নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের গাছপালা নিয়ে লিখেছিলেন ‘শ্যামলী নিসর্গ’। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত সে বইটি এখনও ঢাকার বৃক্ষচর্চার আকরগ্রন্থ। তিনি শ্যামলী নিসর্গ লিখে রেখে না গেলে সেকালের ঢাকার পথতরুর বৃত্তান্ত আমরা হয়তো জানতে পারতাম না। কিন্তু ঢাকার সেসব পথতরুর এখন কী অবস্থা? আজও কি সেগুলো বেঁচে আছে? দ্বিজেন শর্মার আত্মজ সে বৃক্ষরা এখন ঢাকার কোথায় কীভাবে আছে সে কৌতুহল মেটানো আর একালের পাঠকদের সঙ্গে ঢাকার সেসব গাছপালা ও প্রকৃতির পরিচয় করিয়ে দিতে এই লেখা। কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় সরেজমিন অনুসন্ধানে তুলে ধরছেন ঢাকার শ্যামলী নিসর্গের সেকাল একাল। ঢাকার প্রাচীন, দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য ও অনন্য পথতরুর বৃত্তান্ত নিয়ে সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বাংলা বারো মাসে বারো পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন শ্রাবণ পর্ব।
পল্টন নামের উৎপত্তি সেনানিবাস থেকে। একসময় পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, তোপখানা ও ফুলবাড়িয়া রেললাইন পর্যন্ত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনানিবাস। জানা যায়, ১৮৪০ সাল পর্যন্ত সেখানে সেনানিবাস ছিল। এরপর তা সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল রমনা, বেগুনবাড়ি ও পরে লালবাগে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তা আবার বেগুনবাড়ি থেকে পল্টনে স্থানান্তরিত হয়। তবে এ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও আগে।
ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: আষাঢ় পর্ব
কর্নেল ডেভিডসন ১৮৪০ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর বর্ণনায় বলেছিলেন, ‘‘পল্টন সেনানিবাস খুব সবুজ ও সুন্দর, কিন্তু রেজিমেন্টের সব অফিসারদের মধ্যে একজন বা দুজন থাকেন সেনানিবাসের ভেতরে। বাকিরা জ্বরে ভুগে বা জ্বরের ভয়ে থাকেন শহরে। সেনানিবাসের পাশে আছে বেশ বড় এক জলাভূমি যা মারাত্মক ম্যালেরিয়ার উৎস।’’
এই জলাশয়টি কি ছিল রমনার ঝিল? পল্টন থেকে সেনানিবাস সরে গেলে সেখানে বিস্তীর্ণ ভূমির খানিকটা জুড়ে বাগান গড়ে তোলা হয় যা পরিচিত ছিল কোম্পানির বাগিচা নামে— এটি এখন ‘সেগুনবাগিচা’ নামে পরিচিত। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকেও পল্টনে তেমন লোকবসতি ও ঘরবাড়ি ছিল না।
সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিচারণে জানা যায়, সে সময় তাঁর বয়স ছিল সতেরো বছর। তখন তিনি পশ্চিম বাংলা থেকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাড়িতে এসেছিলেন। এবড়ো থেবড়ো মাঠের মধ্যে তখন তিনি মাত্র তিনটি বাড়ি ও দুটি নির্মাণাধীন বাড়ির দেখা পেয়েছিলেন, রাস্তায় কোনও আলো জ্বলত না। পূর্ব উত্তরে ছিল গভীর জঙ্গল ও গ্রাম, দক্ষিণে রেললাইন পেরিয়ে নবাবপুর।
মাত্র একশো বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পল্টন ও সেগুনবাগিচার এই চিত্র সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। সেগুনবাগিচার সেসব গাছপালার জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত ইমারত। তারপরও এসব এলাকায় বর্তমানে বিক্ষিপ্তভাবে বহু প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বর্ষাকালে সেগুন, বাওবাব ও রেইনট্রি গাছে ফুল ফুটেছে; দেবদারু, নিম ও ঘোড়ানিম গাছে থোকা ধরে কাঁচা-পাকা ফল ঝুলছে।
সেগুন
চন্দ্রালোকবিজয়ী লে. কর্নেল নীল আর্মস্টং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন ই অলড্রিন ঢাকা এসেছিলেন ১৯৬৯ সালের ২৭ অক্টোবর। ঢাকায় তাঁরা ছিলেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁরা এক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
সাংবাদিক ফজলুল করিম তাঁর ‘মহানগরীরর তরুসজ্জা’ নিবন্ধে সেই স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘‘চন্দ্রলোকবিহারী নীল আর্মস্টংকে একথা জিজ্ঞেস করেছিলাম— ঢাকা আপনার কেমন লাগলো? মহাকাশচারী জবাবে বলেছিলেন— এমন সবুজ শোভা আর কোথাও দেখি নি। জবাব শুনে আমাদের বুক ভরে উঠেছিল আনন্দে। প্রতিদিনকার সান্নিধ্য ভুলে যাওয়া আমার শ্যামল জন্মভূমির মূর্তিটি আরেকবার দেখি মানসচক্ষে— এক বিদেশীর চোখ দিয়ে। অনুভব করতে পারি বিলাসবহুল অভিজাত হোটেলের উচ্চতম কক্ষের বাতায়নে নজর পড়তেই দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল রমনার সবুজ সমারোহ। এদিক ওদিক অনেক ইমারত টাওয়ার মাথা তুলে দাঁড়ালেও সেগুনের দীর্ঘ বিথী, গুলমোহর, রাজশিরীষ, পাদাউক-এর দীর্ঘ সবুজ শীর্ষ আর সামনে প্রসারিত রমনার মাঠ তাদের শ্যামল মহিমায় পরাভূত করেছে মনুষ্য রচিত ইট কাঠের স্তূপকে।’’
রমনার আশেপাশে তখন ছিল সেগুনবিথী। ষাটের দশকে রমনা মাঠের পূর্ব দিকে সেগুন গাছের যে দীর্ঘ সারিটি ছিল তা আজ সেখানে নেই। বর্তমানে ঢাকা ক্লাবের সামনে, টেনিস কমপ্লেক্সের মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী রমনা পার্কের মধ্যে কিছু সেগুন গাছ সে সময়ের সাক্ষ্য বয়ে চলেছে। কিন্ত সেগুনবাগিচার সেগুন গাছগুলো আজ নেই, সেখানে এখন সেগুন গাছের বদলে দাঁড়িয়ে আছে শত শত সুউচ্চ ইমারত।
১৮৪৮ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও উদ্ভিদবিদ হুগ ফ্যালকনার (১৮০৮-১৮৬৫) কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের সুপারিনটেন্ডেন্ট ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের বাংলায় সেগুন চাষ সম্পর্কে একটি বিবরণী প্রস্তুত করেছিলেন।
তাতে দেখা যায়, উইলিয়াম রক্সবার্গ (১৭৫১-১৮১৫) বাংলায় সেগুন চাষের প্রবর্তন করেছিলেন। কলকাতা শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সূত্রপাত ঘটেছিল সেগুনগাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে। সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি সেগুন বাগান গড়ে তোলা হয়।
ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮৭১ সালে প্রথম চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে সেগুন গাছ লাগানো হয়। পরে ১৮৭৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট বনাঞ্চলে সেগুনগাছ লাগানো শুরু হয়। তবে ঢাকা শহরে সেগুন গাছ লাগানো হয়েছিল এরও আগে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ রাজ কর্মচারিদের কাঠের চাহিদা পূরণের জন্য। এভাবে কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনেরও যাত্রা শুরু হয়েছিল সেগুন বাগান স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
কাপ্তান গ্রেহাম অথবা কর্নেল স্টেকি সাহেব পুরানাপল্টনের কাছে কোম্পানির বাগিচায় সেগুন গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই থেকে এলাকাটির নাম হয়ে যায় সেগুনবাগিচা। দেশীয় সৈন্য লালবাগে স্থানান্তরিত হলে সরকার ওই বাগানটি মিউনিসিপ্যালিটির হাতে প্রদান করে। এরপরে ওই সেগুন গাছগুলো কাটা হয়।
এ সম্পর্কে ঢাকার তৎকালীন কালেক্টর মিস্টার এ. এল. ক্লে সাহেব লিখেছিলেন, ‘‘The trees have been cut down by whose order does not appear.’’ এছাড়া ফনিক্স পার্কের পিছনের দিকে ছিল কিছু সেগুন গাছ। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনার ডেভিডসনের আদেশে সেগুলো বিক্রি করা হয়।
এ দেশে সেগুন গাছের আগমন ঘটে মিয়ানমার বা বার্মা থেকে। এজন্য সেগুন কাঠ ‘বার্মা টিক’ নামে পরিচিত। টিক (Teak) সেগুনের ইংরেজি নাম, এ নাম এসেছে সেগুনগাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম টেকটোনা গ্রান্ডিস (Tectona grandis) থেকে। ঘেঁটু বা ভাঁট গাছের আত্মীয় সেগুন গাছ, দুটি গাছই এক গোত্রের। তবে আকারগত পার্থক্য অনেক বেশি, ভাঁট গুল্ম, সেগুন বৃহৎ বৃক্ষ। মিল শুধু ফুলে, দুটি ফুলের মঞ্জরির গড়ন ও ফুলের আকৃতি প্রায় এক রকম।
মিয়ানমার বা পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে সেগুন গাছ যত লম্বা ও বড় হয়, ঢাকা শহরের গাছগুলো ততটা হয় না। অরণ্যে সেগুনগাছ ১০০ থেকে ১৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছের গুঁড়ি বিশাল, অরণ্যে গুঁড়ির বেড় ১৬ থেকে ২০ ফুট হয়, ঢাকায় এরূপ বিশাল সেগুন গাছ সহজে চোখে পড়ে না।
অরণ্যের সেগুন গাছের যেরূপ সোজা ও স্বল্প শাখাবিশিষ্ট গুঁড়ি হয়, ঢাকা শহরের সেগুন গাছের গুঁড়ি তেমন হয় না, কিছু দূর গুঁড়ি লম্বা হওয়ার পর এলোমেলো ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। নবীন বা তরুণ গাছের পাতার আকার অনেক বড়, বয়স্ক পাতা তুলনামূলকভাবে ছোট।
সেগুন পাতা ধূসর সবুজ ও খসখসে। শীতের শেষে পাতা সব ঝরে যায়। বসন্তের শেষে পাতা গজানো শুরু হলেও বর্ষার প্রথমে গাছ পত্রপল্লবে ভরে যায়। বর্ষাকালেই গাছের মাথায় ও ডালের আগায় চূড়ার মতো পুষ্পমঞ্জরিতে অনেক ফুল ফোটে। ফুল অত্যন্ত ছোট, সাদা। ফল বাদামি-ধূসর, পাতলা কাগজের মতো ঠোঙায় মোড়া। বীজ বাতাসে ভেসে দূরে যায় ও চারা উৎপাদন করে। সেগুন কাঠ বিশ্বের সেরা কাঠ, দামের দিক থেকেও অনেক দামী।
জন্ম থেকে ঢাকার বাসিন্দা বিশিষ্ট বর্ষীয়ান শিশু সাহিত্যিক আখতার হুসেন জানিয়েছেন, অতীতে বারডেম হাসপাতালের পাশে রেডিও অফিস থেকে শুরু করে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত ছিল সেগুন গাছের বিস্তার। সে কথার মিল খুঁজে পাওয়া যায় দ্বিজেন শর্মার লেখাতেও। এক সময় ঢাকা ক্লাব ও রমনা এলাকায় ছিল সেগুন গাছের ছড়াছড়ি, সেগুনবাগিচায়ও ছিল সেগুন গাছ। কিন্তু বর্তমানে সেগুনবাগিচায় সেসব সেগুন গাছ নেই।
ঢাকায় অতীতের সেগুন গাছ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘‘ঢাকা ক্লাব থেকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন পর্যন্ত রমনাপার্কের কোলঘেঁষা পুরনো সেগুন বিথীটি আর নেই। ক্লাবের পাশে ও অদূরে পার্কে অনেক সেগুন গাছ সেই পুরনো দিনের স্মৃতিধারণ করে আছে।’’
ঢাকা ক্লাবের কাছের গেইট দিয়ে রমনা পার্কের ভেতরে ঢুকলেই বর্তমানে একটি ছোট্ট সেগুন বাগান চোখে পড়ে। সেগুন আছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের উল্টোদিকে রমনা পার্কের বেষ্টনীর বাইরের ফুটপাথে, ধানমন্ডি লেক উদ্যানে ও ধানমন্ডি-লালমাটিয়ার কিছু রাস্তার ধারে, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে দক্ষিণ দিকের ফুটপাতে, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের মধ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পিছনে, মসজিদের সামনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও আছে সেগুন গাছ। ঢাকায় সেগুন গাছ আরও অনেক স্থানে আছে।
দেবদারু ও ঝুল দেবদারু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বনবাণী’ কলকাতার বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। সে বইয়ে তিনি দেবদারু সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘আমি তখন শিলঙ পাহাড়ে, রূপভাবক নন্দলাল ছিলেন— কার্সিয়াঙে। তাঁর কাছ থেকে ছোট একটি পত্রপট পাওয়া গেল, তাতে পাহাড়ের ওপর দেওদার গাছের ছবি আঁকা। চেয়ে চেয়ে মনে হল, ওই একটি দেবদারুর মধ্যে যে শ্যামল শক্তির প্রকাশ, সমস্ত পর্বতের চেয়ে তা বড়ো; ওই দেবদারুকে দেখা গেল হিমালয়ের তপস্যার সিদ্ধিরূপে।’’
রবীন্দ্রনাথ নন্দলালের চিঠির উত্তরে শিলঙে বসে ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ তারিখে লিখেছিলেন দেবদারু নিয়ে একটি কবিতা:
‘‘তপোমগ্ন হিমাদ্রির ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করি চুপে
বিপুল প্রাণের শিখা উচ্ছ্বসিল দেবদারুরূপে।’’
রবীন্দ্রনাথ দেওদার ও দেবদারুকে এক বললেও নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের বনবাণীর উদ্ভিদরাজি’ প্রবন্ধে অবশ্য দেবদারু ও দেওদার একই গাছ নয় বলে উল্লেখ করেছেন। আমারও একই মত। দেওদার (Cedrus deodara) একটি কনিফার বা পাইন জাতীয় চিরসবুজ গাছ যার আকৃতি চূড়ার মতো, ৪০-৫০ মিটার লম্বা হয়, কাণ্ডের বেড় ৩ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, ডালপালা ঝুলন্ত, পাতাগুলো সূঁচের মতো, হিমালয় অঞ্চলে জন্মে, আমাদের দেশে নেই।
দেবদারু এ দেশের গাছ। দেবদারু বা দেবদার পত্রঝরা প্রকৃতির বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ। গাছ ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কচি পাতা তামাটে বাদামি, বয়স্ক পাতা সবুজ ও চকচকে। পাতা লম্বা ও কিনারা ঢেউ খেলানো। বসন্তে নতুন পাতা ও ফুল ফোটে। ফুলের রং ফিকে সবুজ, তাঁরার মতো আকৃতি, থোকা ধরে ফোটে।
ফল গুচ্ছাকারে হয়। কাঁচা ফলের রং গাঢ় সবুজ, পাকলে হয় কালো। ফল লম্বাটে ডিম্বাকার বা ডিম্বাকার, খোসা মসৃণ ও চকচকে। পাখি পাকা ফল খায়। শাঁস পাতলা, ভিতরে একটি বড় ডিম্বাকার ধূসর বাদামি রঙের বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা হয়।
দেবদারুর ইংরেজি নাম False Ashoka বা Indian fir tree, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Monoon longifolium ও গোত্র Annonaceae। পূর্বে এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল Polyalthia longifolia। এ দেশে দুই ধরনের দেবদারু গাছ দেখা যায়। সাধারণ দেবদারু ও ঝুল দেবদারু বা উইপিং দেবদারু। ঝুল দেবদারু পেনডুলা ভ্যারাইটির। ঝুল দেবদারু গাছ সাধারণ বা দেশি দেবদারুর মতো লম্বা ও বড় হয় না, ডালপালা ও পাতাগুলো ঝুলন্ত, গাছের শীর্ষদেশ চূড়ার মতো। দেখতে অনেকটা পাইন গাছের মতো দেখায়।
বসন্তে থোকা ধরে ঘিয়া রঙের তারার মতো ছোট ছোট ফুল ফোটে, গ্রীষ্মে সবুজ থোকায় রঙের ডিম্বাকার থেকে গোলাকার ফল ধরে ও বর্ষাকালে ফলগুলো পেকে কালো হয়ে যায়। বাদুড়রা দেবদারু ফল খেতে খুব পছন্দ করে, হলদে শাঁস খেয়ে বিচি মাটিতে ফেলে দেয়। ভেজা মাটিতে সেসব বীজ থেকে চারা গজায়।
ঢাকা শহরে ঝুল দেবদারু মোটেই দুষ্প্রাপ্য নয়। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চের ঠিক বিপরীত পাশে বৃত্তাকার সীমানা জুড়ে শোভা পাচ্ছে এক সারি ঝুল দেবদারু গাছ। সেসব গাছের ডালপাতা যেন ঝরণার স্রোতধারার মতো নেমে এসেছে মূল গাছ থেকে, পাতাগুলোর মধ্যে চলছে বিভিন্ন মাত্রায় সবুজের খেলা। প্রশাখাগুলোর শীর্ষে তামাটে সবুজ কচি পাতা, তার উপরে হালকা সবুজ নবীন পাতা, এর পিছনেই ঘন সবুজ বয়স্ক পাতা। শ্রাবণে সেসব বুড়ো পাতাদের কোল ভরিয়ে দিয়েছে আঙুরের থোকার মতো গাঢ় সবুজ ফল, কোনোটা পেকে হয়েছে বেগুনি কালো।
ঢাকায় ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মহাখালী ডিওএইচ ও অন্যান্য কিছু স্থানেও ঝুল দেবদারু আছে, কয়েকটা ঝুল দেবদারু আছে আগারগাঁও মোড় থেকে শিশুমেলা পর্যন্ত সড়কের পাশে, গুলিস্তানের কাছে শহীদ মতিউর পার্কে, বঙ্গভবনের সীমানা প্রাচীরে। ঢাকা শহরে বর্তমানে ঝুল দেবদারুর কোনও অভাব নেই।
কিন্তু সত্তরের দশকে ঢাকা শহরে ঝুল দেবদারু ছিল না বললে চলে। সত্তরের দশকে দ্বিজেন শর্মা নটরডেম কলেজে একটি বাগান করতে চাইলে তৎকালীন অধ্যক্ষ ফাদার বেনাস সে বাগানের একটি পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হয়েছিলেন। বাগানের সে মডেলটি ছিল রীতিমুক্ত ইনফর্মাল গার্ডেনের। সে মডেলে নটরডেম কলেজের বৃক্ষশোভায় প্রাধান্য পেয়েছিল গগনশিরীষ ও রয়েল পাম।
দ্বিজেন শর্মা তাঁর জীবনস্মৃতি ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ বইয়ে ‘পুনশ্চ ঢাকা: সুবর্ণের সন্ধানে’ রচনায় লিখেছেন, ‘‘আমরা ঝুল-দেবদারু অনেক খুঁজেছি, একটাই কেবল পেয়েছিলাম এখনকার পুরান এয়ারপোর্টের উল্টোদিকে বিমানবাহিনীর ক্লাবের আঙ্গিনায়, ঢুকতে সাহস হয়নি। শেষে কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল ১৯৭২ সালে।’’ পরবর্তী সময়ে আশির দশকে নতুন এয়ারপোর্টে যেতে রাস্তার ধারে লাগানো হয়েছিল সারি করে অনেকগুলো ঝুল দেবদারুর গাছ। বর্তমানে সড়ক সম্প্রসারণে সেসব গাছ কাটা পড়েছে।
ঢাকা শহরে দেবদারু গাছ আছে অনেক। আবাহনী মাঠের পাশে ধানমন্ডি ১২/এ রোডের সড়কদ্বীপে ও জাতীয় জাদুঘরের পশ্চিম দিকে পুকুরের পাড়ে রয়েছে বয়স্ক কিছু দেবদারু গাছ। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ দীর্ঘ একটি দেবদারুবীথি রয়েছে জাতীয় সংসদ ভবনের পূবদিকের সীমানার মাঠে।
বাওবাব বৃক্ষ
পানি না হলে গাছ বাঁচে না। অল্প-বেশি তার পানি লাগেই। মরুভূমির গাছেরা তাদের দেহে পানি জমাও করে রাখে, যাতে প্রচণ্ড খরাতেও ওরা টিকে থাকতে পারে। ক্যাকটাসও তার দেহে পানি জমিয়ে রাখে। কোনও কোনও ক্যাকটাস গাছ ধরে ঝাঁকিয়ে তাতে কান পাতলে ভেতর থেকে খল খল করে পানির আওয়াজ শোনা যায়। ক্যাকটাসের দেহে সঞ্চিত পানি থাকে, তবে পরিমাণে খুব কম।
কিন্তু এমন এক গাছ আছে যেটা আস্ত একটা পানির ট্যাংকের মতোই। ভাবা যায়? একটা গাছের কাণ্ডের ভেতরে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার লিটার পানি জমা থাকে! অনেক পানির ট্যাংকেও বোধহয় এত পানি ধরে না। আফ্রিকান বাওবাব গাছগুলো এমনই। এজন্য বাওবাব গাছকে বলা হয় ‘জীবনবৃক্ষ’ বা ‘ট্রি অব লাইফ’।
কেননা, বাওবাব গাছ পানি ধরে রাখে শুধু নিজের জন্যই না, খরাপীড়িত আফ্রিকায় প্রচণ্ড খরার সময় যখন তীব্রভাবে পানির অভাব দেখা দেয়, তখন স্থানীয় নোমাডিক গোষ্ঠীর লোকেরা বাওবাব গাছের পানি খেয়ে জীবন রক্ষা করে। বাওবাব গাছ না থাকলে খরার সময় কালাহারি মরুভূমির অনেক লোক হয়ত মরেই যেত। ওসব এলাকার লোকেরা খরার সময় খড়ের মতো এক ধরনের ঘাসের ফাঁপা কাণ্ডকে নলের মতো ব্যবহার করে বাওবাব গাছের কাণ্ডে ঢুকিয়ে দিয়ে সেখান থেকে পানি চুষে খায়। এমনকি সে নল দিয়ে পানি বেরও করে আনে। শুধু মানুষ নয়, বানরেরাও জীবনবৃক্ষ বাওবাবের ফল খেয়ে জীবন বাঁচায়। এজন্য বাওবাব গাছের আর এক নাম ‘মাংকি ব্রেড ট্রি’।
বাওবাব আফ্রিকা অঞ্চলের বিশেষ করে মাদাগাস্কারের পাতাঝরা প্রকৃতির এক বিশেষ বৃক্ষ। জীবন বাঁচায় বলে বাওবাব মাদাগাস্কারের জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা পেয়েছে। মাদাগাস্কারে মোরনদাভার কাছে আছে দুধারে বাওবাব গাছ লাগানো সড়ক। অস্ট্রেলিয়াতেও বাওবাব গাছ আছে। আমাদের দেশে ঢাকা শহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে ও রমনা উদ্যানেও বাওবাব গাছ আছে। পূর্ণবয়স্ক বাওবাব গাছ প্রায় ৩০ মিটার লম্বা ও ১১ মিটার চওড়া হয়। গাছের কাণ্ড বা গুড়ি এত মোটা আর ফাঁপা হয় যে, গাছ মাটি থেকে পানি শুষে দিব্যি সেই ফাঁপা জায়গায় জমিয়ে রাখতে পারে। গাছের কাণ্ডের আকৃতিও অনেকটা ব্যারেলের মতো, বেশ মোটা। বিশেষ করে গোড়ার দিকটা বেশ মোটা। বাওবাব বাঁচেও অনেক দিন।
কথিত আছে যে, আফ্রিকাতে হাজার বছর বয়স্ক বাওবাব গাছও আছে। গাছ পুরনো হয়ে মরে গেলে ওর ফাঁপা কাণ্ডের ভেতর স্থানীয় লোকেরা শস্যগোলা বানায়, সেখানে শস্যদানা ও গবাদিপশুর জন্য পানি মজুদ করে। এমনকি কোনও কোনও বাওবাব গাছের কাণ্ড এত বড় যে তার ফাঁপা জায়গা ঘরের মতো, সেখানে প্রাচীনকালের মানুষেরা গুহার মতো বসবাস করত।
প্রাচীনকালে বাওবাব গাছ নিয়ে পৌরাণিক কাহিনিও কম ছিল না। প্রাচীন মানুষেরা বাওবাব গাছকে বলত ‘উল্টো গাছ’ বা ‘আপসাইড ডাউন ট্রি’। কেননা, পাতা ঝরে যাওয়ার পর যে কেউ গাছটাকে দেখে মনে করবে, কোনও কারণে হয়ত গাছটা শেকড়বাকড়সমেত উল্টে মাটির মধ্যে পুঁতে আছে। আরব দেশের রূপকথার দৈত্য একদিন খুব রেগে গিয়ে গাছ উপড়ে ফেলে তা উল্টো করে মাটিতে পুঁতে রেখে যায়, গাছের মাথা সেঁধে যায় মাটির মধ্যে আর শেকড় থাকে শূন্যে।
বাওবাব নিয়ে আরও কিছু মজার পৌরাণিক কাহিনি আছে। সে কাহিনিতে বাওবাবই নাকি পৃথিবীর মাটিতে প্রথম গাছ। বাওবাবের পরে আসে তাল সুপারি নারকেল ইত্যাদি পাম গাছেরা। পাম গাছেরা যখন সরু কাণ্ড নিয়ে তর তর করে লম্বা হতে লাগল, বাওবাব গাছকে ছাড়িয়ে যেতে লাগল, তখন বাওবাব পাম গাছের মতো লম্বা হওয়ার জন্য কান্না জুড়ে দিল। এরপর যখন লাল ফুলের শোভা নিয়ে হাজির হল শিমুল বৃক্ষ, বাওবাব চাইল বাওবাব গাছেও যেন ও রকম সুন্দর ফুল ফোটে।
এরপর একদিন বাওবাবের দেখা হলো এক অনন্য সুন্দর ডুমুর গাছের সঙ্গে। বাওবাব তার দেহে ডুমুরের মতো ফল ধরাতে চাইল। এতে ঈশ্বর রাগান্বিত হয়ে বাওবাব গাছকে মাটি থেকে উপড়ে ফেলল। পরে মাটিতেই আবার পুঁতে দিল উল্টো করে। সেই থেকেই বাওবাবের এমনই উল্টো গড়ন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে আফ্রিকা থেকে বাওবাব এক সময় শ্রীলংকা ও ভারতে পৌঁছে। এ দেশে কবে কখন এসেছে তা জানা নেই। জানা যায়, নীলক্ষেতে এক সময় একটি বাওবাব গাছ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবন নির্মাণের সময় সেটি কাটা পড়ে। বলধা গার্ডেনেও একটি বাওবাব গাছ ছিল। ঝড়ে পড়ে সেটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে সেসব কথা লিখে রেখে গেছেন।
তবে বাওবাব যে এ দেশে নবাগত সে কথাও তিনি ১৯৯৪ সালে ওই বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণের সময় ভূমিকায় লিখেছিলেন। তাতে মনে হয়, বর্তমানে রমনার দুটি গাছ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে থাকা বাওবাব গাছটি প্রায় একই সময়ে রোপিত, বয়সও কাছাকাছি।
এ তিনটি গাছেই প্রতি বছর শীতকালে পাতা ঝরে যায়, নতুন পাতা গজায় মে মাসে আর ফুল ফোটে জুন-জুলাইতে। ফুল বড়, সাদা ও লম্বা বোঁটায় ঝুলতে থাকে। ডালের আগায় রাতে ফুল ফোটে, তবে দিনেও সেসব ফোটা ফুল দেখা যায়। ফুলের পাঁচটি পাপড়ি উপরের দিকে উঠানো থাকে, এজন্য সোনালী হলুদ পরাগকেশরগুলো নিচের দিকে গুচ্ছবদ্ধভাবে ঝোলে। ফল হয় লম্বা বোঁটায়, ফল বেলনাকার সবুজ বা হালকা বাদামি, ভিতরে বীজ থাকে। ফলের শাঁস দিয়ে তৈরি করা শরবত খাওয়া যায়। কাঠ নরম ও ভুসভুসে, তবে বাকলের আঁশ অত্যন্ত শক্ত।
কথিত আছে যে, বাওবাব গাছের বাকলের আঁশ দিয়ে তৈরি করা দড়ি দিয়ে নাকি হাতিও বেঁধে রাখা যায়। ফলের ও বীজের ঔষধি গুণ আছে। ঢাকা শহরে কেনও বাওবাব গাছ ছড়ালো না সেটাই ভাবার বিষয়। হয়ত ওর জন্য এ শহরের পরিবেশ ততটা যুৎসই না, যেভাবে ওর গড়ন হওয়ার কথা, বাড়ার কথা সেভাবে সে বাড়ছে না। ঢাকা শহরের বাওবাব গাছ যেন তার স্বভাবগত আকৃতিতে এখনও যেতে পারেনি।
পরিবেশবন্ধু নিম
নিম নিয়ে একটা সংস্কৃত শ্লোক আছে। সেখানে বলা হয়েছে, বসন্তকালে যে ভ্রমণ না করে, নিমভোজন না করে ও যুবতী স্ত্রীর সান্নিধ্য না পায় তার মরণই ভালো। নিমের এমনই গুণ! নিমকাঠ জ্বেলে ভাত রান্না করলেও নাকি সে হাঁড়ির ভাত তেতো হয়ে যায়। নিমকাঠ দিয়ে আসবাবপত্র বানালে তা ঘুণপোকা পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখে না।
স্বাদে তিতা বলে নিমের অনেক বদনাম। এর ছাল-বাকল, পাতা-শেকড় সবই তিতা। কিন্তু পাকা ফল মিষ্টি বলে পাখিদের খুব পছন্দ। তিতা বলেই নিমের এত কদর, রোগ সারানোর তার অদ্ভুত ক্ষমতা। বিশেষ করে বসন্তকাল এলে অনেকেই যখন বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে চিন্তিত থাকে, সে সময় নিম আবির্ভূত হয় বসন্ত রোগের ত্রাণকর্তা হিসেবে। বসন্তকালে নিমের হাওয়া প্রশান্তিকর। তিতা বলেই নিম কৃমিনাশক ও ডায়াবেটিস বা রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রক।
এ রকম অনেক ভেষজগুণের এক গাছ হলো আমাদের দেশের গাছ নিম। নিমের অন্য নাম নিম্ব, চাকমা ভাষায় নিম ও মুরং ভাষায় নিমুই। সংস্কৃত নিম্ব থেকে নিম নামের উদ্ভব। নিমগাছের জন্ম মিয়ানমার। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপে প্রচুর নিম গাছ দেখা যায়। ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যবৃক্ষ নিম। ইরানের দক্ষিণাংশেও নিমগাছ আছে। এ দেশের প্রায় সব জায়গায় নিমগাছ কম-বেশি দেখা যায়। খরাপ্রবণ এলাকাতেও নিমগাছ ভাল জন্মে। বরেন্দ্র এলাকায় বেশ নিম গাছ আছে।
বছর পাঁচেক আগে কলকাতা শহরে এক লাখ নিম গাছের চারা লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেখানকার মেয়র। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাতাসে আরও অক্সিজেন যোগান দেওয়ার জন্য প্রচুর সংখ্যায় নিমগাছ লাগানো হবে।’’
রাজস্থানের জয়পুর-যোধপুর থেকে শুরু করে হায়দরাবাদ, কোচি, পুনে শহর জুড়ে বিপুল সংখ্যায় নিমগাছ লাগানোয় সেখানকার বায়ুদূষণ অনেক কমেছে, বাতাস পরিশুদ্ধকরণে এর সুফল পাওয়া গেছে। এছাড়া মহানগরের বিভিন্ন সড়ক দ্বীপ ও মোড়ে ফোয়ারা বসিয়ে বিশেষ ধরনের জলপ্রবাহের মাধ্যমে বাতাসের ধূলিকণা ও দূষণকে কমানো যায়। নিমগাছের পাতা ছোট বলে ঝড়ের সময় বাতাস আটকায় কম, তা ছাড়া এর ডালপালা ও গাছ অনেক শক্ত। সেজন্য ঝড়বাতাসে সহজে ভাঙে না। তাই দিল্লি ও কলকাতার মতো ঢাকা শহরের পথতরু হিসেবে নিমগাছ লাগানো যায়।
নিম আমাদের দেশীয় পরিবেশবান্ধব মহা উপকারী গাছ, বায়ু শুদ্ধকরণে সেরা গাছ। এ জন্যই হয়তো নিমফুলের আগমনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখেছেন দূষিত অন্ধকারকে পরিশুদ্ধ করার আলোময় ইশারা:
‘‘একদিন নীমফুলের গন্ধ অন্ধকার ঘরে
নিয়ে এলো অনির্বচনীয়ের আমন্ত্রণ।’’
এখনও গ্রাম-বাংলায় অনেকে সন্তান জন্মের পর আঁতুরঘরের বেড়ায় নিমপাতা ঝুলিয়ে রাখে, বসন্ত রোগ হলে নিমপাতার বিছানায় শোয়ায়। লোকায়ত জ্ঞানে নিম জীবাণুনাশী ও বাতাস পরিশুদ্ধকারী। দাঁতে যাতে জীবাণুও সংক্রমণ না হয় সেজন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতেন, এমনকি কুষ্ঠরোগীকে সারিয়ে তুলতেও তার গায়ে মেখে দিতেন নিমবীজের তেল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখনও অনেকে মহিষের কাঁধের ঘা সারাতে নিমতেল ব্যবহার করেন।
লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল ১৯৪৭ সালে নিমগাছের এই মহা উপকারিতার কথা বুঝতে পেরে ‘নিম গাছ’ নামে একটি ছোট গল্প লিখেছিলেন। সে গল্পে তিনি নিম গাছকে তুলনা করেছেন একজন গৃহকর্ম-নিপুণা গৃহবধূর সঙ্গে। নিম গাছ যেমন মানুষের নানা উপকারে আসে অথচ কেউ তার সঠিক মূল্যায়ন করে না, তেমনি রোজকার জীবনে সংসারে একজন গৃহবধূ যে কত শত কাজ করে তারও যথার্থ মূল্যায়নও হয় না। আবার ভারত চন্দ্র রায়গুণাকরকে দেখি তাঁর এক কবিতায় নিমগাছ নিয়ে সরস রসিকতা করতে—
‘‘সুয়া যদি নিম দেয় সে হয় চিনি
দুয়া যদি চিনি দেয় নিম হন তিনি।’’
সুয়া হলো ছোট বউ আর দুয়া হলো বড় বউ। এ পংক্তি দুটির আর ব্যাখ্যার দরকার হয় না। নিম তিতা, চিনি যে মিঠা তা আমরা সকলেই জানি। কবি কাজী নজরুল ইসলামও পেয়েছেন নিম ফুলে মধু লুটতে আসা ভ্রমরের মতো প্রেমের এক দুর্নিবার আকর্ষণ—
‘‘ডালিম-দানায় রং ধরেছে, ডাঁশায় নোনা আতা,
তোমার পথে বিছায় ছায়া ছাতিম তরুর ছাতা।
তেম্নি আজো নিমের ফুলে
ঝিম্ হয়ে ঐ ভ্রমর দুলে,
হিজল-শাখায় কাঁদছে পাখি বউ গো কথা কও ॥’’
ঢাকা শহরে নিমগাছ সম্পর্কে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার উপলব্ধি হলো, ‘‘নিমের এত গুণ থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় তার কোনো সুবিন্যস্ত বীথি নেই। অবশ্য শহরের সর্বত্রই এই গাছ ছড়িয়ে আছে এবং সহজেই চোখে পড়ে।’’ ঢাকা শহরে রমনা পার্কের মধ্যাঞ্চলে অনেকগুলো নিমগাছ লাগিয়ে একটি নিমবীথি তৈরি করা হয়েছে। সেটি অপেক্ষাকৃত তরুণ বীথি।
নিম এ দেশের খুব পরিচিত এক গাছ। নিমগাছ বহুবর্ষজীবী দ্রুতবর্ধনশীল চিরসবুজ গাছ। তবে শীতকালে গাছের অনেক পাতা ঝরে যায়। এ গাছ ১৫ থেকে ২০ মিটার লম্বা হয়। ডালপালা ছড়ানো। পাতা পক্ষল ও যৌগিক। পাতার কিনারা খাঁজকাটা ও অগ্রভাগ সরু। ফুল সুগন্ধযুক্ত ও সাদা, ছোট, ঝুলন্ত মঞ্জরিতে ফুলগুলো ফোটে। একটি পুষ্পমঞ্জরিতে প্রায় ৩০০ ফুল থাকে। একই গাছে উভলিঙ্গী ও পুরুষ ফুল ফোটে।
ফল ডিম্বাকার, ছোট, খোসা সমৃণ, হলুদাভ সবুজ, থোকায় ধরে। ফলের ভিতরে একটি শক্ত বীজ থাকে, কখনো কখনো দুটি বীজও থাকে। বীজের খোসা বাদামি। বীজ থেকে চারা হয়। নিমের ইংরেজি নাম Neem, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম অ্যাজাডার্কটা ইন্ডিকা (Azadirachta indica) ও গোত্র মেলিয়েসী (Meliaceae)।
ঘোড়ানিম বা মহানিম
নিম এ দেশে অত্যন্ত পরিচিত এক গাছ। ঘোড়ানিম বা মহানিম নিমেরই এক জ্ঞাতি। দেখতেও অনেকটা নিম গাছের মতো। ভারো করে লক্ষ্য না করলে পার্থক্যটা ঠিক চোখে পড়ে না। নিম গাছের চেয়ে ঘোড়ানিমের গাছ ছোট। অনাদিকাল থেকে এ দেশে নিম গাছ জন্মাচ্ছে। নিমকে একুশ শতকের বৃক্ষ ঘোষণা করে নিমের গুরুত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিম আর ঘোড়ানিম যেহেতু কাছাকাছি গাছ, সেহেতু ঘোড়ানিমেরও গুরুত্ব বেড়েছে।
বেদসুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘এই মহানিম্ব ত্রাসকারী এবং অন্যান্য কীটের ভীতিকে অতিক্রম করে’’। তবে কি মহানিম সে যুগেও ডিসইনফেক্ট্যান্টের কাজ করতো? এ সম্বন্ধে চরকের অষ্টম অধ্যায়ে ৯৯ সুক্তিতে বলা হয়েছে, নবপ্রসূত শিশুর রক্ষাবিধির অনুষ্ঠান করতে আঁতুর ঘরটি ঘোষালতা, মহানিম বা নিম শাখা, খদির শাখা, শেয়ালকুলের শাখা, ফলসার শাখা ইত্যাদি দিয়ে বেষ্টন করতে। আগন্তুক নবজাতককে রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষার জন্য সে আমলেও ছিল ঘোড়ানিমের নিদান।
ঘোড়ানিম ছিল পাহাড়ের গাছ। হিমালয়ের কোলে জন্মাতো। এ জন্য এ গাছকে বলা হয় পাহাড়ি নিম, অন্য নাম বকাইন বা বকায়ন। কালক্রমে তা এই সমতল বাংলার গাছ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বর্তমানে অনেকেই নিম বাদ দিয়ে ঘোড়ানিমের গাছ লাগাচ্ছেন। কারণ এ গাছ নিমের চেয়ে দ্রুত বাড়ে। আর ফার্নিচারের জন্য নিম কাঠের সমতুল্য, সহজে ঘুন ধরে না। মহানিম কি করে ঘোড়ানিম হলো তা বোধগম্য নয়। নাম নিয়ে বিভ্রাট কম নেই।
ঘোড়ানিমের ফুল লাইলাক ফুলের মতোই সুন্দর, এজন্য এর ইংরাজি নাম Persian lilac, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম মেলিয়া অ্যাজাডার্কটা (Melia azadirach) ও গোত্র মেলিয়েসী (Meliaceae)। ঘোড়ানিমের গাছ মাঝারি আকারের বৃক্ষ প্রকৃতির। সাধারণত ৭-৮ মিটার লম্বা হয়। গাছের বাকল কালচে ধূসর। মহানিমের পাতা সাধারণ নিমের পাতার চেয়ে একটু ছোট। পাতার কিনারা করাতের মত খাঁজকাটা। শাখা প্রশাখা পাতা সব সময় নিচের দিকে ঝুলে থাকে। পাতা সামান্য তেতো। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গাছ থেকে এক ধরনের দুধ জাতীয় রস বের হয়। এ রস মাদক ও বিষাক্ত। এ সময় মহানিমের বাকল তোলা উচিত নয়। শীতে পাতা ঝরে যায়, বসন্তে নতুন পাতা বের হয় আর গ্রীষ্মে ফুল ফোটে।
মহানিমের ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। ফুল ছোট ছোট, নীল বেগুনি আভাযুক্ত সাদা, মধুগন্ধ বিশিষ্ট। ফুল ফোটার সময় গাছের তলায় প্রচুর ফুল ঝরে পড়ে। ফুল ফোটে থোকা ধরে। একটি থোকায় প্রচুর ফুল ফোটে। ফুল শেষে গোলাকার থেকে ডিম্বাকার ছোট ছোট ফল থোকা ধরে গাছে ঝুলতে থাকে। বর্ষাকালে কাঁচা ফল দেখা যায়। কাঁচা ফলের রঙ সবুজ, শুকিয়ে গেলেও গাছে ঝোলে। ফলের ভেতরের শাঁস তেলে ভর্তি। ফল পাকে শীতকালে। বীজ থেকে সহজে চারা হয়। তবে শেকড়ের কাটিং লাগালেও গাছ হয়। নিমের মতো মহানিমের গাছ অত বেশি দিন বাঁচে না।
এই গাছটি বর্তমানে রাস্তার দুধারে বেশ লাগানো হচ্ছে। ঢাকা আরিচা রোডের দুধারে লাগানো মহানিমের ছোট ছোট গাছগুলোয় মার্চ-এপ্রিলে গেলে ফুল দেখা যায়। এ দেশ ছাড়াও গাছটি ভারতের উত্তর প্রদেশে প্রচুর জন্মায়। পশ্চিম এশিয়া, বেলুচিস্তান, ইরান ও চীনেও মহানিমের অনেক গাছ আছে।
দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে ঢাকা শহরে ঘোড়ানিম গাছের অবস্থান নির্দেশ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘ঘোড়ানিম নিমের মতো বহুগুণান্বিত নয়। ঢাকার ময়মনসিংহ রোড, বক্সীবাজার রোড ও পার্ক অ্যাভিনিউতে দৈবাৎ দু-একটি ঘোড়ানিম চোখে পড়ে। একটি করে বড় গাছ আছে পল্টনে জেসন ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির চত্বরে ও জিয়া উদ্যানের (চন্দ্রিমা উদ্যানের) পশ্চিম প্রান্তে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন করতোয়ার দেয়ালঘেঁষে।’’
ঢাকা শহরে চন্দ্রিমা উদ্যানে ও রমনা পার্কে কয়েকটি ঘোড়ানিম গাছ আছে, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও চন্দ্রিমা উদ্যানেও আছে। কয়েকটি বড় ঘোড়ানিম গাছ আছে বঙ্গভবনের পাশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শহীদ মতিউর রহমান শিশু পার্কের ভেতরে।
কুসুম
বর্ষাকাল। মাথার উপরে কালচে ধূসর জমাট মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির ফোটা পড়ছে না। রমনা উদ্যানের অরুণোদয় তোরণ দিয়ে ঢুকে শতবর্ষী কুসুম গাছগুলোর তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম দুজন। বৃষ্টি পড়ছে না, কিন্তু বিশাল বিশাল কুসুম গাছ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে কুসুমের পাকা ফল।
রোবায়েত রবিন একটা ফল কুড়িয়ে নিয়ে তার সবুজ পুরু খোসা খুলে ফেলার পরই ভেতরে ফলের শাঁস দেখা গেল। অবিকল কাঁচা ডিমের কুসুমের মতো, তেমন কমলা হলুদ রঙ, জলজলে রসাল। দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর অবশেষে রবিন অমন রসালো ফল দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না, খেয়ে ফেলার পর বলল, দারুণ তো! না জেনে শুনে যে কোনও ফল খাওয়া অনেক সময় বিপজ্জনক হতে পারে জেনেও কুসুম ফলের আস্বাদ নেওয়ার সুযোগ জীবনে বারবার আসে না ভেবে মুখে নিয়ে আমিও খেলাম, বেশ টক, নরম রসাল শাঁসের মধ্যে একটা বাদামি রঙের বিচি, গোলাকার কিডনি আকৃতির, শক্ত, দেখতে কিছুটা কাজুবাদামের মতো, তবে অনেক ছোট, বৃত্তাকার ও খাটো।
কুসুম ফলের পোশাক (খোসা) না খুললে হয়ত আজ জানাই হতো না যে এর নাম কুসুম কেন হলো। বাংলা ভাষায় কুসুম মানে ফুল। এ গাছের ফুলের তেমন কোনও বাহারি রূপ নেই যে তাকে ফুল গাছ হিসেবে সমাদর করা যায়। তাহলে একে কুসুম নামে কেন ডাকা হয়? উত্তরটা সেদিন রমনায় বসেই হাতেনাতে পেয়ে গেলাম।
ফলের শাঁস অবিকল ডিমের হলুদ কাঁচা কুসুমের মতো, তাই এর নাম কুসুম। ডিম্বাকার ফলের অগ্রপ্রান্ত কিছুটা সূঁচাল, খোসা খসখসে মসৃণ, ধূসর সবুজ, ফল ছোট ডিম্বাকার, বোঁটা খাটো, কয়েকটি ফল থোকায় থাকে। বসন্তে ফুল ফোটে ও বর্ষাকালে ফল পাকে। কাঁচা ফলের রং ধূসর সবুজ, পাকলে হয় বাদামি।
এ ফল বাদুড়ের খুব প্রিয়, রাতে ওরা কুসুমবাগে আসে ফল খেতে। এক ধরনের লাল রঙের গান্ধি পোকাও (রেড কটন বাগ) দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে রয়েছে গাছের তলায়। হয়ত ওরাও তুলার গুটি থেকে রস চুষে খাওয়ার মতো কুসুম ফলের রস চুষে খায়।
দ্বিজেন শর্মা ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে ১৯৬৫ সালে দেখা ঢাকার সেরা কুসুম বীথিটির উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘বসন্তে কোনোদিন হেয়ার রোডে রাষ্ট্রপতি ভবনের লাগোয়া পার্কের বুক চিরে যাওয়া ছোট্ট পিচঢালা পথে আপনি ঢাকা ক্লাবের দিকে এগোলে এই পথটির শুরুতে যে দুসারি মহীরুহ পাতার ঘনরক্তিম ঔজ্জ্বল্য আপনাকে বিস্মিত করবে, এরাই কুসুম। ঢাকার অন্যত্র, বিশেষত বক্সীবাজার অঞ্চলে কুসুম আছে।’’
এই সরু পিচঢালা পথটি শুরু হয়েছে হেয়ার রোড থেকে রমনা উদ্যানের উত্তরায়ন গেট দিয়ে ভেতর ঢোকার পর। সেখানে গেইটের পাশেই রয়েছে শতবর্ষী কুসুম গাছ। এরপর সেই পিচঢালা পথটি সোজা চলে গেছে রমনা পার্কের পশ্চিম দিকে, অস্তাচল গেটে গিয়ে যার সমাপ্তি, এরপর সেই গেট দিয়ে বেরিয়েই দক্ষিণে ঢাকা ক্লাবের অবস্থান। এই পিচঢালা পথের দুপাশে শুরুতেই রয়েছে কয়েকটা শতবর্ষী কুসুমগাছ যার ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে মহিলা অঙ্গন ও অন্যপাশের বিশ্রাম নেওয়ার পাকা স্থান পর্যন্ত।
এ গাছগুলোর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে বসন্তকালে। কুসুমের যে দুর্লভ বৈশিষ্ট্যটি সহজে আকৃষ্ট করে তা হলো শীতে পাতা ঝরে যাওয়ার পর বসন্তে নতুন পাতার দ্রুত আগমন, রক্তিম কচিপাতার স্ফূরণ যেন পুষ্পশোভার মতোই গাছের ডালপালাকে করে তোলে অপূর্ব সুন্দর ও আলোকিত। এরূপ রক্তিম কচি পাতার আগমন বসন্তে প্রাচুর্য নিয়ে হাজির হলেও তা চলতে থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। বিক্ষিপ্তভাবে সবুজ পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সেসব রক্তিম পাতারা সৃষ্টি করে আলাদা এক সৌন্দর্য।
কুসুমের ইংরেজি নাম Lac tree, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম স্লিচেরা ওলিওসা (Schleichera oleosa)
ও গোত্র স্যাপিনডেসি (Sapindaceae)। সুইজারল্যান্ডের উদ্ভিদবিদ জে.সি. স্নিচারের নামানুসারেই কুসুমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের প্রথমাংশ স্নিচেরা রাখা হয়েছে। ওলিওসা লাতিন শব্দের অর্থ তৈলসমৃদ্ধ। কুসুমের বীজ থেকে তেল হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের বাগানে দেখেছি অনেকগুলো কুসুম গাছ সেগুলো লাগানো হয়েছে গবেষণা কাজের জন্য লাক্ষা পোকার পোষক বা আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ হিসেবে। প্রাচীনকালে এ গাছের ডালে বাসা বাঁধা লাক্ষা কীট থেকে তৈরি করা হতো লাক্ষা যা সীলগালা করা ও গহনা শিল্পে ব্যবহৃত হতো। বীজের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হতো।
কুসুম গাছ দীর্ঘদেহী বিশাল পাতাঝরা স্বভাবের বৃক্ষ, বাঁচে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ বছর। এ গাছের বাকল ধূসর, মসৃণ, মোটা ও পুরু। পাতা যৌগিক, চওড়া, পত্রকগুলোর আকার আকৃতি অসম। শীতে পাতা ঝরে যায়। বসন্তের পর গাছ আবার উজ্জ্বল সবুজ পাতায় ভরে যায়। এরপর ফুল আসে। মঞ্জরিতে ছোট ছোট অনেক ফুল ফোটে, ফুল অনাকর্ষী ও ফিকে হলদে রঙের।
কুসুম নাম নিয়ে বিভ্রান্তির কারণ এ নামে এদেশে আর একটি গাছ আছে যা শীতকালে তেলবীজ ফসল হিসেবে মাঠে চাষ করা হয়। সে গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম কার্থামাস টিংকটোরিয়াম (Carthamus tinctorium) ও গোত্র অ্যাস্টারেসি (Asteraceae)।
এই কুসুম গাছ কাঁটাযুক্ত বর্ষজীবী বিরুৎ, গাছ বড়জোড় দেড় মিটার লম্বা হয়। কমলা-হলুদ ফুল ফোটে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায় রচিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ প্রথম খণ্ডে কৃষি অধ্যায়ে কুসুম সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘‘পদ্মা ও ধলেশ্বরীর নদীদ্বয়ের মধ্যস্থিত স্থানসমূহে, মানিকগঞ্জ, হরিরামপুর এবং নবাবগঞ্জ থানার এলাকায় এবং বিক্রমপুরের কোনও কোনও স্থানে পূর্ব্বে প্রচুর কুসুম ফুল উৎপন্ন হইত। বর্তমান সময়ে কুসুম ফুলের চাষ একেবারে লোপ পাইয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।’’
ঢাকা জেলার মতো উৎকৃষ্ট কুসুম ফুল ভারতবর্ষের আর কোথাও জন্মাত না। চীনের কুসুম ফুল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, লন্ডনের বাজারে এক সময় চীনা কুসুম ফুলের পরই ঢাকাই কুসুম ফুলের সমাদর ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। কুসুম ফুল থেকে লাল ও পীত রং তৈরি হতো, বীজ থেকে হতো তেল। এখনও টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের কোনও কোনও স্থানে সীমিত আকারে কুসুমের চাষ হয়।
তরু পাপীদের সুবুদ্ধি হোক
মহানবীও গাছ ভালবাসতেন। একদিন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে যচ্ছিলেন এক সফরে। ক্লান্ত হয়ে তাঁরা বিশ্রাম নিতে বসলেন মাঝ পথে এক মরুদ্যানে। এমন সময় দেখেন, দূরে গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে কয়েকজন লোক। কিন্তু ওদের মধ্যে একজন আপন আনন্দে গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে তিনি খুব দুঃখ পেলেন। এগিয়ে গেলেন লোকটার কাছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কেন তুমি অযথা গাছের পাতা ছিঁড়ছো?’’
‘‘ছিঁড়লে ক্ষতি কি? ভালো লাগছে তাই ছিঁড়ছি।’’
মহানবী তখন লোকটির আরও কাছে গিয়ে তাঁর চুল টেনে ধরলেন। লোকটি উঃ আঃ করতেই মহানবী বলে উঠলেন, ‘‘এত অল্পতেই তুমি ব্যাথা পাচ্ছ? যদি তোমার চুল টেনে উপরে ফেলতাম তবে কেমন লাগত?’’
লোকটি তখন বললেন, ‘‘আমার চুল টানলে ব্যাথা তো পাবই। গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছ কেন ব্যাথা পাবে?’’
মহানবী তখন লোকটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘‘গাছ যে বুড়ো হয় তা কি তুমি দেখেছ?’’
লোকটি মাথা নেড়ে জানালো যে সে দেখেছে। মহানবী তখন বললেন, ‘‘তাহলে গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছও দুঃখ পায়, গাছেরও জীবন আছে।’’
লোকটি তখন মাথা নামিয়ে চুপ করে মহানবীর সে কথা মেনে নিলেন। পরে মহানবী বললেন, ‘‘অকারণে গাছের পাতা ছেঁড়া ঠিক না।’’
পাতা ছেঁড়া দূরে থাক, নগরীর উদ্যান বা অরণ্য যেখানেই যাই— নানাভাবে আমরা বৃক্ষদের ক্ষতি করছি। যেমন ফুল ও পাতা ছেঁড়া, ডাল ভাঙা, গাছের বাকলে খোদাই করে নিজের প্লাস অমুকের নাম লেখা, পেরেক ঢুকিয়ে নামফলক লাগানো, রিং আকারে বৃক্ষের বাকল তোলা, ডালপালা কাটা, বাকল তোলা, বাকল চেঁছে রস সংগ্রহ করা, বৃক্ষ পোড়ানো, গাছ কেটে পরিষ্কার করে চাষাবাদ করা, বনের মধ্যে আগুন জ্বালানো ইত্যাদি।
পরম করুণাময়, ওদের দয়া করো, তরু পাপীদের যেন সুবুদ্ধি হয়, মানুষের দ্বারা কোনও গাছের কোনো ক্ষতি যেন না হয়। গাছপালা আমাদের জীবন লালক, আমরা অযথা যেন ওদের কোনও আঘাত না দিই।
লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক।
ইমেইল: [email protected]