শুধু সন্দেহের বশে তাসলিমা বেগম রেনুকে যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তা ছিল বীভৎস, নারকীয় ও নৃশংস। এই হত্যামামলার রায় দেওয়ার সময় ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারক। তিনি আরও বলেছেন, এভাবে মানুষ হত্যার লাইসেন্স কাউকে দেওয়া হয়নি।
পাঁচ বছর আগে ঢাকার বাড্ডার একটি স্কুলে রেনুকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় বুধবার রায় দেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৬ এর বিচারক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম।
রায়ে ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা নামে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় চারজনকে। তারা হলেন- রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলাম।
মো. শাহিন, বাচ্চু মিয়া, বাপ্পি ওরফে শহিদুল ইসলাম, মুরাদ মিয়া, সোহেল রানা, বেল্লাল মোল্লা, মো. রাজু ওরফে রুম্মান হোসেন ও মহিউদ্দিন নামে বাকি আট আসামি খালাস পেয়েছেন।
আসামিদের উপস্থিতিতে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বিচারক আলোচিত এই মামলার রায় পড়া শুরু করেন। তিনি প্রথমেই বলেন, “এটা একটা চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি।”
এই মামলার রায়ের ক্ষেত্রে ভিডিও যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে, তা জানানোর সঙ্গে চারটি ভিডিও ক্লিপ দেখান বিচারক।
তিনি বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ফুটেজ। এটা না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়াটা কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ। আমি দেখাতে চাই।”
পরে আদালত ৫ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ আদালতে দেখান। ভিডিওতে বোনকে নৃশংসতার শিকার হতে দেখে কেঁদে ফেলেন আদালতে উপস্থিত রেনুর বোন নাজমুন নাহার নাজমা।
এর মধ্যে বিচারক কাঠগড়ায় থাকা আসামিদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “আবুল কালাম কে?” তখন হাত তোলেন আবুল কালাম, যার যাবজ্জীবন সাজা হয়।
বিচারক বলেন, “দেখছেন আপনাকে?” আবুল কালাম বলেন, “দেখা যায়নি।”
তখন কামালকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, “আপনি দেখেন তো, কী করছেন।”
কামাল বলেন, “আমি সবাইকে বলেছি- থাম, দয়া করে থাম। শোনো সে (রেনু) কী বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনে না।”
এরপর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হৃদয়কে বিচারক বলেন, “দেখবা, তোমাকে চিনতে পার কি না?”
ভিডিও দেখানো শেষ হলে বিচারক বলেন, “বেশিরভাগই মেরেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে, সন্দেহ নেই।”
আসামিদের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরে রায়ে জজ মোরশেদ আলম বলেন, রিয়া ও হৃদয় ছেলেধরার গুজব ছড়ায়। আজাদের নেতৃত্ব ও নির্দেশে দ্বিতীয় তলা থেকে রেনুকে টেনে-হিঁচড়ে নামায়। এসময় রিয়া চুল টানাটানি করে। স্কুলের মাঠে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলে কামাল মাথায় চাপ দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আসাদ ঘুষি মারে।
হৃদয়কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষে যুক্তি পাওয়া যায় এই পর্যায়ে বিচারকের ভাষ্যে।
“হৃদয় কাঠের লাঠি দিয়ে পেটায়। পেটাতে পেটাতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে যায়। বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আবার পেটায়। হৃদয় নির্দয়, নির্মমভাবে পেটায়, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত।
“কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামিরা আইন-কানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাঁধে, বুকে, উরু ও পাসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকেন। রেনুকে হত্যা ছিল বীভৎস, নারকীয় ও নৃশংস।”
হৃদয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি এড়ানোর কোনও সুযোগ ছিল না মন্তব্য করে বিচারক বলেন, “আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে হত্যা করেছেন এবং দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছে। নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করেছেন।
“তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নাই। কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। অপরাধ সংগঠনের সময় তিনি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ততা ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছেন, সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংগঠিত আপরাধের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছেন। একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কলঙ্কে পরিণত হয়ে যান, তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়।”
বিচারক যখন রায় পড়ছিলেন, তখন কাঠগড়ায় থাকা হৃদয় শাস্তির কথা শুনে কাঁদতে থাকেন।
রেনুকে ছেলেধরা বলে গুজব ছড়িয়ে হত্যা করা হলেও তার কোনও আলামত যে ছিল না, তা রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।
“তিনি ছিলেন নিরস্ত্র। আসামিরা নিষ্ঠুরভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। নির্দোষ প্রমাণে তাকে কোনও সুযোগ দেয়নি। বাঁচার আকুতি উপেক্ষা করে। আঘাতের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে ঘটনার দিনই সে মারা যায়।”
গণপিটুনির এমন ঘটনার যে বিরূপ প্রভাব ফেলে, আতঙ্ক ছড়ায়, রায়ে তাও উল্লেখ করেন বিচারক মোরশেদ আলম।
তিনি বলেন, “গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যে কোনও মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গণপিটুনির নামে মানুষ হত্যার লাইসেন্স কাউকে দেয়া হয়নি।
“অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।”
যেভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন রেনু
২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রেনু গিয়েছিলেন তার মেয়েকে ভর্তি করার বিষয়ে খবর নিতে।
রেনুর বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। এক ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী রেনু ঢাকায় চাকরি করতেন। বিয়ের পর দুটি সন্তান হয় তার।
নিহত হওয়ার দুই বছর আগে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে রেনুর। তা নিয়ে কিছুটা বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি। ছেলেটি বাবার সঙ্গে থাকলেও ছোট মেয়েটিকে (তখন বয়স ৪ বছর) নিয়ে মহাখালীতে থাকতেন রেনু।
সেই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতেই বাড্ডার ওই স্কুলে গিয়েছিলেন রেনু। তবে তখন দেশে ছেলেধরা গুজব চলছিল। তার মধ্যে তার কথায় অসংলগ্নতা দেখে তাকে সন্দেহ করে স্থানীয়রা। এক পর্যায়ে গণপিটুনির শিকার হন তিনি।
তখন পুলিশ জানিয়েছিল, রেনুকে ধরার পর রিয়া বেগম ময়নাই প্রথম ছেলেধরা বলে শোর তুলেছিলেন।
ঘটনার দিন রেনু স্কুলে ঢোকার সময় গেটে থাকা অন্য এক নারী অভিভাবক তার পরিচয় এবং বাসার ঠিকানা জানতে চান। তখনই ময়না ছেলেধরা বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।
তখন রেনুকে স্কুলের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। এরমধ্যে ছেলেধরা আটকের খবর পেয়ে হাজারো মানুষ ভিড় জমায়। তার মধ্যেই জনতা স্কুলের ভেতরে ঢুকে রেনুকে বের করে মাঠে নিয়ে আসে।
হৃদয় স্কুলের পাশেই একটি দোকানে সবজি বিক্রি করতেন। সবজি বিক্রি শেষে তিনিও ভেতরে এসে রেনুকে পেটানোয় অংশ নেন।
ঘটনার পরপরই হৃদয় পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ নারায়ণগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর হৃদয় কাঁদার পাশাপাশি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। তিনি কারাগারে যেতে চাচ্ছিলেন না। পুলিশ সদস্যরা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
আদালতে থাকা বোনকে হৃদয় বলতে থাকেন, “আমার তো ফাঁসি হয়ে গেছে। আজই ফাঁসি দিব।” তখন দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিদের স্বজনরাও কান্নাকাটি শুরু করে।
রায়ে সন্তুষ্ট নয় কোনও পক্ষ
রেনু হত্যাকাণ্ডের পর তা ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু থানায় গিয়ে ছবি দেখে খালার লাশ শনাক্ত করেন। তিনি তখন বলেছিলেন, “মানুষ কতটা কতটা পশুর মতো নির্মম হলে এভাবে একটা মানুষকে মারতে পারে।”
অজ্ঞাত পরিচয়ের ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছিলেন টিটু। এক বছর পর ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আব্দুল হক ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন।
২০২১ সালের ১ এপ্রিল ১৩ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর শুরু হয় বিচার। ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় হলো বুধবার।
মামলা দায়েরের পর টিটু বলেছিলেন, “এ ঘটনার এমন সাজা হওয়া দরকার, যা সব মানুষকে একটা বার্তা দেবে যে আইনের কাজগুলো যাতে মানুষ নিজের হাতে তুলে না নেয়। তাদের শাস্তিটা হবে সব ধরনের কুসংস্কার ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে। এমন একটা শাস্তি হবে, যা বার্তা দেবে পশুত্বের বিরুদ্ধে।”
বুধবার রায়ের সময় রেনুর দুই-সন্তানকে নিয়ে আদালতে ছিলেন টিটু। তার বোন নাজমুন নাহারও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
সবার শাস্তি না হওয়ায় রায়ে সন্তুষ্ট নন টিটু। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।” রেনুর বোন নাজমুন আরাও একই কথা বলেন।
আসামিদের পক্ষের আইনজীবীরাও রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, এটা উদ্দেশ্যমূলক হত্যাকাণ্ড ছিল না। আসামিরা না বুঝে এসব করেছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
এই রায়ে বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানান আসামি পক্ষের আইনজীবীরাও।