ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের করা মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমনি বলেছেন, আদালতে বিচারেই যেন সত্য প্রকাশ হয়, তাই তিনি চান।
এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছিলেন পরীমনি। পাল্টায় তিনিও চিত্রনায়িকার বিরুদ্ধে মারধর, ভাংচুর ও ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগে পাল্টা মামলা করেন।
সেই মামলায় রবিবার অভিযোগ গঠনের পর ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জুনাইদ আসামি পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।
তা নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে একদিন বাদে সোমবার হাকিম জুনাইদের আদালতেই আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন পরীমনি।
বিচারক ১ হাজার টাকার মুচলেকায় জামিন দেন এই চিত্রনায়িকাকে, যার পেছনে কোটি কোটি টাকা লগ্নী রয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের।
সকাল ১০টার দিকে আদালতে আসেন পরীমনি। নীল পাড়ের ধূসর রঙের একটি শাড়ি পরে এসেছিলেন তিনি, ব্লাউজও পরেছিলেন শাড়ির রঙের সঙ্গে মিল রেখে। চোখে ছিল চশমা। সোয়া ১০টায় বিচারকাজ শুরু হওয়ার সময় এজলাসের পেছনে একটি বেঞ্চে বসেছিলেন পরীমনি।
বিচারক আসামিদের ডকে যেতে বললে পরীমনি গিয়ে দাঁড়ান কাঠগড়ায়। তার পক্ষে জামিনের শুনানি করেন অ্যাডভোকেট নীলাঞ্জনা রিফাত সুরভী।
তিনি বলেন, “গতকাল মামলাটি চার্জ শুনানির জন্য ছিল। পরীমনি অসুস্থ থাকায় আদালতে আসতে পারেননি। চার্জ গঠন হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আজকে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছেন তিনি। তার জামিন প্রার্থনা করছি।”
তখন বিচারক বলেন, “আশা করছি, সবাই কোর্টের ডিগনিটি রক্ষা করবেন। কোর্টকে বিতর্কিত করবেন না। মামলাটা জামিনযোগ্য ধারার। আসলেই জামিন পাবেন, বিষয়টা এমন নয়। বিচারাধীন বিষয়ে এভাবে আগে কথা বলাটা কতটুকু যৌক্তিক?”
পরীমনির আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারক আরও বলেন, “আপনি কোর্ট অফিসার। এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন।”
এরপর বিচারক ১ হাজার টাকা মুচলেকায় পরীমনির জামিনের আদেশ দেন। এসময় বাদী নাসিরের কোনও আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন না।
জামিন পেয়ে এজলাস থেকে বেরিয়ে পরীমনি আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা সবাই তো জানেন, আমি একটা মামলা করেছিলাম। মামলা দায়ের করার আড়াই বছর পরে তিনি (নাসির) একটা মামলা করেন। যে মামলার জন্য গতকাল আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
“আমার খুব বিশ্বাস ছিল, আমি আজকে জামিন নিতে এসে জামিন পেয়ে যাব। আপনারা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। আমি জামিন পেয়েছি। আপনাদের এত ভালোবাসা নিয়ে বাড়ি ফিরছি।”
নড়াইলের মেয়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি এক দশক আগে পরীমনি নাম নিয়ে আসেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে। মুক্তির আগেই দুই ডজনের বেশি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়ে রীতিমতো শোর ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
২০২১ সালের ১৩ জুন আকস্মিক এক সংবাদ সম্মেলনে রীতিমতো বোমা ফাটানো সংবাদ দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন এই চিত্রনায়িকা। তিনি অভিযোগ করেন, তার পাঁচ দিন আগে ৮ জুন তুরাগ নদীর তীরের ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়ে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হন তিনি।
তার অভিযোগ ছিল, বোট ক্লাবের তখনকার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যবসায়ী নাসিরের বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি বোট ক্লাবের সভাপতি।
পরদিন পরীমনি মামলা করলে নাসিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে নাসির জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ২০২২ সালের ৬ জুলাই আদালতে পরীমনির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন। তাতে চিত্রনায়িকার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বোগদাদী জিমিকেও আসামি করা হয়।
এর আগে ২০২১ সালেরই ৪ আগস্ট ঢাকার বনানীর ১২ নম্বর সড়কে পরীমনির বাসায় অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, আইস ও এলএসডি উদ্ধারের কথা জানায় র্যাব।
সেদিন মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় পরীমনিকে। দুই দফায় রিমান্ডে নিয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক মাস পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।
পরীমনির মামলায় নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি এখনও চলছে। তার মধ্যেই রবিবার নাসিরের মামলায় পরীমনির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়।
জামিন নিয়ে পরীমনি বলেন, “এটা খুবই পরিষ্কার যে আমি একটা মামলা করলাম, তার ঠিক আড়াই বছর পরেই পাল্টা মামলা করা হলো শুধু আমাকে দমানোর জন্য। আমার মামলাটি বিচারাধীন।
“আমার বিশ্বাস, আমি সঠিক বিচার পাব। আপনারা সবাই জানেন, আমি চার বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরে আদালতে এসেছি। আমার বিশ্বাস, আমি এখানে ন্যায়বিচার পাব। আমি এখান থেকে আশাহত হতে চাই না। আমি চাই শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হোক।”
আরও পড়ুন পরীমনির পক্ষে সরব সংস্কৃতিকর্মীরা
নাসিরের মামলায় গত বছরের ১৮ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সেখানে পরীমনি ও জিমির বিরুদ্ধে মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পরবর্তীকালে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এম সাইফুল ইসলাম দুই আসামিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করেন। তখন আত্মসমর্পণ করে জামিন পান তারা।
রবিবার অভিযোগ গঠনের সময় অনুপস্থিত থাকায় পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
তা নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দেয়। আগের দিন টাঙ্গাইলে একটি অনুষ্ঠানে যেতে পরীমনিকে ধর্মীয় গোষ্ঠী বাধা দেওয়ার পর এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার যোগসূত্রও অনেকে খুঁজতে থাকেন।
হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফতে মজলিশের বিরোধিতার মুখে টাঙ্গাইলে হারল্যানের শাখা উদ্বোধনে যেতে না পারার পর শনিবার পরীমনি ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন ফেইসবুকে।
তিনি লিখেছিলেন, “এত চুপ করে থাকা যায় নাকি! পরাধীন মনে হচ্ছে। শিল্পীদের এত বাধা কেন আসবে? ইনসিকিউরড ফিল হচ্ছে! এমন স্বাধীন দেশে নিরাপদ নই কেন আমরা!!”