গৃহযুদ্ধ পাল্টে দিয়েছে মিয়ানমারের দৃশ্যপট; বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্য রাখাইনের প্রায় পুরোটা এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তাতে রোহিঙ্গা সংকটের নতুন মোড় নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার নিয়ে থাকা বাংলাদেশেও পাল্টেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। মিয়ানমারের নতুন পরিস্থিতিতে কী করবে এখন বাংলাদেশ? উঠেছে সেই প্রশ্ন।
রাখাইনের মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু নানা কারণে প্রত্যাবাসন শুরুই করা যায়নি।
এখন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পরিবর্তে কি আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ স্থাপন করবে? করলেও কীভাবে?
বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ স্থাপন আবার মিয়ানমার সরকারই বা কীভাবে দেখবে? আবার চীন ও ভারতের ভূমিকা কী হবে?
এমন সব বিষয় মাথায় রেখেই চলতে হবে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পর দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
রাখাইনে এখন পরিস্থিতি কী?
গত কয়েক বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের প্রায় পুরোটার নিয়ন্ত্রণও এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির (এএ) হাতে।
রাখাইনের বৌদ্ধদের নেতৃত্বে ২০০৯ সােল গড়ে ওঠে আরাকান আর্মি। রাখাইনে জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এর ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৩৫ শতাংশ মুসলমান রোহিঙ্গা। আরাকান আর্মি স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখে। তবে সেখানে রোহিঙ্গাদের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছিল জান্তা সরকার। ফলে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর খড়গহস্ত হবে বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আর তা যে ঘটছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢোকার মধ্য দিয়ে। ড. ইউনূস বুধবারই মালয়েশিয়ার উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জানান যে গত কয়েক মাসে নতুন করে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার এক সময় সীমান্ত খুলে দিলেও গত বছরগুলোতে বলে আসছিল, আর কোনও রোহিঙ্গা ঢুকতে দেওয়া হবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বলেন, নতুন করে আর রোহিঙ্গা ঢুকতে না দেওয়ার পক্ষেই তাদের অবস্থান। কেননা আর শরণার্থী নেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারপরও রোহিঙ্গারা চলে আসছে; যার প্রমাণ প্রধান উপদেষ্টার কথায়ই স্পষ্ট।
সীমান্তে কী প্রভাব?
রাখাইনে সংঘাতের আঁচ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ভালোভাবেই লাগে। ওপার থেকে গোলা, গুলি এসে পড়ে প্রায়ই; বিস্ফোরণের বিকট শব্দে আতঙ্কও ছড়ায়।
আরাকান আর্মি মংডুসহ নাফের ওপারের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর নদীতে বাংলাদেশি জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাতায়াতও হচ্ছে ব্যাহত।
তবে আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সীমান্ত নিরাপদ থাকবে বলেই মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মিয়ানমার রাষ্ট্র হিসেবে স্বৈরাচারী বা ফেইলড এমন নানান কিছু হতে পারে। কিন্তু তারা সীমান্ত রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত নিয়ম নীতি মানত। আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। ফলে, তারা সকল নিয়ম-নীতি নাই মানতে চাইতে পারে। কিন্তু আরাকান আর্মির যে শক্তি, তাতে আমাদের ভূখণ্ডে হামলা করার কোনও সম্ভাবনা নেই।”
তবে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশসহ সীমান্তে অবৈধ মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন নাঈম আশফাক। কারণ বিশ্বের সব দেশেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তহবিল জোগাতে মাদক ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ে।
তবে এই পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন করে তুলল বলে তিনি মনে করেন।
একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি কয়েক বছর আগে আরাকান আর্মির মেজর জেনারেল তোয়ান ম্রাত নাইনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
আলতাফ পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এখন কঠিন হয়ে গেল।
“রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আরাকান আর্মি অনেক কনজারভেটিভ হয়ে গেছে। এটা একদম চলতি ঘটনা। আগে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আরাকান আর্মি কিছুটা নরম থাকলেও এখন এই অবস্থা নেই।”
আরাকান আর্মিকে সহায়তা দেওয়া উচিৎ?
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আরাকান আর্মিকে সহায়তা দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তাতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো ঢাকার প্রধান লক্ষ্য হলেও প্রথমে রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী খুব জলদি রাখাইনে তার ক্ষতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। তাই আরাকান আর্মি বাংলাদেশেরর জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে আরাকান আর্মিকে একটি স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ অঞ্চল গঠনে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সীমান্তে ব্যবসা খুলে দিলে এই গোষ্ঠীটি মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অংশের ওপর তার নির্ভরতাকে কমাতে পারবে। এতে তাদের অর্থনৈতিকভাবে টেকসই একটি এলাকা গড়তে সহায়ক হবে। রাখাইনে উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা প্রত্যাবাসনের জন্য পূর্বশর্ত হবে।
“যদি আরাকান আর্মির এলাকা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে সক্ষম না হয়, তবে তারা শরণার্থী ফিরিয়ে নেবে না। একইভাবে রোহিঙ্গারাও এমন পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে না,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
দাতা দেশগেুলোরও রাখাইন রাজ্যের মানুষের জন্য সহায়তা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে ক্রাইসিস গ্রুপ।
“যদিও সেনা সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের এলাকায় ত্রাণ ঢুকতে দেবে এমন আশা কম। তবুও বিদেশি সরকার ও জাতিসংঘের উচিৎ, বাংলাদেশকে সীমান্ত দিয়ে আরও বেশি মানবিক সহায়তা প্রবাহের অনুমতি দিতে চাপ দেওয়া। ত্রাণ যেন সব জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে দাতাদের এবং মানবিক সংস্থাগুলোর আরও ঘনিষ্ঠভাবে আরাকান আর্মির সঙ্গে কাজ করতে হবে।”
আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে?
রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে যাওয়ার পরপরই ঢাকার পক্ষ থেকে বিদ্রোহী দলটির সঙ্গে যোগাযোগের ইঙ্গিত দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শুক্রবার ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা : বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলেছিলেন, “আরাকান আর্মির চূড়ান্ত অবস্থা কী হয়, তা এখনও অস্পষ্ট। তবে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। তবে গভীরভাবে বিবেচনা না করে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।”
এখন পর্যন্ত ঢাকার পক্ষ থেকে নে পি দোর জান্তা সরকারের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে সরকার। কূটনীতিতে সেটাই নিয়ম। তবে বিদ্রোহীদের সঙ্গেও যোগাযোগের ইঙ্গিত সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এই প্রথম জানানো হলো।
সরকারের এই পরিবর্তিত কৌশলকে সময়ের দাবি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও।
তবে এই যোগাযোগ যেন বুমেরাং না হয়ে যায়, সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে নিতে হবে। এর আগে ঢাকা কখনও কোনও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এবার যদি তা করে তাহলে তা সিদ্ধান্ত ঠিক করে নিতে হবে।
“আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি এই প্র্যাকটিস করি, তাহলে যদি বাংলাদেশের সাথেও কেউ এমন প্র্যাকটিস করে, তাহলে তখন আমরা অস্বস্তি বোধ করতে পারব না।”
আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের পদ্ধতি কী হবে
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশকে এখন রাখাইন রাজ্যের নতুন পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। ঢাকায় নতুন সরকার এবং মংডুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু সেই যোগাযোগ কি সরাসরি হবে? নাকি জটিলতা এড়াতে পরোক্ষভাবে হবে?
লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, “ফরমালি যোগাযোগ আমরা আগে না করলেও ইনফরমালি যোগাযোগ করেছি। এখনও তা করতে হবে। ফরমাল যোগাযোগ করলে মিয়ানমারের সরকার তাতে ক্ষেপে যেতে পারে।”
কিন্তু অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ খুবেএকটা কাজে আসবে না বলে মনে করেন মিয়ানমার সীমান্তে দায়িত্ব পালন করে আসা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক।
তিনি বলেন, “আমরা তো এ ধরনের যোগাযোগ করেছি আগে থেকেই। এ ধরনের যোগাযোগ মানে, আপনার গোয়েন্দা সংস্থার লোক যাবে, তারা জিজ্ঞেস করবে-ভাই কী অবস্থা, কী করা যায়?
“কিন্তু এই গোয়েন্দা সংস্থার লোক তো কোনও অথরিটি না। এভাবে আমরা গত সাত বছর করেছি। কিন্তু তাতে আমরা একজন রোহিঙ্গাকেও কি ফেরত পাঠাতে পেরেছি।”
আরাকান আর্মিই শুধু নয়, মিয়ানমারে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য একটি কমিশন করার সুপারিশ করেন তিনি।
“মূল অবজেকটিভ থাকবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। এই কমিশন অথরিটি হবে। ফলে সে যখন বিভিন্ন গ্রুপের সাথে কথা বলবে, তারাও জানবে যে তারা বাংলাদেশের অফিসিয়াল অথরিটির সাথে কথা বলছে। যোগাযোগের মূল্য বৃদ্ধি পাবে।”
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত একজন প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তাতে আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের একটি নেতৃত্ব গঠন প্রক্রিয়ায় সমর্থন করা উচিৎ বাংলাদেশের। তার মাধ্যমেও আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা করা যাবে। আবার রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগদান বন্ধ করতে হবে।
চীন-ভারতকে বুঝেই কি এগোতে হবে?
মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলটি ঘিরে ভারত-চীনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। এই এলাকায় বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় রাখাইন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অনেক বেশি আগ্রহের জায়গা।
আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব বৃদ্ধির কারণে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যেমন জটিলতা তৈরি হবে, তেমনি মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও দেখা দেবে নানা টানাপোড়েন। বাংলাদেশ নিজের জায়গা থেকে এই সমস্যা সমাধান করতে গেলে তাদের অবস্থানী কী হবে, তাও দেখার বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. সায়মা আহমেদ মনে করেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চীন বা ভারতকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তাদের মতামত নিয়ে আমাদের কিছু করতে হবে, সেই দিকে লক্ষ্য রাখার কিছু নেই। এই সমস্যা কোনোদিন চীন বা ভারত সমাধান করে দেবে না। দিলে এত দিনে তা হয়ে যেত।”
“বাংলাদেশকে এই ঘটনা এমনভাবে প্রজেক্ট করতে হবে, যেন সে সবার সাথে বসে এই সমস্যা সমাধান করতে চায়। তখন চীন বা ভারত কেউ বাংলাদেশের বিপক্ষে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ এই রিফিউজিদের হোস্ট কান্ট্রি। ফলে, এই আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের আছে,” বলেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে চীনের বড় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। অন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রভাব মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম হলেও তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত, তাদের উচিৎ ঢাকাকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে চাপ দেওয়া, যেন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দমন করা যায়।
রাখাইনে ভারত ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ‘বিপরীতমুখী’ বলে পর্যবেক্ষণ মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক এমদাদুল ইসলামের।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আরাকান আর্মির ওপর চীনের প্রভাব থাকায় তাদের কর্মকাণ্ড ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে।”
তবে ভারতের ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত অবশ্য তা মনে করেন না। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে সব বিষয়ে যে বৈরিতা থাকে, তা নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান অভিন্নও হতে পারে।
রাখাইন প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থায়নে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের কাজ চলছে। বাংলাদেশকে অনেকটা বাইপাস করে কলকাতা থেকে সিত্তে পর্যন্ত নৌপথকে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত করেছে ভারত।
কলকাতা থেকে প্রথমে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর, তারপর কালাদান নদীপথে পালেতোয়া, সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চল- এই হলো কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের রুট।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওই বেল্টটা আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। আরাকান আর্মির ওপর একচ্ছত্র প্রভাব হচ্ছে চীনের। তাদের কর্মকাণ্ড ভারতের স্বার্থের বিপক্ষেই যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”
অন্যদিকে, মিয়ানমারকে ঘিরে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। রাখাইনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দরের বড় প্রকল্প গড়ে তুলছে চীন। রাখাইনের চকপিউ এলাকায় চীন একটি সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলেছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে বন্দরটি। সেখান থেকে দুটি পাইপলাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে চীন ভূখণ্ডে। একটা গ্যাসলাইন অপরটি তেলের। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে জ্বালানি তারা আমদানি করবে, সেটা এই পথে কুনমিং পর্যন্ত নিতে চায় চীন।
দুই পক্ষের স্বার্থ থাকায় রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে চীন-ভারত সমঝোতায় আসতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
মিয়ানমারের সঙ্কট নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা থাইল্যান্ডে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। ব্যাংককে বৃহস্পতি ও শুক্রবারের বৈঠকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ড যোগ দিচ্ছে।
বুধবার মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তাবে কুয়ালালামপুরের সমর্থন আশা করেন।
ড. ইউনূস রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত লোকদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়েও মত দেন।