দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের প্রথম মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সপ্তম মাস জানুয়ারির ১১ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৭৩ কোটি ৬৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ৮১৭ কোটি টাকা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল এক হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে, ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। এ হিসাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে ৩২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল, যা ছিল আগের বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। প্রতিদেনর গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ডলারের বেশি।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার; প্রতিদিনের গড় হিসাবে যা ছিল ৭ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)। প্রতিদিনের গড় হিসাবে ছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসের পাঁচ মাসই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এর আগে কখনোই এমনটা দেখা যায়নি।
অর্থবছরের ছয় মাসের (প্রথমার্ধ, জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে এক হাজার ৩৭৭ কোটি ৭১ লাখ (১৩.৭৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। তা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৮০ কোটি (১০.৮০ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল দেশে।
গত অর্থবছরে মোট ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
বছরের হিসাবে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ২০২১ সালের আসে ২২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের আসে ২১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের এসেছিল ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমে গিয়েছিল।
ওই আন্দোলনের সময় সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনও রেমিটেন্স আসেনি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
রেমিট্যান্স শুধু প্রবাসী আয় নয়, তা অর্থের একটি আন্তর্জাতিক প্রবাহও। কোনও কোম্পানি তার অন্য দেশের শাখায় অর্থ পাঠালে কিংবা কোনও ব্যক্তি অন্য দেশে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থ পাঠালে সেটাও রেমিটেন্স। এছাড়া কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি অন্য দেশের কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিকে দান করার জন্য অর্থ পাঠালে সেটাও রেমিটেন্স হিসাবে ধরা হয়ে থাকে।
রিজার্ভ ২০ বিলিয়নে নেমেছে
বর্তমান সময়ে অর্থনীতির আলোচিত সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর ফের ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের রিজার্ভ কমে গেছে।
আকুর দেনা শোধের আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
গত ১১ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।
এরপর রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির এই সূচক বাড়তে থাকে। এছাড়া আইএমএফ চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করার শর্ত হিসেবে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়তে থাকে।
২৪ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ওই দিন গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।
এরপর ২৯ ডিসেম্বর এশীয় উন্নয়ন তহবিলের (এডিবি) ৬০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার ঋণ যোগ হওয়ায় রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
৮ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ আরও বেড়ে ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। গ্রস হিসাবে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
৯ জানুয়ারি আকুর দেড় বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গ্রস হিসাবে নেমেছে ২৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, রমজান মাসকে সামনে রেখে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বেশি পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন। সে কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের আকুর আমদানি বিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের চেয়ে বেশি হবে।
এক বছর আগে গত বছরের ৮ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ২৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি।
