কেমন চলছে দেশের গণগ্রন্থাগারগুলো? জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে (৫ ফেব্রুয়ারি) দেশের বিভিন্ন গণগ্রন্থাগারের সরেজমিন চিত্র বলছে, পাঠাভ্যাস সৃষ্টি ও বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে দিবসটি উদযাপনের সূচনা হলেও এর গতি নিম্নমুখী। পাঠাগারগুলোতে দিনদিন কমছে পাঠকের উপস্থিতি। সারাদিনে পাঠক উপস্থিতি কম থাকায় কোনও কোনও পাঠাগার খোলাই হয় দিনের দ্বিতীয় ভাগে। আবার যারা পাঠাগারে আসেন- তাদের বেশিরভাগই আসেন বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। হাতেগোনা কিছু পাঠক পত্রপত্রিকা এবং সৃজনশীল বইপত্র পড়েন। পাঠকদের মধ্যে নারীর সংখ্যাও খুবই কম।
খুলনা বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার
১৯৬৪ সালে স্থাপিত খুলনা বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে বর্তমানে বই আছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ১১টি। এছাড়াও এখানে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা রাখা হয় ২৭টি।গণগ্রন্থাগারের উপ-পরিচালক হামিদুর রহমান বলছেন, বর্তমানে গ্রন্থাগারে আসা পাঠকদের বেশির ভাগই একাডেমিক ও চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আসেন।
জানুয়ারি মাসে এই গ্রন্থাগারে পাঠক এসেছে মোট ২ হাজার ১শ’ ৫ জন। যার মধ্যে পুরুষ পাঠক ১ হাজার ২শ ৪ জন, নারী পাঠক ৬শ ৯৫, শিশু পাঠক ১শ ৭০। এছাড়াও জানুয়ারি মাসে পত্রিকার পাঠক ছিল মোট ১ হাজার ৩শ ৯০,এর মধ্যে পুরুষ ৭শ ৮৪ জন, নারী ৪শ ৪৪ জন ও শিশু ১শ ৬২জন। ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রন্থাগার দিবসে এখানে বই পড়েছেন ৭১ জন।
কথা হয় পাঠক শেখ মামুনুর রহমানের সাথে। তিনি বি এল কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স পাস করে এখন চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মূলত চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই তিনি গ্রন্থাগারে আসেন। পাশাপাশি সাহিত্য ও বিজ্ঞান এবং পত্রিকা পড়েন বলে জানান মামুন। তবে গ্রন্থাগার দিবস সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
মামুনুর রহমানের পাশের টেবিলে পড়াশোনা করছিলেন চার বন্ধু। তারাও গন্থাগার দিবস সম্পর্কে কিছু জানেন না। গণগ্রন্থাগারে এসেছেন মূলত একাডেমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। খুলনা ব্রজলাল কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র রতন সরকার জানান, এখানের পড়ার পরিবেশ ভাল, সেজন্যই তিনি আসেন। এখন দিনে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পাঠাগার খোলা থাকে। এটি আরো কয়েক ঘণ্টা বেশি খোলা থাকলে ভালো হয় বলে মনে করেন রতন সরকার।
একইভাবে একাডেমিক পড়াশুনার জন্য লাইব্রেরিতে আসেন দিবারাত্রি কলেজের ছাত্র নয়ন সরকার। তবে মাঝে মধ্যে সাহিত্যের বইও পড়েন তিনি।
পাঠকদের মত খুলনা বিভাগীয় গন গ্রন্থাগারের উপ পরিচালক হামিদুর রহমানও জানান একই কথা। তিনি বলেন, পাঠকদের মধ্যে একাডেমিক ও চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বইয়ের চাহিদা বেশি। আরো একটি বিষয়ের চাহিদা রয়েছে গাইড বই। কিন্তু গাইড আমরা আইনত কিনতে পারি না, তাই পাঠ্য সহায়ক বই বাড়াতে পারলে ভালো হবে বলে তিনি মনে করেন।
কুষ্টিয়া গণগ্রন্থাগার
কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরি নামেই পরিচিত কুষ্টিয়া গণগ্রন্থাগার। এটি এক সময় সকালের দিকে খোলা থাকলেও এখন কেবল বিকেলে খোলা হয়। সকালের দিকে পাঠক না আসায় তালাবদ্ধ থাকে পাঠাগারের দরজা।
৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায় দরজায় তালা ঝুলছে। পাশেই কুষ্টিয়া জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘ নামে একটি সংগঠনের অফিস। ওই সংগঠনের কার্যালয়ের সামনে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন সংগঠনের নির্বাহী সদস্য মহাতাব উদ্দিন। তিনি গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক। মাহাতাব উদ্দিন জানান, প্রতিদিন বিকেল ৫টার পর লাইব্রেরি খোলা হয়। তখন কিছু পাঠক সেখানে বই ও পত্রপত্রিকা পড়তে আসেন।
তবে বর্তমানে পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। ৫-৬ বছর আগেও এখানে ৫০ থেকে ৬০ জন পাঠক আসতেন বলে জানান মহাতাব। বর্তমানে তা ১০-১৫ জনে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, যারা বই পড়তে আসেন তারা সবাই প্রবীণ। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশি আসেন বলে জানান তিনি।
রাঙামাটি গণগ্রন্থাগার
রাঙামাটি শহরের প্রান্তসীমা ভেদভেদী গ্রামে জেলা সরকারি গ্রন্থাগারের অবস্থান। কেবল দূরত্বের কারণেই জেলার বিভিন্ন এলাকার পাঠকরা সেখানে যেতে পারেন না। তা না হলে উপস্থিতি আরও বাড়তো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাঠাগারে যে পাঠক রেজিস্টার খাতা রয়েছে সেটির অবস্থাও হযবরল। বছর কিংবা মাসের সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি ঘেঁটে। তবে চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯৮ জন পাঠকের নাম পাওয়া গেছে রেজিস্টারে।
তবে ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন ছিল প্রতিষ্ঠানটিতে। সকাল ১১টায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রন্থাগারের পাঠ কক্ষে আলোচনা সভা চলছে। এরপর বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার ও সনদ বিতরণ করা হয়। ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও।
রাঙামাটি জেলা সরকারি গ্রন্থাগারের প্রাক্তন সহকারী গ্রন্থাগারিক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকারি গ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক সুনীলময় চাকমা বলেন, দিন দিন গ্রন্থাগারে পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে শহরের বাইরে গ্রামের মধ্যে পাঠাগারের অবস্থান হওয়ার কারণে পাঠকের উপস্থিতি আশানুরূপ নয়।
স্থানীয় বাসিন্দা রনি ঘোষ জানান, ভেদভেদীতে একটি প্রাথমিক ও একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর সুবাদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু থাকাকালীন সময়ে দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাওয়া–আসা করেন। তবে শহরের অন্যান্য এলাকার মানুষের উপস্থিতি খুবই কম।
পাঠাগারটির পাঠক ও জেলা শহরের নাটঘর একাডেমির পরিচালক প্রণব চাকমা বলেন, ঘিঞ্জি বা জনবহুল এলাকায় পাঠাগার মানায় না, পাঠাগার গ্রাম এলাকাতেই মানায়। রাঙামাটিতে পাঠাগারের জন্য এই এলাকাটি ভালো হয়েছে বলে আমি মনে করি। তবে গ্রামের মধ্যে হওয়ার কারণে পাঠক সংখ্যা কিছু কম হচ্ছে।
সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ
দেশের অন্যতম প্রাচীন পাঠাগার সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। তবে এটি গণগ্রন্থাগার নয়। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটিতে বর্তমানে বইয়ের সংখ্যা ৫৭ হাজার ৪শ ৯টি।
পাঠাগারের নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আহমদ জানান, শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ পাঠাগার পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
পাঠাগারের রেজিস্টার অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পাঠক এসেছে ২৮ জন। ৪ ফেব্রুয়ারি পাঠক ছিল ৫২ জন, এর আগের দিন ৫০ জন পাঠক পাঠাগার ব্যবহার করেছেন।
সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মুমিন আহমদ মবনু বলেন, এই পাঠাগারে পুরনো অনেক বই রয়েছে। দেশ বিদেশের অনেক গবেষক এই পাঠাগার ব্যবহার করেছেন।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন]