সন্ত্রাস বিরোধ আইনের মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নিশীতা ইকবাল নদীসহ চারজনকে দুই দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।
রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালত এই অনুমতি দিয়েছে।
শুনানির এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দেওয়া তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে হিন্দিতে কথা বলেন নদী। সে কথা শুনে তিনি নদীকে আর কথা না বলার অনুরোধ জানান। বলেন ভারতকে নিয়ে বিপদে থাকার কথাও।
মামলার অপর আসামিরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলফাতারা কাজল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী শোভন মজুমদার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী হাসান ইমাম শোভন।
গতকাল শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। রবিবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক তারেক মোহাম্মদ মাসুদ তাদের আদালতে হাজির করে সাত দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, গত ১৩ ডিসেম্বর ভোরে রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন পান্থপথস্থ আল বারাকা রেস্টুরেন্টের সামনে পাকা রাস্তার ওপর এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাতানামা ১০০-১৫০ জন আসামি সমবেত হয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ব্যানার ব্যবহার করে জনসম্মুখে সরকারের বিরুদ্ধে অপ-প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং ছাত্রলীগের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে মিছিল বের করে। তারা বিভিন্ন উস্কানিমূলক স্লোগান দেয়। এছাড়া তাদের মিছিল ও স্লোগান ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচার করতে থাকে। আসামিরা এই মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত মর্মে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আবেদনে আরও বলা হয়, সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরও তাদের মিছিল করার উদ্দেশ্য, সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে তারা কী কী ষড়যন্ত্র করছে, কোথায় কোথায় তাদের আরও মিছিল করার সম্ভবনা আছে, তাদের অর্থের যোগানদাতা, কোথা থেকে জনবল সংগ্রহ করা হয়, তাদের ব্যবহৃত ব্যানার উদ্ধার, অন্যান্য পলাতক আসামিদের অবস্থান সনাক্ত ও গ্রেপ্তার, অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ, অবস্থান নির্নয় ও গ্রেপ্তার করা, মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করার লক্ষ্যে তাদের ব্যাপক ও গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের পুলিশ রিমান্ড একান্ত প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন। আসামিদের পক্ষে ফারজানা ইয়াসমিন (রাখি) রিমান্ড বাতিল চেয়ে তাদের জামিন আবেদন করেন।
ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানিতে বলেন, “ফ্যাসিবাদ দেশে নাই। পাশের দেশে থেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। এরা ফলোআপ করছে। ধানমন্ডি-৩২ এর আশেপাশে তারা ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে। দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যাঘাতে বসে নেই তারা। গত ১৫ বছর কী করছে তারা। তাদের কোনও অনুশোচনা নেই, ফিলিংস নেই। তাদের সর্বোচ্চ রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।”
এরপর আসামিদের পক্ষে ফারজানা ইয়াসমিন (রাখি) তাদের রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।
শুনানিতে তিনি বলেন, “হাসান ইমাম শোভন চাকুরীজীবী। তার ডকুমেন্ট আছে। শোভন মজুমদার সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। ওই বাসায় সাবলেট হিসেবে আছে। পদ-পদবি না থাকলেও ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। যে কাউকে ধরে এনে ট্যাগ দেওয়া যায়।”
ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, নদী ২০১৮ সালের পরে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি চাকরীজীবী। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বলে ছাত্রলীগের তোপের মুখে পড়েন। আর সংগঠন করা অপরাধ না। তারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছেন। ছাত্রলীগের ব্যানার ব্যবহার করে নাই।
এরপর ফারজানা ইয়াসমিন আদালতকে বলেন, আসামিরা কিছু বলতে চান।
প্রথমে হাসান ইমাম শোভন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে বলেন, তার তিনটা প্রশ্ন আছে।
এ সময় আইনজীবীরা বলেন, এটা প্রশ্ন করার জায়গা না।
পরে হাসান ইমাম শোভন বলেন, “ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। মিছিল থেকে শুরু করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছি। এ কারণে অফিস থেকে শুরু করে সর্বত্র তোপের মুখে পড়ি। চাকরিও ছাড়তে হয়। ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে আসে। পরে এ মামলায় আসামি করেছে।”
শোভন মজুমদার বলেন, “তিন মাসে আগে ওই বাসায় সাবলেট হিসেবে উঠি। রাজনীতির সাথে জড়িত না।”
নদী বলেন, “২০১৮ সালের পর থেকে আমি সাবেক। জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের পক্ষে স্ট্যাটাস দিয়েছি। জয় বাংলা স্লোগান প্রত্যাহার করায় মিছিলে যাই। বাঙালি হিসেবে যে স্লোগান সবার আগে আসে, এটা প্রত্যাহার করায় মিছিল করি। এটা দলীয় স্লোগান ছিল না। জয় বাংলা নিষেধ- এমন তো না।”
এরপর আলফাতারা কাজল বলেন, “২০২১ সালের আগস্টে পড়াশোনা শেষ করি। এরপর বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু করি। এলাকায় চলে যাই। জুলাই-আগস্টে এলাকায় ছিলাম। চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসি। আপুর (বেনজীর আহমেদ নিশি) বাসা উঠি। আপুকে না পেয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে।”
এরপর নদী আবারও বলেন, “আমি কর্পোরেট জব করি। রাজনীতির সাথে ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নাই। আজ দুপুরেও ইন্টারভিউ ছিল। দিতে পারলাম না। রাজনীতির সাথে আমার সম্পৃক্তত নেই, ভবিষ্যতেও থাকব না।”
এরপর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক বলেন, “একজন এজাহারনামীয় আসামি। বাকিরা সন্ধিগ্ধ। পুলিশ তদন্ত করছে। আগের ফ্যাসিস্টের পুলিশ নাই। ভিডিও দেখে তাদের গ্রেপ্তার করেছে।”
তখন নদী বলেন, “ভিডিওতে তিনজনের কেউ তো নাই।”
তখন অন্য তিনজনও বলেন, তারাও ভিডিওতে নেই।
পরে ওমর ফারুক বলেন, তাদের পদগুলো নেটের মাধ্যমে বের করা হয়েছে।
আইনজীবীর এসব তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নদী হিন্দিতে বলেন, “কুচ ভি।”
একথা শুনে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “আর বইলেন না। ইন্ডিয়াকে নিয়ে বিপদে আছি।”
তখন নদী বলেন, “এটার মধ্যে পলিটিক্স ঢুকায়েন না। রাজনীতির পদ-পদবি আছে। আবার বলেন, রাজনীতি ঢুকায়েন না। এ দেশে ভালো না লাগলে ইন্ডিয়া চলে যান।”
পরে আদালত নদীসহ চার আসামির প্রত্যেকের দুই দিন করে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতচ্যুত হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে আছেন দলটির প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই। আত্মগোপনে আছেন ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতারাও। এর মধ্যে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকে আবার দেশ ছেড়েছেন বলে খবর মিলছে।
এরই মাঝে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে গত ২৩ অক্টোবর সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বঙ্গমাতা সাংস্কৃতিক জোটের নেতা মিষ্টি সুভাষসহ ২ জন কারাগারে
আন্দোলনের সময় ঢাকার ধানমন্ডিতে ওয়েলন্ডিং শ্রমিক হুমায়ন কবিরকে হত্যাচেষ্টা মামলায় বঙ্গমাতা সাংস্কৃতিক জোটের নেতা শিমু আক্তার বৃষ্টি ওরফে মিষ্টি সুভাষ ও নিলুফা ইয়াসমিনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত।
রবিবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি মডেল থানার উপপরিদর্শক আব্দুল করিম তাদের আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।
আসামিদের পক্ষে আইনজীবীরা তাদের জামিন আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরোধিতা করে। শুনানি শেষ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুদ্দীন হোসাইনের আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।
গতকাল শনিবার ধানমণ্ডি ৩২-এ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আটক হন তারা।
মামলায় বলা হয়, গত ৪ আগস্ট ধানমন্ডি ৩নং রোড এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন হুমায়ুন কবির। দুপুর আড়াইটার দিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় পেটের বামপাশে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলাটি করেন হুমায়ুন কবির। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ২০০-২৫০ জন। এ মামলায় সন্দেহভাজন আসামি মিষ্টি সুভাষ ও নিলুফার ইয়াসমিন।