দেশে বিনিয়োগ বাড়ার অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। তবে এই ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে নেমে এসেছে। অর্থনীতির চলমান সংকট ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ায় বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতে ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) সপ্তম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের মাস ডিসেম্বরে এই হার ছিল দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে—১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
নভেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে এসেছিল। অক্টোবরে তা ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়েছিল।
২১ মাস পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি একক অঙ্কের ঘরে, ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে আরও খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে আসে।
পরের মাস অক্টোবরে এই সূচক বেড়ে দুই অঙ্কের ঘরে–১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে উঠে। নভেম্বরে তা ফের এক অঙ্কের ঘরে, ৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে আসে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত বছরের ১৮ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ১১ দশমিক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
তবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ১৭ জানুয়ারি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে সীমিত রাখতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
দুই বছরের কোভিড অতিমারীর ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ ভালোই বাড়ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি। তবে বেশ কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে মন্থরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
২০২২ সালের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।
২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
কোভিড অতিমারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছর মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধাকে বলেন, “মূলত দুটি কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর একটি হচ্ছে- ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে কমছে এবং এর ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। আর আরেকটি কারণ হলো- বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ নেওয়া, যা বেসরকারি খাতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।”
ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণেও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাড়ে সাত মাসে (২০২৩ সালে ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ দেড় মাসে ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা।
এই সাড়ে সাত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনও ঋণ নেয়নি সরকার। উল্টো আগের ঋণের ৩৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।
অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।
আহসান মনসুর বলেন, “এক বছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে। অথচ করোনার মধ্যেও এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।”
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল।”
“কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। অন্যদিকে ডলারের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।”
“বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি যেটা হচ্ছে— সেটা মূলত অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতার কারণে হচ্ছে।”
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, “বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংকটে দেশে উৎপাদন কমেছে।”
“সব মিলিয়ে যারা ঋণ নিতে চান, তাদের অনেককে ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। আবার যাদের ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংক, তারা আপাতত ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ভাটা পড়েছে।”
“ফলে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার চলতি অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য ধরেছে— সেটা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়,” যোগ করেন মনসুর।
ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে
ব্যাংক ঋণের সুদহার আরও বেড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এখন ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ঋণ নিতে বছরে ১৩ শতাংশের বেশি সুদ দিতে হবে গ্রাহকদের।
নতুন ঋণের ক্ষেত্রে মার্চ মাসে ‘স্মার্ট’ সুদহার হবে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
বড় অংকের ঋণের ক্ষেত্রে এই স্মার্ট সুদ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। এ হিসাবে মার্চ মাসে ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
অর্থাৎ এখন ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ঋণ নিতে বছরে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ সুদ দিতে হবে গ্রাহকদের। মার্চ মাসে নতুন করে ঋণ নিলেই কেবল এই সুদহার প্রযোজ্য হবে। আগে নেওয়া ঋণের সুদহার আগের মতোই থাকবে। তবে ছয় মাস পর সুদহার পুণনির্ধারণ করতে পারবে ব্যাংক।
ট্রেজারি বিলের সুদ হারের ছয় মাসের গড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্চ মাসের এই ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) রেট হিসাব করেছে।
ফেব্রুয়ারিতে বড় অঙ্কের ঋণের সুদহার ছিল ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ছিল ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এই সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
গত বছরের জুলাই থেকে ঋণের সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করে নতুন ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই মাসে স্মার্ট রেট ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ।