আফসান জ্যাবিন অদিতি কক্সবাজার গিয়েছিলেন সমুদ্র দেখতে, সেখানে প্যারাসেইলিং দেখে রোমাঞ্চিত হন তিনি। তারও সাধ জাগে পাখির মতো আকাশে ভেসে সমুদ্রের জলরাশি আর পাশের উঁচু পাহাড় দেখার। সেই সাধ পূরণ করতে গিয়ে জীবনই ঝুঁকিতে পড়ল তার।
ঢাকার নিউ ইস্কাটনের বাসিন্দা এই নারী গত ২২ মে কক্সবাজারে যাওয়ার দুদিন পর দরিয়ানগর পয়েন্টে গিয়ে ‘ফ্লাই এয়ার সী স্পোর্টস প্যারাসেইলিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে টিকেট কাটেন ২ হাজার টাকায়। তারপরই ঘটে বিপত্তি।
ঘটনার বর্ণনা অদিতি ফেইসবুকে লিখেছেন, “প্যারাসেইলিং শুরু করার সময় মনে হচ্ছিল ওদের দড়ির টেম্পার চলে গেছে। কিন্তু ভরসা ছিল ওরা নিশ্চয়ই সেফটি সিকিউরিটি মেইনটেইন করে প্যারাসেইলিং করাচ্ছে।
“দুর্ভাগ্য, কিছুটা ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সোজা নিচে পড়তে থাকি। তখন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, নিচে কেন পড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতি ওদের আওতার বাইরে। আমি একটা দড়ি ছিঁড়ে সমুদ্রের মধ্যে পড়ে গেলাম।”
পড়ে গিয়ে সাগরজলে দুই-তিন বার হাবুডুবু খান অদিতি। উঠে দাঁড়ানোর পরে তাকে তুলে আনেন প্যারাসেইলিংয়ের কর্মীরা।
নিজের ঝুঁকিতে পড়ার বিষয়টি সামনে এনে সোশাল মিডিয়ায় ছবি, ভিডিও প্রকাশ করেন অদিতি। তাতে নিরাপত্তা নিয়ে প্যারাসেইলিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতার অভিযোগও করেন তিনি।
এরপর কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পক্ষে যোগাযোগ করে তাকে অনলাইনে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। গত ২৯ মে লিখিত অভিযোগটি জমা দেন তিনি।
সমুদ্রের ওপরে আকাশে উড়ে বেড়ানোর অনুভূতি নিয়ে অনেকেই আগ্রহী থাকেন প্যারাসেইলিংয়ে। কক্সবাজারে একপাশে সমুদ্র আরেক পাশের সবুজ পাহাড় তাতে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। প্যারাসেইলিং বেশ ব্যয়বহুল বলে আলোচনা থাকলেও তাতে পর্যটকদের আগ্রহ কমে না।
অদিতি এমন দুর্ঘটনায় পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে প্যারাসেইলিংয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী? কতটুকু সেফটি সিকিউরিটি মেইনটেইন করে থাকে প্যারাসেইলিং কর্তৃপক্ষ? সেই সঙ্গে প্যারাসেইলিংয়ে ব্যবহৃত স্পিডবোট চলাচল উপযোগী কি না এবং ব্যবহৃত রশিসহ অন্য উপকরণ কতটা নিরাপদ?
ফেইসবুক পোস্টের সূত্র ধরে অদিতির সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার। সেখানেও তিনি তুলে আনেন সেই একই প্রশ্ন।
অদিতি বলেন, “সমুদ্রে পড়ে যাওয়ার পর দুই থেকে তিনবার হাবুডুবু খেয়েছি। লবণ পানি খেয়ে পরে বমি হয়েছে কয়েকবার। বাম হাতে ও দুই পায়ে ব্যথা পেয়েছি। চিকিৎসকরা বলেছেন, মেরুদণ্ডেও চোট লেগেছে।”
দুর্ঘটনার পর অদিতি জানতে পারেন স্পিডবোটের ইঞ্জিন বিকল হওয়া এবং দড়ির বাঁধন খুলে যাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, “আমি সাঁতার না জানা মানুষ। আর একটু দূরে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটলে জীবনে বাঁচতে পারতাম কি না সন্দেহ। অথচ কর্তৃপক্ষের কোনও সেফটি মেজারমেন্ট নেই। এমন দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার করার জন্যও কোনও বোট ছিল না। শুধু টাকার জন্য টিকেট বিক্রি করে এভাবে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ধাবিত করছে এরা।”
“মানুষের জীবন হুমকির মুখে রেখে এটা কোন ধরনের ব্যবসা। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেই ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি,” ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন অদিতি।
প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা এই প্রথম না। নানা সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নিয়োগকৃত এক বিচকর্মী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, গত ১৯ মে একই প্রতিষ্ঠানে প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে আরেকজন পর্যটক দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে যান। তিনি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলেন। অন্য একটি স্পিডবোট নিয়ে বিচকর্মীরা ওই পর্যটককে উদ্ধার করেন। গুরুতর জখম হওয়ায় তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে হয়েছিল।
১৯ মের দুর্ঘটনার এক ভিডিও আসে সকাল সন্ধ্যার হাতে। সেখানে দেখা যায়, সমুদ্রের প্রায় ২০০ গজ দূরে এ ঘটনা ঘটে। দ্রুতগামী বোট নিয়ে বিচকর্মীরা এই পর্যটককে উদ্ধার করছেন।
এক মাসে দুটি দুর্ঘটনা ঘটলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও গাফিলতি নেই বলে দাবি করেছেন ‘ফ্লাই এয়ার সী স্পোর্টস প্যারাসেইলিং’র মালিক মোহাম্মদ ফরিদ।
তিনি বলেন, ২৪ মে বা ১৯ মে মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা ‘মূলত অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনা’। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই প্যারাসেইলিং করা হয়।
২৪ মের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি পক্ষ তার ব্যবসা বন্ধ করতে চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ ফরিদের।
তিনি বলেন, “সৈকতের যে পয়েন্টটি আমি ব্যবহার করি, ওখানে অন্য কেউ ব্যবসা করতে চায়। তারা দুর্ঘটনা নিয়ে অপতৎপরতা শুরু করেছে।”
তবে দুর্ঘটনায় শিকার পর্যটকদের সঙ্গে ওই পক্ষের কী সম্পর্ক, তার সদুত্তর দিতে পারেননি ফরিদ।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জেলা প্রশাসন ১৪টি শর্ত সাপেক্ষে প্যারাসেইলিং পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। এসব শর্ত যদি অমান্য করা হয়, তাহলে অনুমতি বাতিল করা হবে।
এ বিষয়ে কারও কোনও অভিযোগ থাকলে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
শর্তগুলোর বিষয়ে মাসুদ রানা জানান, প্যারাসেইলিং এর ক্ষেত্রে অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে- দক্ষতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক দিয়ে প্যারাসেইলিং পরিচালনা করতে হবে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্যারাসেইলিং পরিচালনা করা যাবে না। যাত্রী এবং চালকের জন্য লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। কোনও অবস্থাতেই পর্যটকদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা যাবে না। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
অদিতির অভিযোগ নিয়ে কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেশকার শাহজাহান নূরি জানিয়েছেন, আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি আদেশ দেবে জানিয়েছে। আদেশটি দেওয়া হলে তখন তা জানানো হবে।