Beta
রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি মহামারিকালের পর্যায়ে

ss-Private-sector-credit-growth-051212
[publishpress_authors_box]

অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; উঠেছে ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। বড় ব্যবসায়ীদের কয়েকজন কারাগারে রয়েছেন। আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম, বেক্সিমকোসহ আরও কিছু গ্রুপের শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা গা ঢাকা দিয়েছেন; বিদেশে পালিয়ে গেছেন অনেকে।

এমন পরিস্থিতিতে গত নভেম্বরে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে; যা সাড়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।

আগের মাস অক্টোবরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ; সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ; প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে নভেম্বরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ১৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।

কিন্তু যে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে বেসরকারি ঋণে লাগাম দিয়েছে, সেই মূল্যস্ফীতি নভেম্বরে আরও চড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার আগের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তারও আগে জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ছিল এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হলো ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ছাত্রদের আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় দেশে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই অস্থিরতা আরও বাড়ে। দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। সেই পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।

২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

করোনা মহামারির ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। ফলে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।

এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেরও একটা প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “যেকোনো দেশের বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিনিয়োগ সহায়ক অনুকুল পরিবেশ। বর্তমানে দেশে স্থিতিশীলতা নেই; অনিশ্চয়তা আছে। আগামী দিনগুলো কী হবে, নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন, যার প্রভাবে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দিন যতো যাচ্ছে, অবস্থা ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

“সংঘাত-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী- কেউই ঠিকমতো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না।”

“অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।”

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই। এ অবস্থায় বিনিয়োগ করবে কে? ঋণ নেবে কে?”

তিনি বলেন, “করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি, মধ্যপাচ্যের যুদ্ধ- একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর লেগেছে আরেক ধাক্কা। পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।”

“এমনটা চলতে থাকলে আমাদের কপালে কী আছে কে জানে”, যোগ করেন আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত