ফুটবলের কিংবদন্তী রনজিত দাসের এক বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ি জীবন। চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন, আজাদ স্পোর্টিং ও মোহামেডানের হয়ে লিগ শিরোপা জিতেছেন। অথচ এই গোলরক্ষকের উচ্চতা ছিল মাত্র ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, এ নিয়েও আছে তার মজার স্মৃতি। তবে শুরুটা হয়েছিল ক্রিকেট দিয়ে আর শেষ হকিতে, পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অধিনায়কও ছিলেন। ৯২ বছর বয়সী সব্যসাচী ক্রীড়াবিদের শ্রবণ শক্তি দুর্বল হলেও স্মৃতি শক্তি এখনও প্রখর। প্রশ্ন কাগজে লিখে দিলে বলতে থাকেন হৃদয় খুলে। এই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারজয়ী গোলরক্ষক সিলেটে নিজের বাড়িতে সকাল সন্ধ্যা’র রাহেনুর ইসলামের সামনে খুলে দিলেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকের স্মৃতির ঝাঁপি।
প্রশ্ন : কেমন আছেন?
রনজিত দাস : বয়স তো ৯৩ বছর হতে চলল। এই বয়সে যেমন থাকা যায় আর কি? কিছুদিন আগেও কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে পারতাম। এখন এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে সাহায্য লাগে আরেকজনের। তারপরও সৃষ্টিকর্তা যেমন রেখেছেন, আমি সন্তুষ্ট।
প্রশ্ন : আপনার উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এই উচ্চতা নিয়ে গোলরক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেন?
রনজিত দাস : দেখুন আমি কিন্তু শুরুতে ফুটবলার ছিলাম না। খেলতাম ক্রিকেট। সেই কথা লোকে ভুলেই গেছে।
প্রশ্ন : তাহলে ক্রিকেটের গল্প শুনি আগে।
রনজিত দাস : ১৯৪৭ সালে আমি শক্তিশালী দল টাউন ক্লাবের একাদশে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাই। অনেকগুলো সেঞ্চুরি আছে আমার। ক্রিকেটে উচ্চতা কোন বাঁধা নয়। তবে বাবা বলতেন এই খেলা আমাদের জন্য না। ক্রিকেটে ভালো করতে হলে লাহোর বা বোম্বাই (মুম্বাই) যেতে হবে।
প্রশ্ন : এজন্য ক্রিকেট ছেড়ে দিলেন?
রনজিত দাস : ছাড়তে হয়েছে বাধ্য হয়ে। ১৯৪৭ সালের ৫ ও ৬ জুলাই গণভোট হয়, সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে নাকি আসামের সঙ্গে থাকবে এ নিয়ে। আসামের পক্ষে মার্কা ছিল কুঁড়েঘর আর পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কুড়াল। ১৭ জুলাই ফলাফল ঘোষণা করা হলে জিতে কুড়াল। সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে যায় আর যেসব অভিজাতরা ক্রিকেট পরিচালনা করতেন তারা চলে যায় ভারতে। আমিও ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবলে চলে আসি।
প্রশ্ন : আপনি নিজে কি গোলরক্ষক হতে চেয়েছিলেন?
রনজিত দাস : আমার ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতায় এই পজিশনে খেলা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। আমাদের এইডেড হাইস্কুলের দলনেতা হামিদ আমাকে গোলপোস্টে দাঁড়াতে বলে। অস্বস্তি হলে সে আমাকে ইট দিয়ে অনুশীলন করতে বলে। এভাবে একজন ইট ছুঁড়ত আর আমি কখনও ডানে তো কখনও বামে ঝাঁপিয়ে সেগুলো ধরতাম। এই পরিশ্রম আর ইটের ব্যথা সহ্য করাটা কাজে লেগেছে পরে।
প্রশ্ন : স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে ক্লাব ফুটবলে আসলেন কীভাবে?
রনজিত দাস : ১৯৫৪ সালের ৭ আগস্ট প্রথমবার সিলেট থেকে হবিগঞ্জে খেলতে যাই স্থানীয় দল ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস ক্লাব ও টাউন ক্লাবের ফাইনালে। ফাইনাল খেলতে আমাদের বিপক্ষ দলে এসেছিলেন সে সময় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও পূর্ব পাকিস্তানের সেরা স্ট্রাইকার বলাই দাস। আমি যে বাড়িতে ছিলাম, তার দরজার বাইরে বিপক্ষ দলের সমর্থকরা জুতার মালা রেখে লিখেছিল ‘পরাজিত গোলকিপারের জন্য।` আসলে আমার উচ্চতার জন্যই এমন রসিকতা করেছিল ওরা। তাতে ভালো খেলার জেদ আরও বেড়ে যায়। ম্যাচে বলাই দাসের পায়ে ডাইভ দিয়ে কয়েকটা বল কেড়ে নিয়েছিলাম। আমরা ১-০ গোলে জিতি সেই ম্যাচ। হবিগঞ্জের দর্শকরা আমাকে কাঁধে নিয়ে উল্লাস করে। এরপর যে বাড়িতে ছিলাম সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বিস্ময়। জুতার বদলে সেখানে ছিল ফুলের মালা। আর লেখা ছিল ‘জয়ী গোলকিপারের জন্য।’ কি যে ভালো লেগেছিল !
প্রশ্ন : উচ্চতার জন্য এরকম বিব্রত হয়েছিলেন আর কখনও?
রনজিত দাস : হবিগঞ্জের সেই ফাইনাল শেষে মার্চেন্ট ক্লাবে খেলার প্রস্তাব পাই। তখনই আমার জীবনের বাঁক বদলের শুরু। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা যাওয়ার পর আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকেছিলেন বিখ্যাত গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির কাউকে মার্চেন্ট ক্লাব গোলরক্ষক হিসেবে এনেছে। আমাকে প্রথমে বললেন, ‘তুমি কি সঙ্গীত পরিচালক সুবল কুমারের ভাই’। বললাম ‘না’। তারপর বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘তুমি ১২টা থলে নিয়ে যাবে গোল আনার জন্য। ১১টি তোমাদের ১১ খেলোয়াড়ের জন্য। আর ১টি ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি পেয়ারা মিয়ার জন্য।’
প্রশ্ন : ম্যাচে কী হয়েছিল ?
রনজিত দাস : শচীন দেব বর্মণের মত ব্যক্তিত্ব এমন কথা বললে, সবারই খারাপ লাগবে। আগরতলার শক্তিশালী দল বীরেন্দ্র ক্লাবের বিপক্ষে আমরা গোলশূন্য ড্র করলাম। আমার পারফর্ম্যান্স খুব ভালো ছিল সেদিন। দর্শকরা ভীষণ প্রশংসা করে। এরপর শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে দেখা করে বলি, ‘স্যার, ১২টা থলে কি করব এখন’। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’। উনার চোখের ভাষা বলছিল, তিনি যেন ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির বিশ্বসেরা গোলরক্ষককে দেখছেন। তখনই প্রথম মনে হয়েছিল এই উচ্চতার হয়তো আমিই সেরা গোলরক্ষক।
প্রশ্ন : আপনি ঢাকার ফুটবলে এলেন কীভাবে?
রনজিত দাস : ভালো খেলায় আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। ১৯৫৫ সালে কুমিল্লায় আমন্ত্রণমূলক একটা ম্যাচ খেলতে আসে কলকাতার বিখ্যাত ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। আমরা কুমিল্লা একাদশ অবিশ্বাস্যভাবে জিতে যাই ৩-০ গোলে। এরপরই প্রস্তাব আসে ঢাকার ক্লাব ইস্পাহানিতে খেলার। এখানে ৪টি ম্যাচ খেলার পর বন্যায় লিগ স্থগিত হয়ে যায়।
তবে এই চার ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে ডাক পেয়ে যাই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক দলে। তখন তো মোবাইল ছিল না। দ্রুত খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য মাধ্যম ছিল টেলিগ্রাম। মর্নিং নিউজ পত্রিকায় ৪৮ জনের তালিকায় নিজের নাম দেখে প্রথমে বিশ্বাস করিনি আমি। পরে টেলিগ্রামে এই খবর পাঠানো হয় সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থায়। কর্তারা আমাকে জানালে ঢাকা চলে যাই দ্রুত।
প্রশ্ন : পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে প্রথম খেলার অভিজ্ঞতা….
রনজিত দাস : ১৯৫৫ সালের ১৯ নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর স্পোর্টস কমপ্লেক্সে পঞ্চম পাকিস্তান জাতীয় ফুটবলে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হয় বেলুচিস্তানের। ট্রেনে দর্শনা দিয়ে ভারতের হাওড়া ও অমৃতসার হয়ে লাহোর পৌঁছেছিলাম প্রায় ১০০ ঘণ্টা পর। টিম ম্যানেজার আমার নাম রঙ্গু দিয়েছিলেন। যেন কেউ বুঝতে না পারে আমার ধর্ম কি? ম্যাচে আমরা ১-০ গোলে হেরে যাই। ম্যাচটা নিয়ে ‘দি টাইমস অব করাচি’ লিখেছিল, ‘গোলকিপার রঙ্গু না থাকলে পূর্ব পাকিস্তান ৬-০ গোলে হারতো।’
আমাদের সময় বিরতিতে ড্রেসিংরুমে যাবার ব্যাপার ছিল না। মাঠেই থাকতে হত। এ সময় আমার কাছে এসে পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি এন এইচ খন্দকার জানতে চান পুরো পরিচয়। আমি নিজের পরিচয় দিলে তিনি মুখ গোমড়া করে চলে যান। পরে জানতে পারি, তার কাছে ধর্মটাই সব, ভালো খেলার গুরুত্ব নেই।
প্রশ্ন : এজন্যই কি আপনি একবার বলেছিলেন হিন্দু হওয়ায় পাকিস্তান জাতীয় দলে ডাক পাননি?
রনজিত দাস : তখন বয়স কম ছিল। এতদিন পর সেই বিতর্ক আর করতে চাই না। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কেমন আচরণ করত সবাই জানে।
প্রশ্ন : আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে এলেন কবে?
রনজিত দাস : ১৯৫৬ সালে। প্রথমবারই আমরা ঢাকা লিগের চ্যাম্পিয়ন। ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে অধিনায়ক ছিলাম আমি। টানা দুবার আমার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় আজাদ। পরের বছর আমার সঙ্গে চুক্তি করে মোহামেডান। ১৯৫৯ সালে মোহামেডানে যোগ দিয়েই শিরোপা জিতি।
প্রশ্ন : মানে টানা চারবার লিগ জিতেছেন আপনি। আজাদের অধিনায়ক হিসেবে মোহামেডান ১৯৫৯ সালে কত টাকায় চুক্তি করেছিল আপনার সঙ্গে?
রনজিত দাস : (হাসি) আজাদে খেলতাম পেটে-ভাতে। আর মোহামেডান চুক্তি করেছিল ২ হাজার টাকায়! আমি কিন্তু ১৯৫৯ সালেই ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (সোনালী ব্যাংক) কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিই। তাই টাকার চিন্তা না করে খেলতে পারতাম মনের আনন্দে।
প্রশ্ন : আপনি হকিতে এলেন কীভাবে?
রনজিত দাস : ঐ যে বললাম, তখন মনের আনন্দে খেলতাম। ১৯৬২ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলাম। পাশাপাশি খেলতাম হকিসহ আরও কয়েকটি খেলা। ১৯৬৩ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ হকি লিগে চ্যাম্পিয়নও হই আমি। ১৯৬৫ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে শিরোপা জিতি আবারও। খেলতাম গোলকিপার পজিশনে। ১৯৬৭ সালে সুযোগ পাই পূর্ব পাকিস্তান হকি দলে। পরের বছর অধিনায়কও হই। তখন ফুটবল ছেড়ে দিলেও ’৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুব ফুটবল দলের কোচ করা হয় আমাকে। সে সময়ের খেলার ভিডিও থাকলে দেখতেন আমাদের খেলার মান ছিল কত উঁচু। আফসোস হয়, এ সবই এখন গল্প মনে হবে।
প্রশ্ন : আপনি তো অনেকদিন হকি খেলেছেন …
রনজিত দাস : ১৯৭৯ পর্যন্ত। শেষ দল ছিল সিলেট, আমি অধিনায়ক ছিলাম। এর মাঝে জড়িয়ে পড়ি ফুটবলের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে। ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হই ১৯৭২ সালে। ১৯৮১ সালে আবারও মনোনীত হই বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য।
প্রশ্ন : এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার আপনার, অথচ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেলেন ২০০৭ সালে?
রনজিত দাস : সিলেটের মফস্বলে ছিলাম অবসরের পর থেকে। সবাই হয়ত ভুলেই গিয়েছিল। তাই এত সময় লেগেছে। তবু তো জীবিত থাকতে পেয়েছি, অনেককে তো দেওয়া হচ্ছে মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কার। একুশে পদক এখনও পাইনি। এটা মরণোত্তর হয় কিনা, কে জানে?