বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাজ্য দেশটির নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা জারি করলেও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখন এই ধরনের কোনও আশঙ্কা দেখছেন না।
তারা বলছেন, এই মুহূর্তে জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার মতো কোনও লক্ষণ তারা দেখছেন না। তারপরও সতর্ক পুলিশ যুক্তরাজ্যের আশঙ্কাগুলো যাচাই-বাছাই করছে। কেউ যেন কোথাও কোনও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশের সব ইউনিট তৎপর। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিষয়েও তৎপর তারা।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা খুবই কম বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও। তারা বলছেন, যুক্তরাজ্যের মতো সব উন্নত দেশই একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের নাগরিকদের অন্য কোনও দেশের নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক করে। তারপরও যুক্তরাজ্য সতর্কতা জারি করায় বাংলাদেশ দেশটির কাছে জানতে চাইতে পারে- তাদের কাছে এই বিষয়ে আগাম তথ্য আছে কিনা।
যুক্তরাজ্যের সতর্কবার্তায় যা আছে
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে করা হালনাগাদ সতর্কতায় বলা হয়, বিদেশিদের যাতায়াত আছে এমন স্থানে নির্বিচারে এই হামলা হতে পারে।
এর মধ্যে রয়েছে জনাকীর্ণ এলাকা, ধর্মীয় স্থাপনা ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ। কিছু গোষ্ঠী এমন লোকদের টার্গেট করেছে, যাদের ইসলামের পরিপন্থী জীবনাচরণ ও মতামত রয়েছে।
অতীতে সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে টার্গেট করে হামলা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, প্রধান প্রধান শহরে এসব হামলায় অত্যাধুনিক বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত এসব হামলা ঠেকাতে কাজ করে যাচ্ছে। আইন-শঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। অল্প সময়ের নোটিশে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ হতে পারে।
পুলিশ কী বলছে
যুক্তরাজ্যের এ সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা নিয়ে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে গড়ে তোলা বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) ডিআইজি (ক্রাইম এন্ড ইনভেস্টিগেশন) মফিজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার মতো কোনও নজির আমরা দেখছি না। এরপরও যুক্তরাজ্যের দেওয়া বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করে আমরা সতর্ক আছি। তাদের আশঙ্কাগুলো যাচাই-বাছাই করছি।”
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন, যে আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে অনেক বন্দি পালিয়ে যায়। তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; অনেকে ফিরেও এসেছে।
এ প্রসঙ্গ টেনে এটিইউ কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “অভ্যুথানের সময় জেল থেকে পালানো জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি। ইতোমধ্যেই জেলপালানো অনেকে ফিরে এসেছেন, অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
“নরসিংদী কারাগার থেকে পালানো ৯ জঙ্গির মধ্যে ৭-৮ জনই ফিরে এসেছেন বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য কারাগার থেকে পালানো বন্দিদের মধ্যে এখনও যারা ফিরে আসেনি বা গ্রেপ্তার হয়নি, তাদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সংস্থা কাজ করছে।”
যুক্তরাজ্যের সতর্কতা জারির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘কোথাও যেন কেউ কোনও ধরনের অপ্রীতিকর বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে পুলিশের সব ইউনিটের সদস্যরা নিজ নিজ দায়িত্ব পেশাদারত্বের সাথে পালন করছে।”
যা বলছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা
দ্য সেন্টার ফর বাংলাদেশ অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের (সিবিজিএ) প্রধান গবেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মো. শামসুদ্দীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেকোনো দেশ তার নাগরিকদের অন্য যেকোনো দেশে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কতা জানাতে পারে। বিশেষ করে সব উন্নত দেশই এই নিয়ম ফলো করে। তারা একটা নির্দিষ্ট পিরিয়ড পরপরই তাদের নাগরিকদের অন্য কোনও দেশের নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক করে।
“যুক্তরাজ্য যদি বাংলাদেশের বিষয়ে এই ধরনের সতর্কতা জারি করে সেটা খুবই ভালো কথা। এখন যুক্তরাজ্যের কাছে যদি তাদের আশঙ্কার বিষয়ে কোনও তথ্য থাকে তাহলে তাদের উচিত হবে আমাদের দেশ বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সেসব জানানো। যাতে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ আগাম ব্যবস্থা নিতে পারে।”
সাবেক সেনা কর্মকর্তা শামসুদ্দীন বলেন, “এই ধরনের হামলার আশঙ্কার বিষয়ে আমাদের দেশের গোয়েন্দারা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা দায়িত্বশীল কোনও জায়গা থেকে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে যুক্তরাজ্য যে আশঙ্কার বিষয়ে বলছে, তাদের কাছ থেকে সেই বিষয়ে তথ্য চাওয়া।
“একইসঙ্গে আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে যাতে এই ধরনের কোনও ঘটনা না ঘটে। আমরা জাতিগতভাবে যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে আমার মনে হয় বর্তমানে বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।”
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য যেহেতু এই মুহূর্তে সতর্কতা জারি করেছে সেহেতু বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের কাছে জানতে চাইতে পারে তাদের কাছে এই বিষয়ে আগাম কোনও তথ্য রয়েছে কিনা। কিংবা কেন এই সতর্কতা জারি করল তারা?
বুধবার বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারাহ কুক ঢাকার তেজগাঁওয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের আলোচনায়ও বিষয়টি আসে।
বাসস জানিয়েছে, উপদেষ্টা মাহফুজ বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জন্য একটি নতুন ভ্রমণ সতর্কতার বিষয়টি উত্থাপন করেন, যা মঙ্গলবার ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে।
হাই কমিশনার কুক উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করতে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্য ব্রিটিশ নাগরিকদের আগমন বা বসবাস সংক্রাম্ত সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর ওপর হালনাগাদ তথ্য ও পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কি না—তা নিশ্চিত করতে সর্বদা প্রতিটি দেশের জন্য ভ্রমণ পরামর্শ পর্যালোচনা করে থাকে।