অর্থ বছরের মাঝামাঝিতে এসে ভ্যাট-কর বাড়ানো নিয়ে যখন সমালোচনায় পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তখন তার ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেছেন, এখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্টে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মধ্যে অর্থ বছরের মাঝামাঝিতে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যে সম্পূরক শুল্কও বাড়ানো হয়।
মূল্যস্ফীতি যখন দুই অঙ্কের কোঠায়, তখন ভ্যাট-কর বাড়ানোর এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসায়ী মহল থেকেও উঠেছে বিরোধিতা। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি তা ধর্মঘটের হুমকিও দিয়েছে।
এর মধ্যেই রবিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “আমরা চাই, বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি এমন একটা জায়গায় যাক, যেখানে থেকে আমাদের অর্থনীতির যেন বৃদ্ধি হয়।
“এটা না হলে দেখা যাবে আমাদের ঋণ আমরা পরিশোধ করতে পারছি না বা আমাদের ধারাবাহিক যে খরচ দেখা গেল, তা আমরা করতে পারছি না। সেসব বিচার করেই এটা (ভ্যাট-কর বৃদ্ধি) করা হয়েছে। এই রাজস্বের টাকাগুলো বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নেই ব্যয় হবে।”
আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়ে গেছে দাবি করে শফিকুল বলেন, “আমাদের এমন একটা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ করতে হচ্ছে, যেখানে লম্বা সময় শুধুই অপচয় হয়েছে।
“কর্ণফুলী টানেল করা হলো, সেটার ওই পাড়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরী (সাবেক ভূমিমন্ত্রী) সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে হোটেল করেছেন। এটা কার টাকায় তিনি করেছেন? তার আত্মীয়-স্বজনের টাকায় তো এটা করেন নাই, করেছেন বাংলাদেশের জনগণের টাকায়। শ্বেতপত্র কমিটির কাজ যদি আপনারা দেখেন, তারা দেখিয়েছেন কীভাবে লুটপাট হয়েছে। দেশের মানুষের টাকা অপচয় হয়েছে।”
আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশে একটি কমিটি করে অন্তর্বর্তী সরকার। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নেতৃত্বাধীন সেই কমিটি এরই মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে; তাতে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হারে তা ২৮ লাখ কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে জানিয়ে প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “চুরি তো হয়েছে আনলিমিটেড। সেই চুরি, কোথায় অর্থ রাখা, কীভাবে চুরি- এসব চিহ্নিত করা প্রথম কাজ। এছাড়াও যেসব দেশে এসব অর্থ গেছে, আমরা সকল দেশের সাথেই কথা বলছি৷ তাদের থেকেও আমরা সাড়া পাচ্ছি। তারাও আমাদের সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন।”
ব্যয় সাশ্রয়েও সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারে আসার পর থেকে আমরা কিন্তু চাচ্ছি আমাদের খরচ যেন কমানো যায়। আগে যখন দেশের প্রধান বিদেশ যেত, তখন ২৫০-৩০০ জনের বহর নিয়ে যেত। এখন কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ৪০-৫০ জনের বেশি নেন না। তার নিরাপত্তার লোকজন বাদ দিলে এই বহর আরও ছোট।”
বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকার কথা অর্থনীতিবিদরা সব সময়ই বলে আসছেন। এজন্য প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহে তারা জোর দিলেও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর বাড়ানোয় নজর বেশি সরকারগুলোর। অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে হাঁটছে।
শফিকুল বলেন, “বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপির যেই রেশিও, সেটা কোভিডের পর থেকে মানে ২০২১ সালের পর থেকে খুব নেমে যাচ্ছে। এই বছর শুধু ৫ মাসে আমাদের রাজস্ব আদায় কম হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লক্ষ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। সেখানে আমরা পেয়েছি ১ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকার একটু বেশি।
“আমরা এমন একটা অবস্থায় চলে যাচ্ছি, যে আমাদের অর্থনীতি বেশিদিন স্ট্যাবল থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষের ভালো থাকার জন্য আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও একটা জায়গায় নিতেই হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কিছু ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।”
“আমাদের দেশে ভ্যাট বিভিন্ন রেইটে ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৩ পারসেন্ট, কোথাও ৫ শতাংশের বেশি। আমরা ভ্যাটগুলোকে একটি সিম্পল জায়গায় আনতে চাই। সবগুলো যেন অভিন্ন থাকে,” যুক্তি দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসাবে ভ্যাটের অভিন্ন হার নির্ধারণ করতে বলেছে; ভ্যাট বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেই চাপও কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।
তবে আইএমএফের চাপের কথা নাকচ করে প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “আমাদের দেশেও তো অর্থনীতিবিদরা আছেন। তারাও তো আমাদের বলছে, কী কাজ করতে হবে। আমাদের ম্যাক্রো-ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটির জন্যই ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়াতে হবে।”
আবার আইএমএফের সুপারিশের প্রশংসা করে শফিকুল বলেন, “ম্যাক্রো ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটির জন্য আইএমএফ বেস্ট সাজেশন দেয়। এটা গ্লোবালই স্বীকৃত।
“আইএমএফের ঋণ পাওয়া মানে ওকে সামনে রেখে অন্যান্যরা আসে৷ ফলে বাংলাদেশের বাইরে থেকে ইনভেস্টমেন্ট আনতে আইএমএফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড় একটা কোম্পানি ইনভেস্টমেন্ট করার আগে আইএমএফের রিপোর্টটা পড়ে।”