রাজধানীর মিরপুরে পল্লবী এলাকার ঠিক মাঝখানে বিশাল মাঠ নিয়ে রয়েছে পল্লবী এম আই মডেল হাই স্কুল। শীতের কুয়াশা মোড়া বিজয় দিবসের সকালে রঙিন বেলুনে সেজে ওঠে এই শিক্ষাঙ্গনের মূল ফটক। ভেতরের বাগান জুড়ে সাঁটানো দেখা যায় সারি সারি জাতীয় পতাকা। বেশ কয়েকটি ব্যানার দেখা গেলো এখানে-ওখানে; তাতে লেখা ‘মহান বিজয় দিবসে ফ্রি মেডিকেল, ডেন্টাল ও পেইন ক্যাম্প এবং স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি’।
স্কুলের বাইরে ও ভেতরে ততক্ষণে জমে উঠেছে নানা বয়সীদের সমাগম। এদের অনেকেরই পরনে লাল-সবুজ শাড়ি আর পাঞ্জাবি।
পল্লবীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম জাকি এই স্কুল থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাস করেছেন। ফেইসবুকে ‘পল্লবীয়ানস’ গ্রুপের একজন অ্যাডমিন তিনি। তাকে দেখা গেলো সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে ছুটোছুটি করে সবদিক সামাল দিচ্ছেন।
সকাল সন্ধ্যাকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে জাকি বলেন, পল্লবীবাসীদের নিয়ে ফেইসবুক গ্রুপ ‘পল্লবীয়ানস’ এই আয়োজনের উদ্যোক্তা। অনেক বছর ধরে এই এলাকায় এবং এখন নানা দেশে বাস করছেন এমন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্য যুক্ত রয়েছেন এই গ্রুপে।
“পল্লবীতে যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন তাদের একটা ডেটাবেজ তৈরি করার ভাবনা ছিল শুরুতে। প্রথমে চিকিৎসকদের দিয়ে শুরু করার লক্ষ্য ছিল; পল্লবীতে কতজন ডাক্তার আছেন, ক্লিনিক-গাইনি সেন্টার এবং ওষুধ শিল্পের সঙ্গে যারা আছেন তাদেরকে সমন্বয় করে একটা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা।”
“প্রাথমিকে অবস্থায় তেমন সাড়া পাচ্ছিলাম না; কিন্তু এরমধ্যে আমি ড. তোফাজ্জেল হোসেন রানা ভাইয়ের সহযোগিতা পাই। এখান থেকেই ক্যাম্প আয়োজনের শুরুটা হয়। এরপর ব্যানার করে, এলাকায় মাইকিং করে, ফেইসবুক গ্রুপে প্রচারণা চলে মেডিকেল ক্যাম্প নিয়ে।”
এই মেডিকেল ক্যাম্পে কারা সেবা পেলেন?
সব বয়সী এবং সব শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষের জন্য এই মেডিকেল ক্যাম্প উন্মুক্ত রাখা হয় বলে জানালেন জাকি।
“সকালে সমাগম একটু কম হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আসতে থাকেন। প্রায় ৩৫০ জন এরমধ্যে এসেছেন। ৩০ থেকে ৩৫ জন এলাকার বাইরে থেকেও এসেছেন মাইকিং শুনে।”
“সব বয়সীরাই এসেছেন, তবে ৪০ পার করেছেন এমন বয়সীদের বেশি দেখা গেছে। ৬০-৬৫ বছর বয়সীরাও এসেছেন। বাচ্চারাও এসেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এই ক্যাম্পে এসেই প্রথম নিজের ব্লাডগ্রুপ জানতে পেরেছে।“
“আর এই ক্যাম্পে সেবা দিতে মেডিকেল অফিসার এবং চিকিৎসক মিলে প্রায় ৪০ জন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন।”
বিজয় দিবসে পল্লবীয়ানস গ্রুপের এই ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, সন্ধানী ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, আলোক হাসপাতাল লিমিটেড, আজমল হাসপাতাল, সততা ডেন্টাল কেয়াল, কেয়ার অ্যান্ড কিওর ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড ডেন্টাল সেন্টার এবং আয়েশা-জাফর মেমোরিয়াল হেলথ ফাউন্ডেশন।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে মেডিসিন, কার্ডিওলজি, ফিজিওথেরাপি, অর্থপেডিক্স, ডেন্টাল চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া এই ক্যাম্পে সুগার টেস্ট, রক্তচাপ দেখার ব্যবস্থাও ছিল।
“প্রথম ২০ জনকে আজমল হাসপাতালের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে ক্রিয়েটেনিন পরীক্ষা সেবা দেয়া হয়।”
মেডিকেল ক্যাম্পে অভিনয়শিল্পী ফারজানা ছবি
সকাল সন্ধ্যার কাছে নিজেকে ‘পল্লবীর মেয়ে’ বলে পরিচয় দিলেন অভিনয় জগতে ২৫ বছর পার করা ফারজানা ছবি।
স্কুলের দ্বিতীয় তলায় একটি শ্রেণি কক্ষে মেডিকেল ক্যাম্পে লাল শাড়ি পরা ফারজানা ছবি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি সবসময় চাই, আমার দেশের মানুষ, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, আমাদের সন্তানেরা জানুক আমরা কেন লাল-সবুজ পরি বিজয়ের দিনে।
“আমি একজন অভিনয়শিল্পী। আমার অভিনয় জীবন থেকে শুরু করে আমার ব্যক্তিজীবন প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমার বাংলার ইতিহাস, আমার সংস্কৃতি আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। আমাদের সংস্কৃতি-চেতনাবোধ এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যে যথাযথ তথ্য-ইতিহাস তা যেন আমার পরবর্তী প্রজন্ম সঠিকভাবে জানতে পারে সেজন্য আমি সবসময় সোচ্চার।”
বিজয়ের দিনে মেডিকেল ক্যাম্প উদ্যোগের কি প্রভাব থাকতে পারে পল্লবীবাসীর উপর?
এই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী ফারজানা ছবি মনে করেন, “একেকটি এলাকা দিয়েই শুরু হয়। প্রত্যেকটি এলাকায় বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, আমাদের বাংলাদেশের বিশেষ দিনগুলোতে এ ধরনের উদ্যোগ একটি মাইল ফলক হিসাবে কাজ করে।
“কারণ সুস্থ জাতি দেশের জন্য এবং দশের জন্য অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে। শরীর ও মন ভালো থাকলে আমরা দেশের জন্য ভালো কিছু করার সামর্থ রাখব। আমার স্কুলে যে এই ধরনের একটি আয়োজন হয়েছে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে পল্লবীয়ানস গ্রুপের উদ্যোগে – এই উদ্যোগটি অসাধারণ এবং দারুণ। এর প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।”
বিজয় দিবসে পল্লবীতে ক্রীড়াবিদ আমিনুল হক
কর্মসূচির এক ফাঁকে এসে ঘুরে যান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হক। সাফজয়ী দলের এই গোলরক্ষক এই পল্লবী এম আই মডেল হাই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী।
রক্তচাপ মাপিয়ে নিয়ে সকালে এই ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন পল্লবী এম আই মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ। এরপর তিনি ব্লাড সুগারও পরীক্ষা করান।
৪০০ চিকিৎসক পল্লবীতেই?
পল্লবীয়ানস গ্রুপের অ্যাডমিন জাকির অনুমান, এই এলাকায় অন্তত ৪০০ জন চিকিৎসক আছেন।
আর ‘এই ডক্টর কমিউনিটির সঙ্গে এলাকাবাসীর একটা বন্ডিং তৈরিতে’ বিজয় দিবসের দিনে ক্যাম্প আয়োজন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. হালিমা আক্তার হ্যাপি।
“এই ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য ছিল পল্লবীবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা। তারা যেন সহজেই ডক্টরের কাছে যেতে পারেন এই বার্তা দেয়া। এলাকাবাসীর জন্য আমার মনে হয় এটা উপকারে আসবে।”
শহীদ আসিফ যখন মেডিকেল ক্যাম্পের প্রেরণা
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আসিফ ইকবাল ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন। তার চাচাতো ভাই হলেন ড. তোফাজ্জেল হোসেন রানা; যিনি এই স্কুল থেকে ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাস করেছেন। এখন তিনি সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং আলোক হাসপাতালের আইসিইউ কনসালটেন্ট।
বিজয় দিবস উপলক্ষে পল্লবীতে মেডিকেল ক্যাম্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শহীদ আসিফের কথাই বারবার তার মনে ভেসে উঠছিল।
সেসব স্মৃতিচারণ করে ড. তোফাজ্জেল হোসেন রানা সকাল সন্ধ্যার কাছে বলেন, “ওর (শহীদ আসিফ) ভিডিওটা আমি দেখেছি … একটা তরতাজা যুবক মিনিটের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল …।
“ওকে যখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে নেয়, ব্লাডের জন্য যখন বলে ব্লাড কালেক্ট করতে করতেই কিন্তু ও মারা যায়।”
“ও সবসময় মানুষের উপকারে কাজ করত … কার কখন ব্লাড লাগবে, কোন সাহায্য লাগবে… ও নিজেও তিন-চার মাসের বিরতিতে ব্লাড দিত। এখান থেকেই আমার আসলে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির পরিকল্পনা আসে।”
বিজয় দিবসের দিনে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ‘পুরুষের তুলনায় নারীর উপস্থিতি বেশি’ মনে হয়েছে ড. তোফাজ্জেল হোসেন রানার কাছে।
এই ক্যাম্পে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ‘ডেন্টাল ও পেইন’ যোগ করা নিয়ে তিনি বলেন, “অনেকে দাঁতের সমস্যায় ভুগছেন, সেসব নিয়ে পরামর্শ দিতে আমরা এই ক্যাম্পে ডেন্টাল যুক্ত করেছি।
“আর আমরা যখন চেম্বারে রোগী দেখি অনেকেরই ব্যথার সমস্যা পাই … কোমরে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা। তাদের কথা ভেবে পেইন ক্যাম্প রাখা হয়েছে। আজকে অনেকেই এসেছিলেন পরামর্শ-সেবা নিতে।”
মিলনমেলার মধ্যে দিয়ে পল্লবীবাসীর স্বাস্থ্য সচেতনতায় আগামীতেও বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে পল্লবীয়ানস গ্রুপ এমন ক্যাম্প আয়োজন করবে বলেও আভাস দিলেন ড. তোফাজ্জেল হোসেন রানা।
বিশেষ করে নারীস্বাস্থ্য সচেতনতায় জোর দিয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্রেস্ট ক্যানসার, সার্ভিকাল ক্যানসার নারীমৃত্যুর দ্বিতীয়-তৃতীয় কারণের মধ্যে চলে এসেছে।
“আমাদের প্ল্যান আছে আমরা আগামীতে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করব। এলাকাবাসীর মধ্যে বয়স্ক রোগীদের অনেকের নিউমোনিয়া-অ্যাজমা সমস্যা থাকে, তাদের জন্য আগামীতে এমন কিছু পরিকল্পনা আছে।”
পাশাপাশি সকাল সন্ধ্যার কাছে পল্লবীয়ানস গ্রুপের অ্যাডমিন জাকি বলেন, “বিশেষ করে দুঃস্থদের জন্য মূল পল্লবীর আশেপাশে মিরপুর ১২, আলুব্দি, বর্ধিত পল্লবী, ইস্টার্ন হাউজিং এসব এলাকায় সবার সহযোগিতা নিয়ে ফ্রি ক্যাম্প করারও ভাবনা রয়েছে আমাদের।”
আসিফ চত্বরে বিজয়ের ছবি আঁকল শিশুরা
স্কুলের কাছেই এই পাড়ার বহু পুরনো ‘রেডসান মোড়’। ১৯ জুলাই তারিখের পর এই অংশের নাম হয়েছে আসিফ চত্বর। মেডিকেল ক্যাম্প শেষ হতেই আসিফ চত্বরে ভিড় করতে শুরু করে এই মহল্লার যত কচিকাঁচা মুখ।
শিশু-কিশোরদের বিজয় দিবসের লাল-সবুজ ভাবনা কাগজে ফুটিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল উত্তর পল্লবী বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিক সমিতি।
পাঁচ থেকে আট বছর বয়সীদের নিয়ে ক-দল এবং নয় থেকে ১২ বছর বয়সীদের নিয়ে খ-দল করা হয়। এখানে মোড়ে বিছানো মাদুরে সারি বেঁধে বসে বিজয়ের সাজে সেজে আসা শিশুরা। অল্পক্ষণেই হাতের কাগজে রঙ ঘষে ওরা ফুটিয়ে তোলে স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের পতাকা, সূর্য।
অনেক অভিভাবক নিজের সন্তানের আঁকা এসব ছবি দেখে বিহ্বল হয়ে বলে ওঠেন, “আমি তো শেখাইনি … ও নিজে নিজেই আঁকা শিখেছে এতো কিছু।”
বিকাল ৫টার দিকে আসিফ চত্বরে শিশুদের ছবি আঁকা দেখতে আসেন এই আয়োজনের প্রধান অতিথি কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী আহসান হাবিব।
ছবি আঁকা পর্বে ৭২ জন শিশু-কিশোর যোগ দিয়েছিল। মাইকে বেজে চলেছিল বিজয়ের গান। আর এই মহল্লার শৈশবের বন্ধু, বড় ভাই, বড় আপা, খালা, আংকেল সম্পর্কের সবাই সে গানে কণ্ঠ মিলিয়ে ভিড় করেছিল, হাঁটছিল আর মেতে উঠেছিল খোশগল্পে।