে এই নীরব পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা জরুরি; জরুরি সকলের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা করা।

তাহলে গলদটা কোথায়? যে বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পথ ধরে, সেই বাংলাদেশে কেন আজ এমন বিপুল সংখ্যক মানুষ বুয়েটসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ রাখার পক্ষে সোচ্চার? বাস্তবতা হলো, আজ ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে কর্মকাণ্ড চলছে, তার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে রাজনীতির সেই ‘পঙ্কিলতা’। বুয়েটের আবরার একা নয়, সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এই পঙ্কিল রাজনীতির শিকার; গেস্ট রুম, গণরুম আর সহমতভাই সংস্কৃতির সামনে তারা অসহায়। সরকার সমর্থক রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের এই দুর্বিনীত আচরণের নেপথ্যে আছে ক্ষমতার দাপট, প্রশাসনের নীরব পৃষ্ঠপোষকতা। ছাত্র-রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সবার আগে এই নীরব পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা জরুরি; জরুরি সকলের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা করা।

সেটা করার দুটি উপায়। এক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন সকলের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা, প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আর দ্বিতীয়টি হলো, শিক্ষার্থীদের নিজেদের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সরকার সমর্থক সংগঠনের কর্মীদের নিপীড়নমূলক আচরণ কিন্তু নতুন কিছু নয়, সেই পাকিস্তান আমলেও ‘এনএসএফ-এর গুণ্ডমী’ কুখ্যাত ছিল। তাদের প্রতি তখনকার প্রশাসনেরও কি পক্ষপাত ছিল না? ছিল। তারপরও এনএসএফ ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেনি তখনকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতিসচেতন শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের সুযোগ ছিল বলে। সেই সুযোগটা আর কিছু নয়, ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ব্যবস্থা।

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-হার্ভার্ডের মতো রাজনীতির পরিবেশ যদি সত্যিই চাই আমরা, তাহলে নিয়মিত জবাবদিহিমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কোনও বিকল্প নেই। কারণ, বাস্তবতা হলো এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘রাজনীতি নিষিদ্ধ’ করাটাও আসলে এক ধরনের পক্ষপাত। কেননা এ রকম পরিস্থিতিতে মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকলেও ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো তখন বিশেষ সুবিধা পায়। মসজিদকে কেন্দ্র করে তাদের গোপন কর্মকাণ্ড ঠিকই চলতে থাকে। রাজনীতিহীনতার চার বছরে বুয়েটে যেভাবে নিরবে-নিভৃতে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তারা, সে সুযোগ অন্য সংগঠনগুলো পায়নি।

দেশের সেরা মেধাবীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখলেই (আসলে অন্তরালে থেকে তাদের ধর্মীয় রাজনীতিতে দীক্ষিত করার সুযোগ অবারিত রাখলেই) বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘বিশ্বমানে’র হয়ে উঠবে, এ বয়ান যে অনেক দিন ধরেই এদেশবাসীকে গেলানো হচ্ছে, আর সেই বয়ানকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর অবিমৃশ্যকারিতা।

দেশের সেরা মেধাবীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখলেই (আসলে অন্তরালে থেকে তাদের ধর্মীয় রাজনীতিতে দীক্ষিত করার সুযোগ অবারিত রাখলেই) বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘বিশ্বমানে’র হয়ে উঠবে, এ বয়ান যে অনেক দিন ধরেই এদেশবাসীকে গেলানো হচ্ছে, আর সেই বয়ানকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর অবিমৃশ্যকারিতা।

আসলে, প্রকৌশলবিদ্যা শিখতে এসে কেউ যদি ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছায়াছবির প্রিন্সিপালের দর্শনে বিশ্বসী হয়ে রেসের ঘোড়া হয়ে উঠতে চায় তার যেমন রাজনীতি বিমুখ থাকার স্বাধীনতা থাকা উচিৎ, তেমনি কেউ যদি চায় প্রকৌশলবিদ্যা শেখার পাশাপাশি মানবতার প্রতি নিজের দায়ভারটাও কাঁধে নিতে; দরকার হলে সরকারের অপরিণামদর্শী শিক্ষানীতি বা পরিবেশবিরোধী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে চায়; কিংবা চায় ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি ইসরায়েলিদের আগ্রাসনের প্রতিবাদ করতে, তার কেন সেই অধিকারটা থাকবে না?

এমন সব অধিকার খর্ব করে, মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করার দাবিটাও তো আসলে গণরুম থেকে জোর করে ধরে মিছিলে নিয়ে যাওয়ারই সমান অপরাধ! এর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিবিমুখতার কল্প-গল্প প্রচার না করে বরং দাবি তোলা দরকার, রাজনীতিটা উন্মুক্ত হোক, সবার জন্য সমান সুযোগ থাকুক, আর শিক্ষার্থীদের সামনে থাকুক তাদের নিজেদের প্রতিনিধিত্ব কারা করবেন সেটা বেছে নেওয়ার সত্যিকারের সুযোগ।

একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন, বিশ্বজুড়ে এটাই রীতি!

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: khademulhaque@du.ac.bd

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত