পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজে দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে করা মামলাটি তদন্ত আবারও করা হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মঙ্গলবার মামলাটির অধিকতর তদন্তের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এক দশক আগে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দুর্নীতির প্রমাণ না মেলার কথা জানিয়ে আলোচিত ওই মামলাটির সমাপ্তি টেনেছিল দুদক।
এর আগে ২০১২ সালে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করেছিল বিশ্ব ব্যাংক। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, সেতুর কাজ পেতে বাংলাদেশি ও কানাডিয়ান ফার্মের কর্মকর্তা ও কিছু ব্যক্তি ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করেছে এমন প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুদকের উপ পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ বনানী থানায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলটি করেন।
দুদক মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আক্তার হোসেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মামলার দুই বছর পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছিল। সেটি আবার অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তদন্তে তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ার কারণে তখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এখন পদ্মা সেতুর অনিয়ম নিয়ে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ কারণ মামলাটি অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
মামলার প্রধান আসামি সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এক পর্যায়ে তাকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়, তার চাকরিও ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
মামলার বাকি ছয় আসামি হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।
দুদকের ডিজি আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আসামিরা একে অপরকে আর্থিক লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজে তদারকী পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত দরপত্রের অন্যতম দরদাতা এসএনসি লাভালিন ইন্টারন্যাশনালকে কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
দুর্নীতির ওই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন। অভিযোগ ছিল সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও।
তবে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে পরে দাবি করেছিলেন তখনকার দুদক কমিশনার বাংলাদেশের এখনকার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
মামলায় বলা হয়েছিল, আসামিরা দণ্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসএনসি লাভালিন ওই কার্যাদেশ পেলে ‘ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো’ বলেও এজাহারে বলা হয়।
২২ মাস তদন্তের পর দুদক আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের’ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর দুদকের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাত আসামিকেই অব্যাহতি দেয় ঢাকার একটি আদালত।
২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের তখনকার চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেছিলেন, “মামলার মেরিট না থাকায়, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষী না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তে মামলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই আদালতে চার্জশিট পেশ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ তদারকি বিষয়ে পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে এসএনসি-লাভালিনের কর্মীরা ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন- এমন অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক।
ওই অভিযোগের ভিত্তিতে প্রমাণ যোগাড়ের জন্য ফোনে আড়িপাতা তথ্য বা ‘ওয়্যার ট্যাপস’ ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে ২০১১ সালে তিনটি আবেদন করে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)।
তবে প্রকল্পে কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের শীর্ষস্থানীয় তিন জন কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পায়নি দেশটির আদালত। অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মামলাটি খারিজ করে তিন কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালেস, রমেশ শাহ ও জুলফিকার আলী ভূঁইয়াকে খালাস দেন।
এর আগের মাস জানুয়ারিতে সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নর্ডহেইমার অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড বাদ দেওয়ার কথা বলেন।
মামলায় এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেসকে ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার করা হয়।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। এ অভিযোগ এনে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার এক দিন আগে নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার।