Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত আরও ২০-২৫ জনকে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তুতি

july injured.
[publishpress_authors_box]

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছে সরকার।

সবশেষ শনিবার থাইল্যান্ডের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ বাবু। এছাড়া গত সাতদিনে আরও দুজনকে পাঠানো হয়েছে উন্নত চিকিৎসার জন্য। এ মুহূর্তে আরও ২০ থেকে ২৫ জন রয়েছেন যাদের কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশে পাঠানো হবে।

এই তালিকাই শেষ কথা নয়, রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর এই সংখ্যা নির্ভর করবে বলে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর সরকার।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি।

আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মোহাম্মদ বাবু। গুলি তার পেট দিয়ে ঢুকে কোমরের নিচের অংশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এতে খাদ্যনালী, মূত্রনালী আর কোমরের হাড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে শরীরের বাম দিক অবশ হয়ে যায়।

বাবুর প্রথম অস্ত্রোপচার হয়েছিল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সংক্রমণ সৃষ্টি হলে অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়।

আহতদের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড বাবুকে দেশের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং দুই সপ্তাহ আগে থাইল্যান্ড থেকে আসা চিকিৎসক দলও তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একই সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে শনিবার বেলা ১১টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে বাবুকে নেওয়া হয় থাইল্যান্ডে। সঙ্গে গেছেন তার বোন সুবর্ণা। তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছে ভেজথানি হাসপাতালে।

এর আগে গত ১৭ নভেম্বর রাতে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজল মিয়াকেও একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালে তার একাধিকবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তার বাম হাত ও পা পুরোপুরি অচল হয়ে যায়। হঠাৎ করে অবস্থার অবনতিও হয়।

ডা. হুমায়ুন কবীর সরকার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাজলের হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়ায় তার জন্য রোবোটিক ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এ ব্যবস্থা নেই। সঙ্গে তার ইনফেকশন ধরা পড়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড দেশের বাইরে নেওয়ার পরামর্শ দিলে তাকে ভেজথানি হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।”

একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন মুরাদ ইসলাম। গুলশানের একটি ক্যাফেতে কর্মরত মুরাদ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না।

১৮ জুলাই সে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মিরপুরের সেনপাড়া পানির ট্যাংক এলাকায় পুলিশের গুলিতে তিনিসহ আরও কয়েকজন আহত হন।

কয়েক হাসপাতাল ঘুরে মুরাদও গত তিনমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে। তার অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও তার চার হাত-পাই অবশ হয়ে পড়েছিল। তাকে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয় গত ২০ নভেম্বর।

এছাড়া রবিবার আরও একজনকে থাইল্যান্ডে পাঠানোর হচ্ছে। তবে তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ডা. হুমায়ুন কবীর সরকার বলেন, “দেশের বাইরে নেওয়ার তালিকায় এই মুহূর্তে আরও ২০ থেকে ২৫ জনের দল রয়েছে। তবে এটাও ধীরে ধীরে বাড়তে পারে। পুরোটাই নির্ভর করছে রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর।”

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ১৯ হাজার ৯৩১ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৭ নভেম্বর অর্ন্তবর্তী সরকারের ১০০ দিন পার হওয়া উপলক্ষ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি এ পরিসংখ্যান দেন।

অবশ্য এর আগে গত ৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আহতের সংখ্যা ২৩ হাজারের মতো। তিনি আরও নির্দিষ্ট করে বলেছিলেন, “তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ৪০০ জন। এই গুরুতর আহতদের মধ্যে ৩৫ জন দুই চোখ হারিয়েছেন, হাত ও পা হারিয়েছেন ২২ জন।”

তবে এই সংখ্যাটা বাড়তে বলেও সেসময় উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

আন্দোলনে আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এখন পর্যন্ত সাতজনকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে বলে  সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন ডা. হুমায়ূন কবীর।

এদের মধ্যে দুইজন নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে, একজন বিএসএসএমইউ থেকে, একজন সিএমএইচ থেকে, একজন বেসরকারি এক হাসপাতাল থেকে। বাকিরা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীসহ সব আহতদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক হাসপাতালের আহতদের সিভিয়ারিটি বিশ্লেষণ করছেন তারা। যাদের অবস্থা জটিল ‍গুরুতর এবং যাদের চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয় বলে তারা মনে করছেন, তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

ঢা্কা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ২৩ জন আর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮৯১ জন।

আন্দোলনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯০৩ জন। সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী, যাদের সংখ্যা ৪৪৪ জন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৮৯ জন, মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে ১৬২ জনকে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের রেসিডেন্ট ডা. মো. আব্দুল আহাদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, রবিবার ঢামেক থেকে একজনকে দেশের বাইরে পাঠানো হতে পারে। আর এখানে দেশের বাইরে পাঠানোর তালিকায় রয়েছেন আরও ২০ জনের মতো।

তিনি বলেন, “পাইপ লাইনে রয়েছে ২০ জনের মতো। মেডিকেল বোর্ড তাদের অবস্থা নজরদারিতে রেখেছেন, যদি তারা মনে করেন, এখানে তাদের চিকিৎসা সম্ভব না, তাহলে দেশের বাইরে পাঠানো হবে।”

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সমন্বয়হীনতার নিয়ে গত ১৩ নভেম্বর ক্ষোভের মুখে পড়েন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। সেদিন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পরিদর্শনে গেলে তার গাড়ি আটকে রাখের বিক্ষুব্ধ আহতরা। একই দিন হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করে রাখা হয় প্রায় ১৩ ঘণ্টা।

গভীর রাতে চার উপদেষ্টা সেখানে গিয়ে আহতদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আবার হাসপাতালে ফিরে যান তারা।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আহতদের দাবি, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বা হাত-পারিয়ে অনেককেই হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে মাসের পর মাস। কিন্তু সরাসরি তাদের চিকিৎসা বা পুনর্বাসন নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের কাছে স্পষ্ট কোনও বার্তা আসেনি। আবার হাসপাতালে থাকতে থাকতে নতুন করে সংক্রমণেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত সেবাও।

ওই বিক্ষোভের পর আহতদের চিকিৎসার বিষয়টি নজরে। বিশেষ করে গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি।

ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাদিম হাওলাদার সকাল সন্ধ্যাকে জানান, তার পায়ে একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। কিন্তু তিনি সুস্থ হচ্ছে না। তার আরও উন্নত চিকিৎসা দরকার। অথচ সরকার থেকে তাকে কিছু বলা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, “দিনের পর দিন হাসপাতালে রয়েছি। যদি শুরুতেই আমাদের মধ্যে থেকে জটিলতা বুঝে করে দেশের বাইরে নেবার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে আমাদের আজকের অবস্থা হতো না। আরও আগে এই উদ্যোগ নেওয়া হলে চিকিৎসাটাও দ্রুত শুরু হতো, সুস্থ হবার পথের দীর্ঘ জার্নিটাও হয়তো আরও কম সময়ে শেষ হতো।”

অনেকটা আক্ষেপ করেই নাদিম বললেণ, “এখন পঙ্গু হাসপাতালে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে ঘটা ঘটনার পর সরকারের টনক নড়েছে। কিন্তু তাতে করেতো আমাদের তিনমাসের (হাসপাতালে থাকার তিনমাস) ক্ষতটা যাচ্ছে না।”

বাজেট আসছে কীভাবে?

আহতদের বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক টাকার দরকার হচ্ছে। সেই টাকা কোথা থেকে দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার তহবিল রয়েছে, সেখান থেকেই অধিকাংশ যাচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ফান্ড থেকেও অর্থ রি-লোকেট করা হচ্ছে।”

তবে যেখানেই যা খরচ হচ্ছে না কেন সব ‘রেসপনসিবিলিটি’ সরকারের-এটা আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, বলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের এই সূত্র।

খরচটা কিভাবে হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত কত খরচ হয়েছে প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, এখনও হিসেব করা হয়নি। যার যখন যেভাবে দরকার ( খরচ) হচ্ছে সেটাই খরচ করা হচ্ছে।

বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে রোগীর তালিকা কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকারি হাসপাতালে প্রথমে দেখা হচ্ছে। সেখানে না হলে আমরা বেসরকারি হাসপাতালে দেখছি। সেখানেও যদি সম্ভব না হচ্ছে তাহলে বিদেশে যোগাযোগ করা হচ্ছে এবং সেখানে পাঠানো হচ্ছে।

“আমাদের প্রত্যেকটি হাসপাতালে এক্সপার্ট চিকিৎসক দল রয়েছে। তারা দেখছেন, ইভালুয়েট করছেন প্রতিনিয়ত।”

এত কিছুর পরেও আহতদের মনে ক্ষোভ জমেছে, তাদের কষ্টও রয়েছে; যা সরকার বুঝছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু কিছুটা সময় আমাদের দিতেই হবে। আশা করছি দিন শেষে এই ক্ষোভ তাদের থাকবে না। সব দায়িত্ব সরকার নেবে, আমি আবারও নিশ্চিত করে এই কথাটাই বলতে চাই।”

এছাড়া আহতদের নিয়ে কাজ করছেন এমন একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, ৫০ জনের চোখের কর্নিয়া নেপালে তৈরি রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে দুইজনের চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনও হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত