ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে জাতীয় পার্টি। প্রধান উপদেষ্টার তৃতীয় দফার সংলাপে ডাক না পাওয়ায় এমন বক্তব্য দলটির। তবে একইসঙ্গে বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিতেও মনোযোগ দিচ্ছে তারা।
প্রথম দুই দফার সংলাপে দলটিকে ডাকা নিয়ে সমালোচনা হয়। বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ ছিল জাতীয় পার্টি। পরবর্তী কোনও সংলাপে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে আপত্তি আসে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের নেতাদের পক্ষ থেকে।
তবে দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ‘ব্র্যান্ডিং’ করার অপচেষ্টা চলছে। আন্দোলনে অংশ নিয়েও জাতীয় পার্টি বৈষম্যের শিকার। মিথ্যা মামলা দিয়ে দলটির সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এর পরপরই ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। কিছুদিন বিরতি দিয়ে চলতি মাসের শুরুতে আবার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে উপদেষ্টা পরিষদ।
তৃতীয় দফায় এই সংলাপ শুরু হয়েছে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গত ৫ অক্টোবর। সেদিন সংলাপে ছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসালামী আন্দোলন ও এবি পার্টি।
তৃতীয় দফার সংলাপের অংশ হিসেবে আগামীকাল শনিবারের বৈঠকে ডাক পেয়েছে আগে ডাক না পাওয়া সাতটি দল ও জোট।
এই সংলাপ সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ গত ৮ অক্টোবর ফেইসবুকে লেখেন, “স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে, আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব।”
একইদিন আরেক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, “আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের সহযোগী জাতীয় পার্টিকে সংলাপে ডাকা হচ্ছে না।”
শনিবার অন্তর্বর্তী সরকার বসতে যাচ্ছে গণফোরাম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, লেবার পার্টি ও বিজেপির নেতাদের সঙ্গে।
তৃতীয় দফার এই সংলাপে ডাক না পেলেও গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধানের ডাকা বৈঠকে, সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির ডাকা বৈঠকে ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ এবং প্রথম দুই দফার সংলাপেও তারা ডাক পেয়েছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে গতকাল বৃহস্পতিবার বনানী কার্যালয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সভা ডাকে জাতীয় পার্টি।
সভায় দলটির নেতারা বলেন, সরকার না ডাকলে তারা কেন যাবেন? সংস্কারের বিষয়ে রাজপথে থেকেই সরকারকে মতামত জানাবে জাতীয় পার্টি। এখন তাদের লক্ষ্য সংগঠন গুছিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া।
‘বৈষম্যের শিকার জাতীয় পার্টি’
সভায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা তুলে ধরেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা রক্ত দিয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির বিরুদ্ধে প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে এর প্রতিবাদ করা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েও জাতীয় পার্টি বৈষম্যের শিকার। মিথ্যা মামলা দিয়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে অংশ নিয়েও জাতীয় পার্টি ন্যায়বিচার পাচ্ছে না।”
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার কারণে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রংপুরে মামলা হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার হয়ে হাজতবাস করেছে। ১ জুলাই ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে, আমি ৩ জুলাই সংসদে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর সামনে ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে বক্তৃতা করেছি। বক্তৃতায় আমি বলেছি, ছাত্রদের এই আন্দোলন যৌক্তিক। চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংবিধান পরিপন্থী।”
বৈষম্যের বিরুদ্ধে জীবন দেওয়ার প্রতীক হিসেবে ছাত্রদের শহীদ মিনারে গিয়ে শপথ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে সভায় জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে অভিযোগ করে সভায় তিনি বলেন, “একটি চক্র জাতীয় পার্টিকে ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষের দল হিসেবে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”
আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ‘ব্র্যান্ডিং’ করার অপচেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেন জিএম কাদের।
দল গুছিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি
সভায় দল গুছিয়ে নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় পার্টি। সকাল সন্ধ্যাকে এ কথা জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু।
তিনি বলেন, “আমরা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সারাদেশে সফর করব। এর জন্য সাংগঠনিক টিম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকায় ও রংপুরে মহাসমাবেশের ঘোষণা আমরা দেব।
“আমরা নির্বাচনের দল। নির্বাচনের প্রস্তুতিতেই আমরা মনোনিবেশ করব।”
সংলাপে জাতীয় পার্টিকে না ডাকার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আমাদের না ডাকলে আমরা কেন যাব? আমরা আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলতে চাই না। কে আমাদের ডাকল, আর কে ডাকল না—তা আমাদের দেখার বিষয় না।”
সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় পার্টি তার মতামত রাজপথে থেকেই সরকারকে জানাবে বলেও জানান তিনি।
‘রংপুরই ভরসা’
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের বাড়ি রংপুরকে দলটির দুর্গ হিসেবেই দেখা হয়। সামরিক শাসক এরশাদ ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালে তিনি ক্ষমতা হারালেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব নিয়েই ছিলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনের মধ্যে ৯টি আসনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পায় জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে মাত্র ৩টি আসনে জয় পায় জাতীয় পার্টি, যেখানে ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে চমক দেখায় দলটি। এই ৩৫টি আসনের মধ্যে ২২টি আসন ছিল রংপুরের পাঁচ জেলার।
এবারও জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়াতে চায় রংপুরকে কেন্দ্র করে। দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে খুব কম দেখা গেলেও রংপুরে মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি।
রংপুরের মানুষের ঋণ জাতীয় পার্টি কোনও দিন শোধ করতে পারবে না জানিয়ে সভায় জিএম কাদের বলেন, “আমাদের নামে মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে রংপুর থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। রংপুরের মানুষ রাস্তায় জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ফাঁসি থেকে রক্ষা করেছে। আমার জন্যও তারা রাজপথে লড়াই শুরু করেছে। আমরা তাদের ঋণ কখনোই শোধ করতে পারব না।”
ঠেকল কোথায় জাতীয় পার্টি
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জাতীয় পার্টির অতীত নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে ডাক পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সেই অতীত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে মিত্র বা সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। দলটির নেতারা মন্ত্রিত্ব নিয়েছিলেন; বিরোধী দলের আসনেও বসেছিলেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল দলটি।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের কাছে কী কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল তা পুনরায় তুলে ধরেন জিএম কাদের। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সেনাপ্রধান থেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী এইচ এম এরশাদ ১৯৮৬ সালে দলছুট একদল নেতাকে নিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেন । ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে চমক দেখায় দলটি।
এরপর থেকে ভাঙনের মুখে পড়ে জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রথমবারের মতো ভেঙে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা দল গঠন করেন। ১৯৯৯ সালে আবার ভাঙে তখনকার মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে। ২০১৪ সালে কাজী জাফর আহমেদ আলাদা দল গঠন করে এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে যান।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে জাতীয় পার্টিতে কোন্দল চলছিল। দেবর-ভাবির সেই দ্বন্দ্ব মেটে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যস্থতায়। জিএম কাদের দলের কর্তৃত্ব নেন, আর রওশন সংসদে দলের নেতৃত্ব নেন। এর বাইরে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদও সক্রিয় হতে চেয়েছিলেন ছেলে এরিক এরশাদকে নিয়ে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফলের পর কোন্দল আরও বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আলাদা সম্মেলন ডাকেন রওশন। সেখানে রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়, মহাসচিব হন কাজী মামুনুর রশীদ। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে রওশন এরশাদ অংশের কোনও কার্যক্রম দেখা যায়নি।