ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কত দিনের মধ্যে হতে পারে, তা নিয়ে প্রথমবারের মতো সুনির্দিষ্ট সময় জানানোয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, সংস্কারকাজ যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে, তবে জনগণের ভোটাধিকার দ্রুত ফেরাতে হবে।
বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ৭ জানুয়ারি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকলেও গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাদের পতন ঘটে। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে জোর দিলেও নির্বাচনের কোনও সময় জানানো হচ্ছিল না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল।
এই প্রেক্ষাপটে রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”
সোমবার মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সেখানে ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রসঙ্গ এক সাংবাদিক তুললে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যটা শুনি নাই। আপনার মুখেই যেটা জানলাম- উনি যেটা বলেছেন, যথার্থ বলেছেন। নির্বাচনে যারা পার্টিসিপেট করবে, যারা অংশীজন তারা যদি চায় তিনি যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দেবেন; সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এর বাইরে কোনও কথা কারও নাই।
“আর সংস্কার একটা বিষয়। এটা যুগ যুগ ধরে চলবে। এটা নতুন কিছু না। এটা হঠাৎ করে এটা একটা প্যাকেট না, একটা প্যাকেটে করে এনে আমি সংস্কার হয়ে গেলাম। এটা সময়ের বিবর্তনে, সময়ের চাহিদায় সংস্কার প্রয়োজন হয়। আমরা আশা করছি, এই সরকার দ্রুততম সময়ে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফেরত দেবে; এটাই আমাদের কাম্য।”
মির্জা আব্বাস বলেন, “আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”
সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ নেতা-কর্মীরা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সাভারের কর্মসূচি শেষ করে বিএনপি মহাসচিবের শেরে বাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করার কথা ছিল। তবে সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত সাভার সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে ভর্তি করা হয়।
মির্জা আব্বাস বলেন, “আমার এই জায়গায় আজকে আমাদের প্রিয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথা বলার কথা ছিল। উনি আজকে নাই। কারণ উনি এই মুহূর্তে অসুস্থ অবস্থায় সিএমএইচএ ভর্তি আছেন সাভার ক্যান্টনমেন্টে।
“আমরা তার আরোগ্য কামনা করছি; যত সম্ভব শিগগিরই তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।”
জনগণের বাধভাঙা উল্লাসে অভূতপূর্ব বিজয় দিবস
বিজয় দিবসে বিএনপির প্রত্যাশা কী—এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা আব্বাস বলেন, “এই বিজয় দিবসে আজকে যে জনগণের ঢল- আমি এতো বছর আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে এই যাবতকাল… সেই আমাদের বিজয় স্তম্ভ… জাতীয় স্মৃতিসৌধ সাভারে গেছি, এই মাজারে (জিয়াউর রহমানের সমাধি) এসেছি বহুবার; কিন্তু আজকের মতো এরকম জনগণের ঢল আমার জীবনে আমি কখনও দেখিনি।
“এর একটাই মাত্র, কারণ জনগণের বাধভাঙা উল্লাস। এদেশের মানুষ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। এদেশের মানুষ চায় এক স্বৈরাচার মুক্ত করে আমরা জনগণ যেন আর কোনও স্বৈরাচারের হাতে না পড়ি।”
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান
মির্জা আব্বাস বলেন, “এদেশের মানুষ ভোটের অধিকার চায়। আমরা শুনেছি, আমরা দেখেছি, ভোটের কথা বললে, ইলেকশনের কথা বললে, অনেকের মুখ বাকা হয়ে যায়। আমরা পরিস্কার বলতে চাই… আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব পরিস্কার বলেছেন, আমাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে… এটা একটু আমাদের জানিয়ে দিন।
“আমরা অপেক্ষা করতে রাজি আছি… সংস্কার হবে… অপেক্ষা করব। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এভাবে চলতে পারে না। আজকে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, আজকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধবগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষে। মানুষ আজকে বাঁচার আশ্রয় খুঁজছে। মানুষ কথা বলতে পারছে ঠিকই, কিন্তু দেশের মানুষের অভাবের তাড়না রয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচিত সরকার না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। আমরা চাই, এই সরকার একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করুক।”
‘রাজনীতিকরা একদিনে তৈরি হননি’
মির্জা আব্বাস বলেন, “একজন উপদেষ্টা কয়েকদিন আগে বলেছেন, আমি তার জবাব দিতে চাই না। তিনি বলেছেন, ‘৫৩ বছর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কী করেছেন?’ আমি বলতে চাই, আপনি রাজনীতি করেন নাই। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটু দয়া করে সন্মান নিয়ে কথা বলবেন। একজন রাজনীতিক একদিনে তৈরি হয়ে যায়নি।
“দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান কিংবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা এখানে যারা দাঁড়িয়ে আছেন- এরা একদিনে তৈরি হয় নাই। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যা বলেন, তাদের কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করেন, মানার চেষ্টা করেন। এই কথা ভাববেন না যে, আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য লড়াই করি। ক্ষমতায় যাওয়ার কথা আমরা কখনও বলি না, আজও বলি নাই, কখনও বলব না। আমরা চাই, জনগণের ভোটের অধিকার, আমরা চাই জনগণের শাসন।”
বিজয় দিবস উপলক্ষে নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “আজকে আপনাদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। দেশের মানুষ দেশের জনগণকে এই বিজয় উৎসব পালন করার জন্য দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেবের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে শেরে বাংলা নগরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
এ সময়ে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মাসুদ আহমেদ তালুকদার, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুল হক মিলন, কামরুজ্জামান রতন, নাজিম উদ্দিন আলম, সাইফুল আলম নিরব, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, মহানগর উত্তর বিএনপির আমিনুল হক, দক্ষিণের তানভীর আহমেদ রবিন, যুব দলের আবদুল মোনায়েম মুন্নাসহ অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সিএমএইচ থেকে বাসায় ফিরেছেন মির্জা ফখরুল
সকাল ১০টার দিকে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত সাভার সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়।
সিএমএইচে প্রাথমিক চিকিৎসা ও শুশ্রূষা শেষে দুপুর ২টার দিকে গুলশানের বাসায় ফিরেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চিকিৎসকেরা তাকে প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, স্মৃতিসৌধে মানুষের প্রচণ্ড চাপে তিনি (মির্জা ফখরুল) অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা ও শুশ্রূষা শেষে তাকে বেলা দুইটার দিকে বাসায় নেওয়া হয়েছে। তিনি এখন বিশ্রামে আছেন।