Beta
রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫

গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনে তেল পরিবহনে কী লাভ

গভির সমুদ্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল পরিবহন ও খালাস শুরু করেছে বাংলাদেশ।
এসপিএম প্রকল্পের প্রতীকী নকশা।
[publishpress_authors_box]

পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহন ও খালাসের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এতে সময় সাশ্রয় হচ্ছে, পরিবহন খরচ কম লাগছে এবং তেল খালাসও নিরবচ্ছিন্ন থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশে যে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়, তার সিংহভাগই আসে সমুদ্রপথে জাহাজে। বাকিটা আসে ভারত থেকে পাইপলাইনে ও ট্রেনে। সাগরপথে বড় ট্যাংকারে আসে লাখ টন তেল। নাব্য সংকট ও অন্য সীমাবদ্ধতার কারণে সেই ট্যাংকার সাগর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না।

এখন তেলবাহী বড় ট্যাংকার নোঙর করছে কেবল কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়ায় গভীর সাগরে। সেখানে করা হয়েছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বা বয়া। সেখান থেকে পাইপলাইনে বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ৬০ হাজার টন ডিজেল চট্টগ্রামে পৌঁছবে, এক্ষেত্রে সময় লাগবে ১৭ ঘণ্টা। এর মধ্য দিয়ে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটির কার্যক্রম স্বার্থকতা পেতে যাচ্ছে।

বঙ্গপোসাগরে মহেশখালীর এসপিএম থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি পাইপলাইন। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। এখানে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ সরকার ও চীনের এক্সিম ব্যাংক।

পাইপলাইনের পুরোটাই সাগরের তলদেশে স্থাপিত নয়। ১৬ কিলোমিটার উপকূলে ও ৯৪ কিলোমিটার পাইপলাইন সাগরের তলদেশে স্থাপিত। এসপিএম থেকে পূর্ব দিকে মহেশখালীর কালামারছড়া ট্যাংক টার্মিনাল পর্যন্ত উপকূলের ১৬ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপিত।

এর আগে ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সাগর থেকে মহেশখালী স্টোরেজে টার্মিনালে পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল সরবরাহ শুরু হলে ক্রটি ধরা পড়ে। কয়েকমাস ধরে ক্রটি দূর করতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সফলতার পর নতুন করে ডিজেল সরবরাহ শুরু হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার একটি পাইপলাইন দিয়ে হবে ডিজেল সরবরাহ। পাশাপাশি স্থাপিত আরেকটি পাইপলাইন দিয়ে আগামী সপ্তাহে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হবে। এরমধ্য দিয়ে পুরোদমে জ্বালানি তেল খালাস শুরু হবে পাইপলাইনের মাধ্যমে। 

মহেশখালীর এসপিএমে নোঙর করা জাহাজ

২০২৩ সালে সরকার বিপিসির মাধ্যমে সাড়ে ৫৪ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানির অনুমোদন দেয়। পুরোটাই আমদানি হয় সমুদ্রপথে জাহাজে। তেলবাহী বড় ট্যাংকার জাহাজ প্রথমে মহেশখালীর গভীর সাগরে নোঙর করতো। এরপর ছোট ট্যাংকার জাহাজে করে লাইটারিং বা তেল স্থানান্তর করে আনা হতো চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ও বিপিসির ঘাটে। সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকা গুদামে নেওয়া হতো পাইপলাইনে।

এখন মহেশখালীর স্টোরেজ থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে থাকা পাইপলাইনে সরাসরিই পতেঙ্গার স্টোরেজে পৌঁছবে জ্বালানি তেল।

কর্তৃপক্ষ বলছে, পাইপলাইনে তেল খালাসে তিনটি বড় সুবিধা মিলবে। প্রথমটি হচ্ছে, সময় সাশ্রয়ী, দ্বিতীয়টি পরিবহন খরচ ও অপচয় কম, এবং তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগে তেল খালাস নিরবচ্ছিন্ন থাকা।

কেন এই পাইপলাইন

বাংলাদেশে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল আনা হয় বড় ট্যাংকারে, যেখানে এক লাখ টন তেল থাকে। সেই ট্যাংকার নোঙর করে কেবল মহেশখালীর গভীর সাগরে। নাব্য সংকট ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সাগর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে ইস্টার্ন রিফাইনারি, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার তেল মজুদাগার আছে। মজুদাগারের পাশেই আছে ছোট জাহাজ ভেড়ানোর ঘাট। ফলে বড় ট্যাংকার থেকে জ্বালানি তেল স্থানান্তর করে ছোট ছোট জাহাজে তেল মজুদাগারে নেওয়া হয়। এতে সময় বেশি লাগে, পরিবহন খরচ বেশি হয়, তেল পরিবহনে অপচয় হয়, হয় চুরিও।

এই অবস্থার উত্তরণে ২০১৫ সালে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প নেয় বিপিসি। চার দফা প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর পর এর ব্যয় দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। আর কাজ শেষ হবে চলতি বছরের জুনে।

বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে (জিটুজি) চুক্তির ভিত্তিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র দুই দিনে প্রায় এক লাখ টন জ্বালানি তেল খালাসের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

প্রকল্পটির কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলে বঙ্গোপসাগরের বহির্নোঙর থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহন কমে যাবে। এতে করে প্রতিবছর সাশ্রয় হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীর পশ্চিমে সাগরে স্থাপিত হয়েছে একটি ভাসমান মুরিং বা বয়া। ট্যাংকারটি এলে তার সঙ্গে মুরিংয়ের সংযোগ ঘটানো হবে। এরপর মুরিং থেকে জ্বালানি তেল যাবে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথক দুটি পাইপলাইনে মহেশখালীর কালামারছড়ায় তেল রাখার স্টোরেজে। যেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে অপরিশোধিত তেল থাকবে ১ লাখ ২৫ হাজার টন, বাকি ৭৫ হাজার টন থাকবে ডিজেল।

এই স্টোরেজ থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পর্যন্ত সাগরের তলদেশে স্থাপিত হয়েছে ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাশাপাশি থাকা দুটি পৃথক পাইপলাইন। একটিতে পরিবহন হবে ডিজেল, আরেকটিতে অপরিশোধিত বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল।

প্রকল্পটির পরিচালক শরীফ হাসনাত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মহেশখালীর স্টোরেজ টর্মিনাল থেকে পাম্প করে ৬০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি স্টোরেজে পাঠাতে সময় লাগবে প্রায় ১৭ ঘণ্টা।

“প্রথমবার আমরা এই ডিজেল পাঠাচ্ছি। ধীরে ধীরে আমরা চাপ বাড়িয়ে একই পরিমাণ তেল সেখানে ১২ ঘণ্টায় পৌঁছাব। এতে সিস্টেম লস কমবে, সময়-অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমরা বড় ট্যাংকার সরাসরি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে নোঙর করাতে পারব।”

“আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমরা জ্বালানি তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পারব। কারণ ২ লাখ টন জ্বালানি তেল তো মহেশখালী স্টোরেজে রাখতে পারব। এতে আমাদের মজুদ সক্ষমতা বেড়ে যাবে” যোগ করেন তিনি।

মহেশখালীর এসপিএম প্রকল্প

৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয়

কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জ্বালানি তেল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পৌঁছানো পর্যন্ত দায়িত্ব সরবরাহকারীর। মহেশখালীতে আসা পর্যন্ত তারাই দায়িত্ব পালন করতো। এরপর চট্টগ্রাম পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের প্রতিনিধি বা ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতো বিপিসি। এই ম্যানুয়াল সিস্টেমে কাজ করতে গিয়ে বিপুল ‘সিস্টেম লস’ হতো।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) কেউ সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমদানিকৃত জ্বালানি তেল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারির জেটি পর্যন্ত প্রতিটন ডিজেল পরিবহনে খরচ হতো ৬৪ টাকা ৪০ পয়সা। আর ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ট্যাংকারে করে জ্বালানি তেল খালাস করতে ২০টি ছোট ট্যাংকারের জাহাজ প্রয়োজন হতো। এই পরিমাণ তেল খালাস করতে স্বাভাবিক সময় লাগতো ৭-৮দিন। এখন সেটি আর লাগবে না।”

ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ লোকমান বলেন, সব জ্বালানি তেল প্রথমেই আসে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে। এরপর সরকারি বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যুমনার মাধ্যমে পরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। আর অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরাসরি ইস্টার্ন রিফাইনারির কারখানায় নিয়ে পরিশোধন শেষে ১৪ ধরনের তেলের উপজাত তৈরি করা হয়। এরমধ্যে পেট্রোল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল, জুট ফুয়েল অন্যতম। সেগুলো বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে বিক্রি করে বিপিসি।

তিনি বলেন, “৬০ হাজার টন ডিজেল সরাসরি চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগবে ১৭ ঘণ্টা। ভবিষ্যতে সেই সময় আরও কমে আসবে। আগে লাগতো ন্যূনতম সাত দিন। পাইপলাইন স্থাপনের স্টাডিতে বলা আছে, বছরে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয় তা সনাতন পদ্ধতির বদলে পাইপলাইনে করা গেলে বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।”

দেশের বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির অনুমোদন পেয়েছে। তারা বিদ্যমান সনাতন পদ্ধতিতে তেল এনে নিজেদের কারখানায় নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করছে। তাদের এই পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ।

ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ লোকমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পাইপলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে জ্বালানি তেল পরিবহনের সুফল পৌঁছাতে একটি প্রকল্প চলমান আছে। এই প্রকল্পের অধীন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ২৩৭ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পৌঁছানো হবে ঢাকায়।

“এছাড়া কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত একই প্রকল্পের আতায় ৫৯ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। সেই প্রকল্প শেষ হলে মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি তেল পৌঁছানো সম্ভব হবে।”

দেশে পাইপলাইনে তেল পরিবহনের যেভাবে যাত্রা

পাইপলাইনের মাধ্যেম তেল আমদানির যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করে ২০২৩ সালে। সেই বছরের ১৯ মার্চ উদ্বোধন হয় ‘ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী পাইপলাইন’।

সেই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমবার ভারতের নুমালিগড় থেকে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল আমদানি শুরু হয় বাংলাদেশে। ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনের মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ১২৬ কিলোমিটার এবং বাকি ৫ কিলোমিটার ভারতের নুমালিগড়ে অবস্থিত।

পাইপলাইনের মাধ্যমে আসা এই ডিজেল দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এখন সরবরাহ করা হচ্ছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ১৫ বছর ভারত থেকে ডিজেল আমদানি করবে বিপিসি।

এর মধ্যে প্রথম তিন বছর দুই লাখ টন, পরবর্তী তিন বছর তিন লাখ টন, তার পরবর্তী চার বছর পাঁচ লাখ টন এবং শেষ পাঁচ বছর ১০ লাখ টন তেল আমদানি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত