Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

কলাম

বিশ্ববিদ্যালয় অকার্যকর করার নতুন খড়গ প্রত্যয় স্কিম

এ কে এম খাদেমুল হক। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আবেদনপত্রে একটা আলাদা ঘর আছে; সেখানে আবেদনকারীকে লিখতে হয়, প্রার্থিত পদে চাকরির জন্য তার প্রার্থিত বেতন কত! শুনতে হাস্যকর মনে হতেই পারে। এখনকার চাকরির বিজ্ঞাপনগুলোতেই তো লেখা থাকে, কোন পদে নির্ধারিত বেতন কত। এর একবিন্দু নড়-চড় হওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে কেন এই প্রশ্ন থাকে?

উত্তরটা খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যুগে। ১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দেওয়ার সময় অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার যে বেতন পেয়েছিলেন, তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছেড়ে আসা চাকরির বেতনের দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। আবার কাছাকাছি সময়ে একই বিভাগে যোগ দেওয়া অধ্যাপক এ এফ রহমানের প্রারম্ভিক বেতন তার চেয়ে অনেক কম ধরা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সত্যিকারের জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনায় রাখা হয়েছিল সেই সুযোগ। আর্থিকভাবে লাভবান না হলে তখনকার রাজধানী কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক চাকরি ছেড়ে তখনকার মফস্বল শহর ঢাকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ আসবেন কেন?

অধ্যাপক মজুমদার তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তখন যে মোটা অংকের বেতন এবং বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকার সুযোগ পেতেন, তা দেখে ঢাকার স্থানীয় অভিজাতবর্গ তাদের ঈর্ষা করতেন। ঈর্ষা তো হতেই পারে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুণ বেতনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য তো তখন বরাদ্দ ছিল মিন্টো রোডে এখনকার সচিব-মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ করা তখনকার আধুনিক বাংলো বাড়িগুলো।

ত্রিশের দশকেই তখনকার বেঙ্গল গভর্নমেন্টের শিক্ষামন্ত্রী প্রভাষচন্দ্র মিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকারি বরাদ্দ এত কমিয়ে দিয়েছিলেন যে অধ্যাপকদের বেতনও প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছিল। সেই থেকেই শুরু, সুযোগ পেলেই সরকারের নীতি নির্ধারকরা খড়গ চালিয়ে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। যার সর্বশেষ উদাহরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাতিল করা।

এ অবস্থা অবশ্য বেশিদিন টিকে থাকেনি; ত্রিশের দশকেই তখনকার বেঙ্গল গভর্নমেন্টের শিক্ষামন্ত্রী প্রভাষচন্দ্র মিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকারি বরাদ্দ এত কমিয়ে দিয়েছিলেন যে অধ্যাপকদের বেতনও প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছিল। সেই থেকেই শুরু, সুযোগ পেলেই সরকারের নীতি নির্ধারকরা খড়গ চালিয়ে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। যার সর্বশেষ উদাহরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাতিল করা।

সম্প্রতি সরকারের জারি করা এক আদেশ অনুসারে ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের স্বায়ত্ত্বশাসিত সকল প্রতিষ্ঠানে যারা নতুন চাকরিতে ঢুকবেন, তারা আর প্রচলিত নিয়মে পেনশন পাবেন না। পরিবর্তে তাদেরকে সরকারের গৃহীত সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের আওতায় ‘প্রত্যয়’ নামের একটি নতুন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এতে নাকি কারও কোনও ক্ষতি হবে না; বরং আগের চেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন তারা!

কিন্তু বাস্তবতা হলো, অন্ততপক্ষে বাংলাদেশের সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরিরতদের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য একেবারে নির্জলা মিথ্যাভাষণ। কোনও কোনও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য এই স্কিম অবশ্যই আগের চেয়ে ভালো, কারণ এ সকল প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত পেনশনের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই অন্য রকম।

লাভ-ক্ষতি বা সুবিধা-অসুবিধার হিসাবটি বের করার জন্য বিশাল গণিতবিদ হওয়ার দরকার নেই, সাধারণ পাটিগণিত জানলেই চলে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রতি মাসে তার ভবিষ্য তহবিলে মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে জমা রাখেন। এই টাকার ওপর নির্ধারিত হারে সুদ জমা হতে থাকে। চাকরি শেষে অবসর গ্রহণের সময় তিনি এককালীন সুদসমেত এই টাকা ফেরত পান। এছাড়াও তারা এককালীন নির্দিষ্ট পরিমাণ আনুতোষিক, জমানো অর্জিত ছুটির বিপরীতে আরও কিছু নগদ অর্থ এবং মাসিক অবসরভাতাও পান। ২০১৫ সালের আগে কেউ চাইলে প্রাপ্ত অবসরভাতার সমূদয় অর্থ একসঙ্গে তুলে নিতে পারতেন; বর্তমানে এর অর্ধেক নগদায়ণ করা যায়, বাকি অর্ধেক মাসিক পেনশন হিসেবে পাওয়া যায়।

অন্যদিকে ‘প্রত্যয়’ স্কিমে আনুতোষিক, ছুটিজনিত বেতন ও অবসরভাতার কোনও উল্লেখ নেই, এখানে চাকরিরত ব্যক্তি তার মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ৫ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, সেই পরিমাণ অর্থ জমা রাখবেন, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানও সমপরিমাণ অর্থ তার জন্য প্রদান করবে। এই দুই অংকের অর্থ জমা হবে চাকরিরত প্রার্থীর ৬০ বছর বয়স অবধি। তারপর এই টাকা থেকে তাকে মাসিক পেনশন দেওয়া হবে। এককালীন কোনও টাকা তিনি পাবেন না। কোনও ব্যক্তি যদি ২৫ বছর বয়সে চাকরিতে যোগ দেন, এবং ৩৫ বছর চাকরি করার পর ৬০ বছর বয়সে অবসরে যান, তাহলে মাসে গড়ে তিন হাজার টাকা হারে জমা করলে অবসরভাতা পাবেন ৫৭ হাজার ৫৬১ টাকা করে।

প্রত্যয় স্কিমের নোটিশে অনেক বড় বড় অংকের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে এরচেয়ে বেশি হওয়ার সুযোগ খুবই কম। কেননা, বাংলাদেশে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করতেই অন্তত ২৫ বছর পেরিয়ে যায়, তাই অবসরের বয়স ৬০ হলে ৩৫ বছরের চেয়ে বেশি চাকরি করার সুযোগ খুব কম ব্যক্তিই পাবেন।

আবার, প্রত্যয় স্কিমে মাসিক চাঁদার পরিমাণ ‘বেতনের ১০ শতাংশ অথবা ৫ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম’। বর্তমানে একজন নতুন লেকচারারের বেতন ২২ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির আগে পর্যন্ত এই হিসাবে তার মাসিক চাঁদা তিন হাজারের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পরই কেবল তিনি মাসিক পাঁচ হাজার টাকা হিসেবে জমা করতে পারবেন, আর সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে সাধারণত ১০ থেকে ১৪ বছর সময় লাগে।

এখানে আরেকটা বড় শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ৬০ বছর বয়স থেকেই পেনশন শুরুর কথা বলা আছে। তাহলে চাকরি আর পেনশন কি এক সঙ্গে চালু থাকবে? একটা মহল অনেক দিন ধরেই শিক্ষকদের অবসরের বয়স নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন, এই স্কিমের মধ্য দিয়েই কি সেই ‘সুবিধাটুকুও’ এবার কেড়ে নেওয়া হবে?

এখানে আরেকটা বড় শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ৬০ বছর বয়স থেকেই পেনশন শুরুর কথা বলা আছে। তাহলে চাকরি আর পেনশন কি এক সঙ্গে চালু থাকবে? একটা মহল অনেক দিন ধরেই শিক্ষকদের অবসরের বয়স নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন, এই স্কিমের মধ্য দিয়েই কি সেই ‘সুবিধাটুকুও’ এবার কেড়ে নেওয়া হবে?

সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই স্কিমের আওতায় এলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা তাদের জন্য লাভজনক হতে পারে, যারা বর্তমানে ভবিষ্য তহবিল আর এককালীন আনুতোষিক ছাড়া অন্য কোনও সুবিধা পান না।

তার মানে, বাস্তবে এই প্রকল্প আসলে স্বায়ত্ত্বশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনবে। সরকারের সার্বজনীন পেনশন স্কিমে বেসরকারি চাকরিজীবিদের জন্যও ‘প্রগতি’ নামে আলাদা একটা স্কিম আছে, এবং তার সুযোগ সুবিধার সঙ্গে ‘প্রত্যয়’ স্কিমের খুব একটা পার্থক্য নেই।

অন্যভাবে যদি বলি, এই প্রকল্প চালুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আর নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির আর কোনও গুণগত পার্থক্য থাকবে না। কারণ দুই চাকরিতেই অবসরোত্তর সুবিধাদি একই রকম হবে। তাহলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন মেধাবী শিক্ষার্থী কেন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে চাইবেন?

বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে তো কোনও শিক্ষকের জন্য আপনি সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে দিবেন না; মানে বেতন দিবেন মাসে ২২ হাজার টাকাই। এর সঙ্গে অল্প-স্বল্প অন্যান্য সুবিধাদি যা ছিল, গত এক দশকে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠার নামে সে সব এরইমধ্যে কেটে নেওয়া হয়েছে। এমনকি বছরে বই কেনা আর গবেষণাবাবদ যে আলাদা ভাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেতেন, সেটাও ‘অনিয়মতান্ত্রিক’ বলে বাতিল করা হয়েছে। চাকরির শুরুতে আগে একাডেমিক ক্ষেত্রে ভালো ফলের জন্য কয়েকটা ইনক্রিমেন্ট পেতেন, অন্যদের ক্ষেত্রে বহাল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সেটাও বাতিল করা হয়েছে। তাই কেবল বেতন-বাড়িভাড়া-চিকিৎসাভাতা ছাড়া তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য কোনও সুবিধা নেই।

সরকারের সার্বজনীন পেনশন স্কিম বিষয়টা আসলে মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু এটা যাদের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ এটা তাদের জন্যই প্রয়োগ করতে হবে, অন্যদের প্রাপ্য সুবিধা কেটে নিয়ে অনর্থক বিতর্ক তৈরি করার কোনও মানে হয় না। আর যদি সত্যিই এটা বাধ্যতামূলক করতে হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়কে শুরুর দিকের মতো স্বাধীনতাটুকুও দেওয়া হোক, উপযুক্ত ব্যক্তির জন্য অন্তত বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করার।

তারপরও মেধাবীদের অনেকে এ চাকরিতে ঢুকতেন সামাজিক মর্যাদা আর অবসরোত্তর সুবিধার আশায়। এখন সেটাও বন্ধ করে দিলে তো তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই যেতে চাইবেন; কারণ সেখানে মাসিক বেতনের পরিমাণটা এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি!

সরকারের সার্বজনীন পেনশন স্কিম বিষয়টা আসলে মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু এটা যাদের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ এটা তাদের জন্যই প্রয়োগ করতে হবে, অন্যদের প্রাপ্য সুবিধা কেটে নিয়ে অনর্থক বিতর্ক তৈরি করার কোনও মানে হয় না।

আর যদি সত্যিই এটা বাধ্যতামূলক করতে হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়কে শুরুর দিকের মতো স্বাধীনতাটুকুও দেওয়া হোক, উপযুক্ত ব্যক্তির জন্য অন্তত বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করার।

এখন হয়ত একশো বছর আগের মতো ‘ঈর্ষণীয়’ বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না; কিন্তু অন্তত সাধারণ মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান সুবিধাও যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তো আর কেউই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে চাইবে না! প্রত্যয় স্কিম চালু করা হলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তখন অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: khademulhaque@du.ac.bd

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত