জজিয়তির চাকরি জীবনে জেলা জজদের দাওয়াত খাওয়ানোর ব্যাপারটা পারতপক্ষে এড়িয়েই চলেছি, ভয়ে। চাকরিতে ঢুকেই সিনিয়রদের কাছে গল্প শুনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল মনে। উপজেলা হবার আগে সেকালে বিশেষ কিছু থানায় মুন্সেফ কোর্ট ছিল, যেগুলোকে বলা হতো চৌকি আদালত। এরকম এক চৌকি আদালতে একবার এক জেলা জজ ইন্সপেকশনে আসেন। রেওয়াজমতো তাঁর খাবারের আয়োজন করার কথা মুন্সেফ সাহেবের। করেনও তিনি এবং সৌজন্যের আতিশয্যে বা বেশি ভালো সাজতে গিয়ে একটু বেশিই করে ফেলেন। ভালোমন্দ নানান খাবার বেশ যত্ন-আত্তি করে খাওয়ান। জেলা জজ সাহেব তৃপ্তি করে খেয়েদেয়ে কাজ সেরে চুপটি করে ফিরে যান। কিন্তু, বছর শেষে বেচারা মুন্সেফের এসিআরে দেখা গেল তার জীবনযাপনের মানের দফায় সেই জেলা জজ ইনিসিয়াল (অনুস্বাক্ষর) মেরেছেন ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত জীবনযাপন’ (Lives beyond known sources of income) এর ঘরে। এটা আসলেই গল্প, নাকি সত্যিকারের ঘটনা তা জানি না। তবে, এসিআর দাতা জেলা জজকে খাওয়ানোটা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার মনে হয়েছে আমার। কম করলে নাখোশের বিপদ, বেশি করলে আবার ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত জীবনযাপনে’ ইনিসিয়ালের বিপত্তি! অতিথির মানমতো আয়োজন করতে আমার কোন কোন খাতের খরচ কতটা কাটছাঁট করে সামাল দিতে হয়েছে তার খবর না নিয়েই বিশেষ ঐ একদিনের আয়োজন দেখে যদি ইনিসিয়াল মেরে দেন ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত জীবনযাপন’ এর ঘরে!
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত আয়, অর্থাৎ অবৈধ আয় ছাড়া তো আর ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত জীবনযাপন’ হয় না। সেরকম অবৈধ আয় থাকলে বিলাসী জীবনযাপনের পরেও অবৈধ সম্পদ জমা হয়। জীবনযাপনের ব্যয় যার যার মতো সবারই আসলে কম। অবৈধ আয় আর অবৈধ সম্পদ কমবেশি সব পেশাতেই হয়। তবে, সরকারিদেরটা নিয়ে কথা হয় বেশি। সম্প্রতি উচ্চ পদস্থ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় সরকারি চাকুরেদের সম্পদের হিসাব দেবার ও নেবার বিষয়ে বেশ শোরগোল উঠেছে। ব্যাপারটা হাইকোর্ট অব্দি উঠেছে। আপিল বিভাগে উঠাবার কথা এখনো শুনতে পাইনি।
সম্পদের হিসাব দেবার বিধান
চাকরিতে ঢোকার সময় এবং তারপরে বছর বছর সরকারি চাকুরেদের সম্পদের হিসাব দেবার বিধান (১৩ বিধিতে) আছে ১৯৭৯ সালের গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস (কনডাক্ট) রুলসে, বাংলায় যাকে বলা হয় ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা’। আইনটা ইংরেজিতে তাই বাংলা অনুবাদের বদলে ইংরেজি নামটাই ব্যবহার করছি। তাছাড়া, বাংলা ‘সরকারি কর্মচারী’ শব্দের মধ্যে একটু ঝামেলাও আছে, যা একটু পরে বলছি। এই রুলসটা করা হয় আমাদের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা দিয়ে। পাকিস্তান আমলেও ১৯৬৪ ও ১৯৬৬ সালে গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস (কনডাক্ট) রুলস ছিল। সে-দুটো বাতিল করে ১৯৭৯ সালেরটা করা হয়।
গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট কারা? বলছে, এই রুলস যাদের ওপর প্রযোজ্য তারাই গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট। কাদের ওপর প্রযোজ্য? বলা হচ্ছে, অসামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত চাকরিতে বাংলাদেশের ভেতরে বা বাইরে কর্মরত, ছুটি ভোগরত এবং প্রেষণে সরকারি এজেন্সি, প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষের কর্মে রতদের ওপর প্রযোজ্য। সামরিক চাকরি এই রুলসের আওতা থেকে প্রথমেই বাদ গেল। আর, স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, যাদের ওপর রেলওয়ে এস্টাবলিশমেন্ট কোড প্রযোজ্য, মেট্রোপলিটান পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তা, ইন্সপেক্টর র্যাংকের নিচের পুলিশ সদস্য, বিজিবির অধস্তন কর্মকর্তা, রাইফেলম্যান ও সিগন্যালম্যান, ডেপুটি জেলার, সার্জেন্ট ও ইন্সট্রাক্টরের নিচের অধস্তন জেল কর্মকর্তাদের ওপর এই রুলস মোটেই প্রযোজ্য হবে না। তাহলে আর থাকল কী? এই রুলসের আওতা বহির্ভূতদের মধ্যে অনেকেরই অবৈধ সম্পদ অর্জনের খবর গণমাধ্যমে আসে, দুদকের কাছেও আসে।
সরকারি কর্মচারী কারা
বাংলা ‘সরকারি কর্মচারি’কথাটার মধ্যে ঝামেলা আছে। এটা কি ইংরেজি গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট? নাকি পাবলিক সার্ভেন্ট? আমাদের পুরাতন আইন-বিধিগুলো ইংরেজিতে, সেগুলোর মধ্যে চাকরি সংক্রান্ত আইনগুলোতে লেখা আছে ‘গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট’, আর ফৌজদারি আইনগুলোতে লেখা আছে ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। অবৈধ সম্পদ অর্জন দুর্নীতি সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধ বলেই সম্পদের এ-আলোচনায় ফৌজদারি আইনের প্রসঙ্গটা আসছে। ‘গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট’ আর ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ এর মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। দুটোকেই যখন বাংলায় ‘সরকারি কর্মচারী’ লেখা হয় তখন ফারাকটা ঢাকা পড়ে যায়, বাদ পড়ে যায় ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’, শুধু ‘গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট’ নিয়েই পাবলিক মেতে থাকে। সব ‘গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট’-ই ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’, কিন্তু সব ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’-ই ‘গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট’ নয়।
গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে বলা হয়েছে, “সরকারি কর্মচারী” অর্থ এই আইনের আওতাভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি [ধারা ২(১৬)]। অনেকটা সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের “সরকারি কর্মচারী অর্থ প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদি পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত কোনো ব্যক্তি” এর মতো। সরকারি কর্মচারীকে সংবিধানের ইংরেজি পাঠে বলা হয়েছে পাবলিক অফিসার। প্যাঁচটা আছে ঐ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ এর মধ্যে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্ম অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হইতে পারে এইরূপ অন্য কোনো কর্ম।” এক কথায় প্রজাতন্ত্রের কর্ম হলো বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত কর্ম। এই কর্ম যারা করেন তারাই সরকারি কর্মচারী, চাকরি সংক্রান্ত ইংরেজি আইনে তাদের বলা হয় গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট। তাদের চাকরি সংক্রান্ত আইনবিধি প্রণীত হয় সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদ দিয়ে।
গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট হিসেবে বিবেচিত এই সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ‘রাজউক’ (এবং অন্যান্য জেলা শহরের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ), জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, পিডিবিসহ বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো, পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানিগুলো, সিটি কর্পোরেশনসমূহ, বিটিসিএল, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিসি ইত্যাদির মতো সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্পেরেশনসমূহ, সরকারি ব্যাংক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কর্মচারীরা বাদ পড়ে যায়। এরা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের কর্মচারী। সংবিধানমতে (১৫২ অনুচ্ছেদ) “সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ অর্থ যে-কোনো কর্তৃপক্ষ, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, যাহার কার্যাবলী বা প্রধান প্রধান কার্য কোনো আইন, অধ্যদেশ, আদেশ বা বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন চুক্তিপত্র দ্বারা অর্পিত হয়।” এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যেও কারো কারো অবৈধ সম্পদ অর্জনের খবর তো প্রায় প্রায় সংবাদের শিরোনাম হয়।
পাবলিক সার্ভেন্ট কারা
আমাদের দেশে পাবলিক সার্ভেন্টেরও বাংলা করা হয় সরকারি কর্মচারী। আমাদের ‘পেনাল কোড’, যাকে চলতি কথায় ‘দণ্ডবিধি’ ডাকা হয়, তার ২১ ধারায় ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’-এর সংজ্ঞা দেওয়া আছে। কারণ, পেনাল কোডে পাবলিক সার্ভেন্টদের নানা রকম অপকর্মকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে এবং দণ্ড নির্ধারণ করা আছে। পেনাল কোডের ২১ ধারায় পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে আছেন:
(১) দেশের সামরিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর কমিশপ্রাপ্ত অফিসাররা;
(২) জজ এবং বিচারমূলক কোনো কাজ করার জন্য আইনগত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা;
(৩) বিচার আদালতের আইন বা ঘটনার কোনও বিষয়ে তদন্ত বা রিপোর্ট করার, বা কোনো ডক্যুমেন্ট তৈরি, প্রমাণীকরণ বা সংরক্ষণ করার, বা কোনো সম্পত্তির দায়িত্ব নেওয়ার বা নিষ্পত্তি করার, বা কোনো পরওয়ানা জারি করার, বা শপথ পরিচালনা করার, বা আদালতের আদেশ ব্যাখ্যা করার বা সংরক্ষণ করার দায়িত্বসম্পন্ন কর্মকর্তারা; এবং এই সব কাজ সম্পাদনের জন্য আদালত থেকে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা;
(৪) জুরি ও এসেসররা এবং বিচার আদালত বা পাবলিক সার্ভেন্টকে সহায়তা দানকারী পঞ্চায়েত সদস্যরা;
(৫) বিচার আদালত বা উপযুক্ত সরকারি কর্তৃপক্ষ হতে সিদ্ধান্ত বা প্রতিবেদনের জন্য যাদের কাছে পাঠানো হয় সেই সব মধ্যস্থতাকারী/সালিসকারীরা;
(৬) কাউকে বন্দি করে রাখার দায়িত্বসম্পন্ন পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা।
(৭) অপরাধ প্রতিরোধ করার, অপরাধের তথ্য প্রদান করার, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার বা জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা সুবিধা রক্ষা করার দায়িত্বসম্পন্ন গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টরা;
(৮) সরকারের পক্ষে কোনো সম্পত্তি গ্রহণ করার, সংরক্ষণ করার বা ব্যয় করার, বা সরকারের পক্ষে কোনো জরিপ করার, বা সরকারের পক্ষে কোনো মূল্যায়ন বা চুক্তি করার, বা কোনো রাজস্ব পরওয়ানা জারি করার, অথবা সরকারের আর্থিক স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন কোনো বিষয়ে তদন্ত করার বা রিপোর্ট করার, বা সরকারের আর্থিক স্বার্থ সম্পর্কিত কোনো ডক্যুমেন্ট তৈরি করার, প্রমাণীকরণ করার বা সংরক্ষণ করার, বা সরকারের আর্থিক স্বার্থ সুরক্ষার জন্য আইনের ব্যত্যয় রোধ করার দায়িত্বসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা;
(৯) কোনো সম্পত্তি গ্রহণ করার, সংরক্ষণ করার বা ব্যয় করার, কোনো জরিপ বা মূল্যায়ন করার বা কোনো গ্রাম, শহর বা জেলার কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ উদ্দেশ্যে কোনো কর আরোপ করার, বা কোনো গ্রাম, শহর বা জেলার জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কোনো ডক্যুমেন্ট তৈরি, প্রমাণীকরণ বা সংরক্ষণ করার দায়িত্বসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা;
(১০) ভোটার তালিকা প্রস্তুত, প্রকাশ, রক্ষণাবেক্ষণ বা সংশোধন করার বা নির্বাচন বা নির্বাচনের অংশ বিশেষ পরিচালনা করার ক্ষমতাসম্পন্ন পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা;
(১১) (ক) সরকারের চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বা সরকারি বেতনে বা ফি বা কমিশনে পাবলিক ডিউটি সম্পাদনে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, (খ) আইন দিয়ে বা আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের, কর্পোরেশনের, সংস্থার ও কর্তৃপক্ষের অথবা সরকারে স্বার্থ বা ক্যাপিটাল শেয়ার আছে এরকম কোনো ফার্ম বা কোম্পানির সবেতন চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই পাবলিক সার্ভেন্ট।
পাবলিক সার্ভেন্টের এই সংজ্ঞায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের চাকরি করেন কি না, বা আদৌ চাকরি করেন কি না তা দেখা হয়নি। দেখা হয়েছে কাজ দিয়ে। যাদের কাজ পাবলিক ডিউটির পর্যায়ে পড়ে তাদেরকেই পাবলিক সার্ভেন্ট বলা হয়েছে। গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টের বাইরেও পাবলিক ডিউটিতে নিয়োজিত অধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত সব প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরাও তাই পাবলিক সার্ভেন্টের আওতায় পড়েন।
এমনকি, বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও বাদ যান না। ১৯৪৭ সালের প্রিভেনশন অব করাপশান অ্যাক্টের ২ ধারায় পাবলিক সার্ভেন্টের সংজ্ঞাকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে : দণ্ডবিধির এই ২১ ধারার পাবলিক সার্ভেন্টদেরসহ সরকার প্রতিষ্ঠিত কর্পোরেশন, কর্তৃপক্ষ, সংস্থার চাকুরেরা এবং আইনের অধীনে গঠিত বা প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, মেম্বার, কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা, কর্পোরেশন বা কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ট্রাস্টি, সদস্য, কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরও পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে গণ্য হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এরাও সবাই পাবলিক ডিউটি সম্পাদন করেন।
হিসাব কার কাছে দেবে, তাতে কী হবে?
বলা হচ্ছে, ১৯৭৯ সালের গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস (কনডাক্ট) রুলসের এই বিধান নাকি প্রতিপালিত হচ্ছে না, সম্পদের হিসাব নাকি দেওয়া-নেওয়া হচ্ছে না। হবে কি? সম্পদের হিসাব ঠিক কার কাছে দিতে হবে সেটাই তো পরিষ্কার নয় বিধিতে। হিসাব দেবার পরে সেটা নিয়ে কী করা হবে সে সম্বন্ধে তো একটি কথাও নেই এই বিধিতে। যাচাই-বাছাই করে আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা না নিলে এই হিসাব দেওয়া অন্তসারশূন্য আনুষ্ঠানিকতা পালন মাত্র।
সম্পদের হিসাব তো বছর বছর আয়কর বিভাগে দেওয়াই হচ্ছে। গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট গোত্রের সরকারি কর্মকর্তাদের আয়কর নথি থাকা এখন বাধ্যতামূলক। টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) ছাড়া এখন ব্যাংক একাউন্ট চালানো যায় না, সম্পত্তি কেনা যায় না। ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নে সম্পদের হিসাবও দেখাতে হয়। তাহলে, আয়কর বিভাগকে শক্তিশালী করলেই তো হয়, যেন তারা সবার আয়ের সঙ্গে সম্পদের সঙ্গতি পরীক্ষা করতে পারে। অসঙ্গতিপূর্ণ বলে সন্দেহজনক মনে হলে দুদককে জানাবে। দুদক অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেবে।
শুধু শুধু গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট নামের সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব সরকারের কাছে আলাদা করে দেবার হ্যাপা কেন? ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নে এক ফরমেটে, আবার সরকারের কাছে আরেক ফরমেটে? এটা তুলে দিলেই তো হয়। বলেছিলাম এক টেলিভিশন চ্যানেলে। সরকার নাকি তুলেই দিতে চেয়েছিল (কাঙালের কথায় নয়, নিশ্চয় নিজ বিবেচনায়), তাতে আঁতে লাগে একজনের, ঠুকে দেন রিট। কিন্তু, হিসেব করে দেখেছেন কী সম্পদের এই হিসাব দিতে নিতে সরকারের কত কর্মমাস আর কর্মশক্তি অপচয় হবে!
সম্পদের এই হিসাব দেওয়া-নেওয়ার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য তো দুর্নীতি রোধ করা। যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই হিসেব দেওয়াই লাগে তবে সেটা করা হোক এসিআরের সঙ্গে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের কপি জমা দেওয়ার মাধ্যমে। এসিআর ফরম যেমন মেডিক্যাল অফিসারের রিপোর্ট নিয়ে এসিআর দাতার কাছে জমা দেওয়া হয় তেমনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা একইসঙ্গে তার ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের কপিও জমা দেবেন।
এসিআর দাতা একদিনের দাওয়াত খেয়ে নয়, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের কপি দেখে ইনিসিয়াল দেবেন জীবনযাপনের মানের দফায়। ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নে জীপনযাবনের ব্যয়ের হিসেবও দেওয়া থাকে। যদি সেটা করতেই হয় তবে শুধু গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট নয়, করা হোক সব সরকারি কর্মচারীর অর্থাৎ সব পাবলিক সার্ভেন্টের জন্য। করা হোক ১৯৪৭ সালের প্রিভেনশন অব করাপশান অ্যাক্টের ২ ধারায় যারা পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে সরকারি কর্মচারী তাদের সবার সম্পদের হিসাব দেওয়া-নেওয়ার জন্য। অবৈধ আয় আর অবৈধ সম্পদ এখন আর শুধু গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিস্তার ঘটেছে পুরো পাবলিক সার্ভেন্টদের মধ্যে। এমনকি, বেসরকারিতে ঋণ জালিয়াতি, ভ্যাট ফাঁকি, ট্যাক্স ফাঁকি, প্রতারণা ইত্যকার নানা কায়দায় অবৈধ আয় আর অবৈধ সম্পদ ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। তাদের হিসাবটাও নিতে হবে ঠিকভাবে। তাদেরটা ছেড়ে রাখলে সুড়সুড়ি দেবে এসে সরকারিতে।
তাই আয়কর বিভাগকেই শক্তিশালী করতে হবে, যেন তারা সরকারি, বেসরকারি, কর্মকর্তা, কর্মচারী, মালিক সবার সম্পদের হিসাব বৈধ আয়ের সঙ্গে যাচাই করে দেখতে পারে। অসঙ্গতিপূর্ণ বলে সন্দেহজনক মনে হলেই পাঠাতে পারে দুদকে। আর দুদকের গতি বাড়ানো হোক, যেন তারা দ্রুত অনুসন্ধান শেষ করে মামলা করতে পারে। আর কোর্টে বিচারের গতি বাড়ানো হোক, যেন তারা মামলাগুলোর বিচার দ্রুত শেষ করতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।ইমেইল: [email protected]