Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫

বাস্তব জীবনে ‘স্পাই’ হিসেবে কাজ করেছিলেন এই অস্কারজয়ী নায়িকা

audrey hepbarn
[publishpress_authors_box]

প্রেমের অমর চলচ্চিত্র রোমান হলিডে। চলচ্চিত্রটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ইউরোপের এক দেশের তরুণী রাজকুমারী, অ্যানকে ঘিরে। রাজকীয় দায়িত্ব ও কঠোর নিয়মে ক্লান্ত অ্যান একদিন রোম সফরের সময় পালিয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মতো স্বাধীনতা উপভোগের জন্য শহরের রাস্তায় ঘোরাঘুরি শুরু করে।

এই সময় সাংবাদিক জো ব্র্যাডলি (গ্রেগরি পেক) এর সঙ্গে পরিচিত হয়। জো প্রথমে বুঝতে পারে না যে অ্যান একজন রাজকুমারী। কিন্তু সে যখন জানতে পারে, তখন তিনি সেই সুযোগটি একটি ফিচার স্টোরি লেখার জন্য কাজে লাগাতে চায়। তবে, অ্যান এবং জো একসঙ্গে রোমের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করতে করতে একে অন্যের প্রেমে পড়ে যায়।

ফিল্মটির সমাপ্তি ছিল হৃদয়ছোঁয়া– অ্যান তার রাজকীয় দায়িত্বে ফিরে যান এবং জো বুঝতে পারে যে তার প্রেম ও পেশাগত নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

মনোমুগ্ধকর এই চলচ্চিত্রে যে অভিনেত্রী রাজকুমারী অ্যান- এর চরিত্রে অভিনয় করেন, সেই অড্রে হেপবার্নই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় করেছেন ‘স্পাই’ এর কাজ। আর তার এই গোয়েন্দা বার্তা আদান-প্রদানটি ছিল নাৎসি বাহিনীর বিপক্ষে ডাচ প্রতিরোধকারীদের পক্ষে।

কৈশোরে অস্কারজয়ী অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন এর কেটেছে নেদারল্যান্ডসে। তখনই তিনি গোয়েন্দাগিরির কাজটি করেছিলেন।

বিবিসি রেডিও ফোর এর পডকাস্ট হিস্টোরি’স ইয়াংগেস্ট হিরোস-এ নিকোলা কাফলান বিদ্রোহ, ঝুঁকি এবং যুবশক্তির চমৎকার গল্পগুলো তুলে ধরেন। এই পডকাস্টে ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবশালী তারুণ্যের গল্প শোনা যায়। এসব তরুণরা বিশ্বের ইতিহাসে বাঁকবদলে রেখেছেন সাহসী ভূমিকা।

এ পডকাস্ট সিরিজের সাম্প্রতিক পর্বে অড্রে হেপবার্নের গল্প উঠে আসে, যিনি ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে চলচ্চিত্র ও ফ্যাশন আইকন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি পাঁচটি অস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং ১৯৫৩ সালে রোমান হলিডে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, কিশোরী অবস্থায়, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন—গোপন ব্যালে প্রদর্শনীর মাধ্যমে ডাচ প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।

১৯২৯ সালে ব্রাসেলসে এক ডাচ ব্যারোনেস এলা ফন হিমস্ট্রা এবং ব্রিটিশ-অস্ট্রিয়ান ব্যবসায়ী জোসেফ হেপবার্ন-রাস্টনের ঘরে জন্ম নেন অভিনেত্রী হেপবার্ন। লন্ডনে তার বাবা-মা ওসওয়াল্ড মোজলির ফ্যাসিবাদী সংগঠন ব্রিটিশ ইউনিয়ন অব ফ্যাসিস্টস (বিইউএফ)-এর প্রতি আকৃষ্ট হন। ফন হিমস্ট্রা নাৎসি জার্মানির ‘গৌরব’ নিয়ে বিইউএফ-এর ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ লেখেন। অড্রে হেপবার্ন এর বয়স যখন ছয় তখন তার বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান এবং তখনই তিনি ‘বিদেশি ফ্যাসিবাদীদের সহযোগী’ হিসেবে গ্রেপ্তার হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ব্রিটিশ কারাগারেই বন্দি ছিলেন।

“ছোটবেলাতেই তিনি খুব প্রাণবন্ত ছিলেন—হাসতেন, খেলতেন, অভিনয় করতেন। আমার নানা তাকে ডাকতেন ‘মানকি পাজল’,”  বলেছেন লুকা দোত্তি, হেপবার্নের ছোট ছেলে।

তিনি রবার্ট ম্যাটজেনকে এই মন্তব্য করেন, যিনি তার ডাচ গার্ল বইতে হেপবার্নের যুদ্ধকালীন জীবন তুলে ধরেছেন।

“অড্রের মা ভাবতেন, ইংল্যান্ড এবং বিশেষত কেন্ট, তার মেয়ের জন্য নিরাপদ নয়, কারণ জার্মান বাহিনী ফ্রান্স অতিক্রম করে ইংল্যান্ড আক্রমণ করতে পারে,” বলেছেন ম্যাটজেন।

হেপবার্নকে ব্রিটিশ বোর্ডিং স্কুল থেকে সরিয়ে, তার মা নেদারল্যান্ডসে পারিবারিক বাসস্থানে নিয়ে যান। সেখানে তিনি একটি নাচের স্কুলে ভর্তি হন এবং ডাচ ভাষার নাম ‘অ্যাড্রিয়ান্তজি ভ্যান হিমস্ট্রা’ নেন (অভিনয়ে যোগ দেওয়ার পর তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে হেপবার্ন রাখেন)। হেপবার্নের মা তখনো অ্যাডলফ হিটলারকে প্রশংসা করতেন এবং বিশ্বাস করতেন না যে তিনি ‘তার’ দেশ আক্রমণ করবেন।

“হল্যান্ডে যাওয়া মানে বাড়ি যাওয়া ছিল না। তিনি ডাচ ভাষা জানতেন না। তাকে এমন একটি স্কুলে যেতে হয়েছিল যেখানে কেউ তাঁর ভাষা বুঝত না এবং তাকে নিয়ে মজা করত,”  বলেছেন দোত্তি।

১৯৪০ সালের মে মাসে হিটলার নেদারল্যান্ডস আক্রমণ করে। “পূর্ব ফ্রন্ট ছিল এক ধরনের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো। জার্মান বাহিনী খাদ্য ও পোশাকের চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে, ডাচ এবং অন্যান্য দখলীকৃত দেশ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া হতো,” বলেছেন ম্যাটজেন।

হেপবার্নের চাচা কাউন্ট অটো ভ্যান লিম্বার্গ স্টিরুম নাৎসিদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। ১৯৪২ সালে রটারডামের কাছে একটি জার্মান ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায় একটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী। ওই ঘটনায় স্টিরুম জড়িত ছিলেন না থাকলেও তাকে কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাদের কবর আর শনাক্ত করা যায়নি। হেপবার্নের জন্য তার চাচা ছিলেন পিতৃতুল্য এবং তার এই মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করে।

হেপবার্ন পরিবার অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও নাৎসিরা খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদ কেড়ে নেওয়ায় কারণে তারা অভুক্ত থেকেছেন। ১৫ বছর বয়সে হেপবার্নকে নাৎসি শিল্পী সংগঠনে যোগ দিতে বলা হয়, না হলে তিনি প্রকাশ্যে নাচতে পারবেন না। তিনি নাচ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

“নাচের মাধ্যমে তিনি স্বপ্ন দেখতে পারতেন, উড়তে পারতেন, বাস্তবতাকে ভুলে থাকতে পারতেন। এটাই ছিল তার পালানোর উপায়,” বলেছেন দোত্তি। হেপবার্ন একটি নিরাপদ বাড়িতে, জানালা বন্ধ করে, একটি মোমবাতির আলোয় নাচতেন। পিয়ানো বাজত খুব ধীর স্বরে এবং করতালির অনুমতি ছিল না। প্রদর্শনী শেষে প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হতো।

১৯৪৪ সালের বসন্তে  হেপবার্ন একজন চিকিৎসক হেনড্রিক ভিসার টি হুফ্ট এর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। হুফ্ট ডাচ প্রতিরোধ আন্দোলনের সদস্য ছিলেন। তিনি নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে হাজার হাজার লুকিয়ে থাকা মানুষকে সাহায্য করতেন। হেপবার্নের মা নাৎসি সহযোগী হিসেবে পরিচিত হলেও, ভিসার ‘টি হুফ্ট তার প্রতি বিশ্বাস রাখেন।

১৯৪৪-সালের ১৭ সেপ্টেম্বর  হেপবার্ন তখন চার্চে ছিলেন। সেখানে কানাঘুষা শুনে শুনে বাইরে এসে দেখেন আকাশে প্যারাসুটে ভেসে আসছে মিত্র বাহিনীর সদস্যরা। অপারেশন মার্কেট গার্ডেন শুরু হয়েছিল।

কিন্তু দুইটি ভারী সশস্ত্র নাৎসি ডিভিশন তখন ওই এলাকায় অবস্থান করছিল। হেপবার্নের পরিবার ৯ দিন সেলার বা বেসমেন্টে লুকিয়ে ছিল। যুদ্ধ শেষে উঠে এসে তারা জানতে পারে, নাৎসিরা জয়লাভ করেছে।

হেপবার্ন পরবর্তীকালে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেন এবং বিভিন্ন প্রতিরোধ অভিযানে অংশ নেন। “ভালো এবং মন্দের মধ্যে চিরকালীন এক সংগ্রাম রয়েছে, এবং আপনাকে অবশ্যই একটি দিক বেছে নিতে হবে,” বলেছেন দোত্তি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত