একেক ছুটিতে একেক জায়গায় ঘুরতে গিয়ে সোশাল মিডিয়াতে চেক-ইন আর ’ট্রাভেল ভ্লগ’ দেয়ার নেশা যত বাড়ছে, পর্যটন ততই জমজমাট হয়ে উঠছে। চট জলদি ভিসার সুবিধা, থাকা-খাওয়া-ঘোরার ইকোনমি প্যাকেজ এবং আসা-যাওয়াতে উড়োজাহাজ ছাড়াও বাস-ট্রেন যোগ হওয়াতে কাছে থেকে দূরের জায়গায় বাড়ছে ভিড়।
এই ভিড়ে কেন এলাম
একজন ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সার ভুবনী ধরন এরমধ্যে ৫১টিরও বেশি দেশে ঘুরে এসেছেন। একবার এক পয়সাও খরচ না করে অর্থ্যাৎ ‘ব্র্যান্ড ট্রিপ’ পেয়ে বালিতে পা রাখলেন ভুবনী ধরন। নিজের কাজের জন্য ভ্রমণপ্রিয় ভুবনী ধরন ভিড়ভাট্টা নেই জায়গাতে যেতেই ভালোবাসেন।
কিন্তু তিন মাস আগে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ বালিতে ঘুরতে গিয়ে হোঁচট খেলেন তিনি। বালি মানে ছুটি কাটানোর এমন এক জায়গা যেখানে বিশ্রাম ও বিনোদন মিলিয়ে শরীর ও মনের ভারমুক্তি হবে। কিন্তু বালির থেকে ফিরতি পথে ভুবনী ধরনের মনে হয়েছে, এবার তো নিরিবিলিতে সময় কাটানো আর আরাম করাই হলো না।
“বালিতে লোকে গিজগিজ করছিল। চারিদিকে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল, পর্যটক ধরার জন্যই এতো আয়োজন; এখানে প্রকৃত সংস্কৃতি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। এই জায়গায় এখন প্রশান্তিতে বিশ্রাম করার কোনো সুযোগ নেই”, বললেন তিনি।
হিমাচল প্রদেশের জনপদ কসোল এবং মানালি ঘুরতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। দুটো জায়গা নিয়ে কথা বেশি হয় বলে এখানে এখন সবসময় লোকে লোকারণ্য।
কসোল ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে ইন্ডিয়া টুডের কাছে ভুবনী বলেন, “ওইখানে এতো যানজটে পড়তে হবে তা ভাবিনি।
“এতোটাই বাজে অবস্থা যে ঠিক সময়ে পৌঁছানো একেবারে দুস্কর।”
উপরন্তু ভিড়ের কারণে এই জায়গার মনোরম আবহ এতটাই বিগড়ে গেছে যে পৌঁছানোর পরও মনের স্বস্তি খুঁজে পাওয়া ভার।
পর্যটক বাড়লে পর্যটন ঘুড়ে দাঁড়াবে এবং তাতে অর্থনীতিও সবল হবে ভাবা হলেও ভুবনীর মনে গভীর শঙ্কা থেকে একটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে বারবার; পর্যটকের বাড়বাড়ন্ত কি খোদ পর্যটনের সৌন্দর্য লুটে নিচ্ছে?
পর্যটকের চাপে পর্যটন
২০১৬ সালে অর্থ্যাৎ করোনাভাইরাস মহামারী দেখা দেয়ার আগে ‘ওভার টুরিজম’ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। কোনো নির্দিষ্ট দর্শনীয় স্থানে অনেক লোকের সমাগম দেখা যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ওভার টুরিজম বা ভিড়ে ভারাক্রান্ত পর্যটনের প্রসঙ্গ উঠে আসে।
আর পর্যটনের বাস্তবতা এমন হলে পরিবেশ, স্থানীয় জনজীবন এবং পর্যটকদের অভিজ্ঞতাও হুমকির মুখে পড়ে।
মহামারীর সময় বিশ্বজুড়ে চলার লকডাউনের প্রভাবে সবকিছুই স্থবির হয়ে পড়েছিল। আর্থিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল পর্যটন খাত। এরপর চলাফেরা, যানবাহন আবার সচল হতেই মানুষ আগের চেয়েও বেশি ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ল। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের শেষে আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে মহামারীর আগের পরিসংখ্যানকে।
উদাহরণ হিসাবে বালির কথাই তুলে ধরলেন ট্রিয়া উমা উইসাতা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিলুহ ওয়ার্ডিয়ানি। তার পর্যবেক্ষণ বলছে, পর্যটনের চাপে ভীষণ ভাবে বদলে যাচ্ছে এই দ্বীপের সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এরমধ্যে পর্যটকের ভিড়ের কারণে বালি দ্বীপের উবুদ এলাকার ধানক্ষেত এবং সেমিনিয়াকের সৈকতে মাটি ক্ষয় দেখা দিয়েছে; হুমকির মুখে আছে পরিবেশও।
নিলুহ ওয়ার্ডিয়ানি বলেন, “অসচেতন পর্যটকদের কারণে প্রথাগত বালিনিজ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচার বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে সংস্কৃতির সুরক্ষা এবং পর্যটনের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরব হওয়া জরুরি, যেন দ্বীপের ঐতিহ্যের সুরক্ষা বজায় রেখে পর্যটকদের স্বাগত জানানো সম্ভব হয়।”
ওভার টুরিজমের আরেক উদাহরণ হলো গোয়া। ভারতের সবচেয়ে ছোট এই রাজ্যে জনসংখ্যা ১৬ লাখ; অথচ ২০২৩ সালে এখানে পর্যটক এসেছিল ৮৫ লাখ। ফলে দূষণ, সৈকতে আবর্জনা, যানজট, আবর্জনা নিষ্কাশনে অব্যবস্থাপনা, পানীয় জলের সংকট বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে গোয়ার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক হয়ে গেছে।
এসবের পরিণতি হলো গোয়ায় বিদেশি পর্যটক কমে গেছে ৬০ শতাংশ।
পর্যটনের চাপ ছাপ ফেলছে পর্বতমালাতেও। ২০২৩ সালে উত্তরাখণ্ডে বদরিনাথ চক্রের জন্য পরিচিত যোশীমঠ ‘ডুবন্ত নগর’ নামে আলোচিত হয়। কারণ সেখানে মারাত্মক ভূমি ক্ষয় দেখা দেয়। মাটি বসে যেতে শুরু করে, ফলে বাড়ি, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামোতে ফাটল দৃশ্যমান হয়। এরপরই হিমালয় ঘেঁষা এই অঞ্চল নিয়ে শঙ্কা জোরদার হয়; প্রশ্ন ওঠে অতিরিক্ত জনসমাগম, উন্নয়নের জোয়ার, অপরিকল্পিত অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে।
ওয়াইল্ড হুইস্পার্স আফ্রিকায় পর্যটক দল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, যার নির্বাহী প্রধান আমান শাহ।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত পর্যটন তাকে মাসাই মারার কথা মনে করিয়ে দেয়।
সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠা এই জাতীয় অভয়ারণ্যও পর্যটন চাপের শিকার হচ্ছে। ফলে এখানকার প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন হয়ে উঠছে।
“অভয়ারণ্যে গাড়ির আনাগোনা প্রাণীর আচরণে প্রভাব ফেলছে, এমনকি এদের বাসস্থানও নষ্ট হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কবলে পড়ে বন্যপ্রাণীর জন্য নির্মিত করিডোরগুলোও দখল হয়ে যাচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।”
