অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের পর বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ষষ্ট মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৪২ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার (২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২৯ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা এক হাজার ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
মাসের বাকি ৩ দিনে (২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর) এই হারে এলে মাস শেষে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে ২৬৭ কোটি ৮০ লাখ (২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন) ডলারে। একক মাসের হিসাবে যা হবে সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২ দশমিক ৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে, ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন) ডলার।
গত বছরের ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ (১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২ দশমিক ২২ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন)।
অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে এক হাজার ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ (১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৮৮০ কোটি ৮৪ লাখ (৮ দশমিক ৮১ বিলিয়ন) প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে।
সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পাঁচ মাস ২৮ দিনে (১ জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বর) ১ হাজার ৩৫৫ কোটি ৮৩ লাখ (১৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনও প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
৪ মাস পর ২০ বিলিয়নের উপরে উঠেছে রিজার্ভ
এদিকে রেমিটেন্স বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। চার মাস পর ২০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠল দুই বছরের বেশি সময় ধরে চাপের মধ্যে থাকা এই সূচক।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
৯ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এর পর থেকে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করছিল।
গত ১১ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ আরও কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় রিজার্ভ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করার শর্ত হিসেবে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
এক মাস আগে ২৮ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ১ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।