ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বহুদিনের। তেহরানকে শতাধিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত করে ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞার জালে আটকা ইরানকে তার উৎপাদিত তেল বিক্রি করে অর্থ উপার্জনে নিতে হয়েছে নানা উদ্যোগ। এর মধ্যে কিছু উদ্যোগ প্রকাশ্য, আর কিছু গোপন।
এসব গোপন উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে নিজের উৎপাদিত অপরিশোধিত তেলের উৎস গোপন করে অন্য দেশের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে তা বিক্রি করা।
আর এই কাজে জড়িত ইরানের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ দেশটির সর্বোচ্চ নেতার ঘনিষ্ঠও।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনই এক কর্মকর্তা ও তার ছেলের গোপন তেল সাম্রাজ্যের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে; যদিও এ নিয়ে ইরানের কোনও প্রতিক্রিয়া স্থান পায়নি প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শক্তিশালী নিরাপত্তা উপদেষ্টা আলি শামখানির নাম এসেছে। তারই ছেলে হোসেন শামখানি বাবার প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে গোপনে গড়ে তুলেছেন বিশাল তেল সাম্রাজ্য। শুধু তাই নয়, তিনি হয়ে উঠেছেন বৈশ্বিক তেলের বাজারের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও নজরদারির মধ্যেও তিনি কীভাবে বৈশ্বিক তেলের বাজারে নিজের প্রভাব বজায় রেখেছেন, তা দেখিয়েছে ব্লুমবার্গ।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান ও রাশিয়ার তেল বাণিজ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানের ছেলে হোসেইন শামখানি দুবাই থেকে আন্তর্জাতিক তেলব্যবসা চালান।
আলি শামখানি এক দশক ধরে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এসএনএসসি) সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন। গত বছর থেকে তিনি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান।
ইরানের রাজনীতিতে আলি শামখানি বেশ ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব। পাশাপাশি তার ছেলে নিঃশব্দে একটি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, যা এখন বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে।
শামখানিরা ইরানে ক্ষমতাধর পরিবার হিসাবেই পরিচিত। হোসেন শামখানি দেশটির অন্য অনেক ইরানি কর্মকর্তাদের সন্তানদের মতোই শিপিং এবং আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে তার দুবাইভিত্তিক কোম্পানি মিলাভাস গ্রুপ লিমিটেডসহ তার সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়গুলো নতুন করে সামনে এনেছে।
দুবাইয়ে গোপন কার্যক্রম
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই বছর আগেও তুলনামূলকভাবে অজানা ছিল মিলাভাস গ্রুপ লিমিটেড। এটি তখন দুবাই কর্পোরেট টাওয়ারে একটি প্রিমিয়াম অফিস স্পেস লিজ নেয়। কয়েক মাসের মধ্যে কোম্পানিটি বিশ্ব তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করে।
কোম্পানির কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত বিভিন্ন সূত্রের মতে, ট্রেডিং সার্কেলে ‘হেক্টর’ ছদ্মনামে কাজ করা হোসেন শামখানি এই মিলাভাসের পেছনের প্রধান চালিকাশক্তি।
দুবাইয়ের কার্যালয় থেকে মিলাভাস ইরান, রাশিয়া এবং অন্য দেশ থেকে আনা জ্বালানি পণ্য বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে।
তারা তাদের জ্বালানি পণ্যের উৎসকে গোপন রেখে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে চলে। এর মধ্য দিয়ে শামখানি বিশ্বব্যাপী ইরানের তেল বিতরণে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত এক ডজনেরও বেশি সূত্রের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ব্লুমবার্গ হোসেন শামখানির কার্যকলাপ বিশদে উন্মোচন করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, আন্তঃসংযুক্ত ব্যবসার একটি জটিল, বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ইরান ও রাশিয়ার জ্বালানি বিশ্ববাজারে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে যারা ব্লুমবার্গকে এই গোপন ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে তথ্য দিয়েছেন, তারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
শামখানির সাম্রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তিরা বলেছেন, তিনি কার্যকরভাবে অনেকগুলো কোম্পানির একটি আন্তঃসম্পর্কিত নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধান করেন। মিলাভাস সেগুলোর মূল কোম্পানি হিসেবে কাজ করে। ব্যবসার মালিকানা, শেয়ারহোল্ডিং এবং নিয়ন্ত্রণের তথ্য গোপন করার জন্য কোম্পানিটির প্রায় সব কর্মকর্তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মালিক ও ব্যবস্থাপক হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
মিলাভাস তার সহযোগী কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে ইরান ও রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল এবং বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্যের মিশ্রণ এবং পুনঃব্র্যান্ডিংয়ের কাজ করে। আরব আমিরাতের বন্দর শহর ফুজাইরাহতে তাদের এই কার্যক্রম চলে। নিষেধাজ্ঞার অধীন নয়, এমন দেশ থেকেও তারা জ্বালানি পণ্য এনে বিক্রি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট এবং এফবিআইয়ের সাবেক সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের কর্মকর্তা ম্যাথু লেভিট ব্লুমবার্গকে বলেন, “বিশ্ব জ্বালানি বাজারের কেউ তার আসল পরিচয় এবং তার সরবরাহ করা জ্বালানি পণ্যের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে জানতে পারে না।”
এমনকি মিলাভাসসহ শামখানির কোম্পানিগুলো চীনের সিনোপেক, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন এবং যুক্তরাজ্যের বিপিসহ জ্বালানি শিল্পের বড় বড় কোম্পানিতেও তেল সরবরাহ করে।
ব্লুমবার্গ জানায়, মিলাভাস ২০২২ সালে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি বিক্রি করেছিল।
বাবার মতো হোসেন শামখানিকেও নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী হিসাবে তালিকাভুক্ত করেনি যুক্তরাষ্ট্র। সংযুক্ত আরব আমিরাতও ইরান বা রাশিয়া থেকে আনা অপরিশোধিত তেলের ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোকে নিষিদ্ধ করেনি।
তবে যুক্তরাষ্ট্র হোসেন শামখানির ওপর নজর রাখে। তার নিয়ন্ত্রণাধীনে আছে বলে বিশ্বাস করা কয়েক ডজন জাহাজের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
কিন্তু জাহাজগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রকাশ করা হয়নি। মালিকানায় ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে ব্যক্তির পরিবর্তে ট্যাঙ্কারগুলোকে টার্গেট করাকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি কার্যকর বলে মনে করে।
প্রভাব এবং ফাঁকি
অনেকে শামখানির নেটওয়ার্ককে ইরানের বৃহত্তম তেল বাণিজ্য সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আইনি ফাঁক-ফোকর, কৌশলগত অংশীদারত্ব এবং শেল কোম্পানির একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে চলে শামখানির তেল সাম্রাজ্য।
২০২২ সালে অ্যাডমিরাল শিপিং কোম্পানির একটি কার্গো জাহাজকে ভারতের একটি বন্দরে আটক করা হয়েছিল। ইরানি সংবাদমাধ্যমে অ্যাডমিরাল শিপিং কোম্পানির মালিক হিসেবে হোসেন শামখানি ও তার ভাইয়ের নাম উল্লেখ করা হয়।
শামখানি ও মিলাভাস বারবার কোনও অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। এক লিখিত বিবৃতিতে শামখানি স্পষ্টভাবে মিলাভাসের সঙ্গে তার সংযোগের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তেল কোম্পানি বা ট্রেডিং নেটওয়ার্কের উপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
মিলাভাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আল হাশমিও শামখানির সঙ্গে সম্পর্ক বা ইরান ও রাশিয়ার তেল ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন মতে, হোসেন শামখানির প্রায় ৬০টি কার্গো জাহাজ রয়েছে। কিন্তু ব্যাপক গোপনীয়তার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তার নেটওয়ার্ক ভাঙা সম্ভবপর হচ্ছে না।
এছাড়া শামখানির কার্যক্রম বন্ধ করতে গেলে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়বে। ইরান তেল রপ্তানি থেকে বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে বলে অনুমান করা হয়। ফলে ইরানের তেল বিক্রি বন্ধ করে দিলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হবে। বেড়ে যাবে তেলের দাম।
আর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী বছরে দেশটির ভোটারদের সবার নজর থাকে জ্বালানির দামের ওপর। ফলে যুক্তরাষ্ট্র শামখানির বিরুদ্ধে চাইলেও কোনও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
দুর্নীতি ও ভোগবিলাস
শামখানির নেটওয়ার্ক ইরানের বাইরে কয়েকটি দেশজুড়ে বিস্তৃত। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর পড়তে তেহরানে ফিরে আসার আগে হোসেন মস্কো ও বৈরুতে পড়াশোনা করেন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় তেহরান ও মস্কো গভীর অর্থনৈতিক ও সামরিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলায় রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
তেল শিল্পে হোসেন শামখানির উত্থান তার পরিবারের উত্তরাধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তার বাবা কয়েক দশক ধরে ইরানের সামরিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার অনেক সহকর্মীর মতো তিনিও কেলেঙ্কারির শিকার।
তার দুই ছেলে হাসান ও হোসেন শামখানি কয়েক ডজন ব্যবসার মালিক। এছাড়া ইরানসহ বিভিন্ন দেশে তার পরিবারের সদস্যদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের খবরও মেলে।
ইরান ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মোজতবা পৌরমোহসেন। তিনি শামখানির ভাগ্নে মওদ ও নাজি শামখানির দুর্নীতিসহ তার পারিবারিক দুর্নীতি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ঘটনা ফাঁস করেছেন।
ছোট নাতিসহ আলি শামখানির পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের অযৌক্তিক সম্পত্তি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অভিযোগের পরে তাকে নিয়ে বিতর্ক চরমে পৌঁছেছিল।
২০২২ সালে শামখানি পরিবার ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম খুজেস্তান প্রদেশে একটি বিল্ডিং ধসেও জড়িত ছিল। ওই ঘটনায় বহু মানুষ নিহত হয়। ভবনটির মালিক হোসেন আবদোলবাগী একজন পরিচিত ব্যবসায়ী। ভবনটি নির্মাণের সময় তিনি একাধিক নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন এবং শামখানি পরিবারের সদস্যসহ কর্মকর্তাদের সমর্থন পেয়েছিলেন।
আলি শামখানি তার ছেলেকে বেসরকারি খাতে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য উৎসাহিত করলেও তার যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিঃসন্দেহে হোসেনের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তথ্যসূত্র : ব্লুমবার্গ, ইরান ইন্টারন্যাশনাল, এনডিটিভি