“পর্যটকরা যে বন্য প্রকৃতি দেখতে মুখিয়ে থাকেন, তা আসলে অতি ভিড়ের কারণেই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। পর্যটন নিশ্চয়ই স্থানীয় বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দেয়, কিন্তু স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয় তাতে ওই লাভের অংক ম্লান হয়ে যায়।”
পর্যটকের চাপ কেন বাড়ছে
কম খরচে উড়োজাহাজ সেবা এবং বাজেট বান্ধব ভ্রমণ নিয়ে এখন জানার সুযোগ পাচ্ছে সবাই। এ কারণেই বিশ্বের দর্শনীয় স্থানে পর্যটকের সংখ্যায় উল্লম্ফন ঘটেছে। এমনকি স্থানীয়ভাবে যতটুকু সেবা, সুবিধা, নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপনা সামর্থ বরাদ্দ করা যায়, তার চেয়েও পর্যটক বেশি হয়ে যাচ্ছে।
ভিয়াকেশন স্টার্টআপের সিইও এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা যতীন্দর পাল সিং মনে করেন, পর্যটনের জোয়ার আনতে সোশাল মিডিয়া বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণে এখানে স্ক্রল করলেই পৃথিবীর কোনায় কোনায় থাকা গন্তব্যের ছবি-ভিডিও দেখতে পায় কোটি কোটি মানুষ। সুতরাং উৎসাহীদের ভিড়ও বাড়তে থাকে জায়গায় জায়গায়।
ইনফ্লুয়েন্সাররা এবং ট্রাভেল ভ্লগাররাই দিন দিন এই উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইনস্টাগ্রামে ভালো দেখায় এমন জায়গায় সবারই যেতে হবে। ফলে পরিবেশের উপর পর্যটনের বিরূপ প্রভাব ঠেকানো যাচ্ছে না।
আগের মতো কেবল সঞ্চয় করে জীবন কাটিয়ে দেয়ার বদলে মধ্যবিত্তরা আজকাল আন্তর্জাতিক ভ্রমণে যেতেও দ্বিধা করছে না। বিশেষ করে চীন এবং ভারতে পর্যটকদের আর্থিক সামর্থ এবং আগ্রহ বেড়েছে।
ছুটির মৌসুমে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের লোভনীয় প্যাকেজের ছড়াছড়ি থাকে এবং পরিবার-প্রিয়জনের সঙ্গে ঘুরে আসার তাড়াও থাকে। এই সময় স্বভাবতই বাকি সময়ের চেয়ে ভিড় বেশি থাকে যা সামলানোর মতো ব্যবস্থাপনা কাঠামো রাখা সম্ভব হয় না। ফলে ভুক্তভোগী হয় পরিবেশ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী। বছর জুড়ে পর্যটন ব্যবস্থাপনা রাখা গেলে হয়তো বিশেষ মৌসুমে এই চাপ সমন্বয় করা যেতো; যা না করে উঠতে পারা সরকার ও কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা।
সমাধান কীভাবে হবে
ভারতে মানালি, শিমলা এবং বিশেষ করে কাশোল সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে অতিরিক্ত ভিড়ের শিকার হয়েছে বলে মনে করেন ভুবনী।
“ইনস্টাগ্রামে ছেয়ে আছে কসোল। অনেক মানুষ সেখানে ভ্রমণ করছে। রাস্তায় সব সময় ভারী গাড়ির ভিড় লেগে থাকে। গন্তব্যে পৌঁছেও স্বস্তিতে ঘোরাফেরা করা যায় না”, বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, একই জায়গায় পর্যটকের ভিড় মোকাবেলা করতে বিকল্প জায়গার প্রচারণা বাড়াতে হবে।
ভুবনী বলেন, “কসোল বা সিমলা ভ্রমণের বদলে আমি বরং হিমাচলের ছোট গ্রামগুলোতে ঘুরতে যাই। এসব জায়গায় অনেক হোমস্টে রয়েছে। এখানে ঘোরা ও থাকার অভিজ্ঞতা দুর্দান্ত। এবং স্থানীয় অর্থনীতিও মজবুত হচ্ছে এসব অপরিচিত এলাকার।”
স্থানীয়দের টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেয়ার পরামর্শ দিলেন নিলুহ। সংবেদনশীল এলাকায় গাড়ির সংখ্যা সীমিত করলে পরিবেশের উন্নতি হবে বলে মনে করেন তিনি।
নিলুহ বলেন, এখন ইকোটুরিজমের প্রচার ও প্রসার বাড়ানো দরকার। এতে পর্যটকের অতিরিক্ত ভিড় কমিয়ে এনে পরিবেশে ভারসাম্য ধরে রাখা যাবে।
সামনের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবছেন কি? তাহলে সোশাল মিডিয়ায় সবাই যাচ্ছে বলে ঘোষণা দেয়া জায়গাগুলো এড়িয়ে পর্যটকের পদচারণা কম এমন কোনো দর্শনীয় জায়গা খুঁজে নিন।