নতুন বছরকে বরণ করে নিতে বিশ্বের সব দেশেই নানা ধরনের আয়োজন থাকে। রাত ১২টা বাজতেই আতশবাজি কিংবা লেজার লাইট শো’র মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোয় মেনে চলতে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম। যেমন খোলা মাঠ বা জনবসতি নেই এমন জায়গায় আয়োজন করা হয় আতশবাড়ি পোড়ানোর উৎসব।
তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশ। এখানে বাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো নিষিদ্ধ হলেও প্রতি বছরই থার্টি ফার্স্ট নাইটে রাত ১২টা বাজতেই চারপাশ থেকে ভেসে আসতে থাকে বাজি-পটকার শব্দ। প্রশাসনের অনুরোধ কিংবা নিষেধাজ্ঞাও বেশিরভাগ সময় কাজে লাগে না।
সোমবার রাতে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী মুন্নাফ রশীদ। তিনি লিখেছেন, “থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রস্তুতি হিসেবে বাজি ফোটানোর মহড়া চলছে মহল্লায়। ১০ মাসের মেয়ে আমার আঁতকে উঠছে বারবার। না জানি ৩১ তারিখ রাতে কী হবে! ভয় পাই, বড্ড ভয় পাই।”
কথা হয় মুন্নাফের সঙ্গে যিনি বাস করেন ঢাকার বাংলা মোটরের পুকুরপাড় এলাকায়।
তিনি জানালেন, সন্ধ্যার পর থেকেই এলাকায় বাজি ও পটকা ফোটানো শুরু হয়েছে। বিকট সেই শব্দে তার ১০ মাসের মেয়ে ঘুমের ভেতরে কেঁপে কেঁপে উঠেছে, কেঁদেছে। তিনি সবার প্রতি নতুন বছরকে বরণ করতে গিয়ে আতশবাজি কিংবা পটকা ফোটানোর মতো কাজ না করতে অনুরোধ করেন।
এই আতঙ্ক থেকে বাঁচতে অনেকেই পরিবারের শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
নতুন বছর উদযাপনে আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ফানুস উড়ানোর সংস্কৃতি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন অভিনেত্রী জয়া আহসানও।
এক ফেইসবুক পোস্টে জয়া বলেন, “বছরের শেষদিনে বিকট শব্দে পাখিদের ঘুম ভাঙে, ফানুস পড়ে পুড়ে যায় ঘর। তাতে কেউ কেউ পুড়ে মরে, কেউবা আতঙ্কিত হয়ে আকাশে উড়াল দেয়,আবার কারও গায়ে লাগে আতশবাজি। আবার কোনও পাখি আতঙ্কিত হয়ে বিল্ডিংয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রাণ হারায়।
“শুধু পাখির কথা কেন, এই শহরের কুকুর-বিড়াল-মুরগি-কীটপতঙ্গসহ সবাই-ই অস্থির হয়ে যায় নগরবাসীর আতশবাজি আর ফানুস উৎসবে। এমনকি ডিমের ভেতর বাচ্চা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়।”
২০২২ সালের আতশবাজির কারণে মারা যাওয়া তানজীম উমায়েরের কথা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, “ছোট্ট উমায়েরের এই মৃত্যুর দায় কেন এই নগরবাসী নেবে না? আপনারা যারা আতশবাজি ফুটিয়েছিলেন তারা কেউ কি এই দায় থেকে মুক্ত?”
২০২২ সালে নতুন বছর উদিযাপনে আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়ে শিশু তানজীম উমায়ের। পরদিন হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর সাত বিধি লঙ্ঘন কনে অনুমোদনহীনভাবে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের সময়ে আতশবাজি ও পটকা ফোটালে তা বিধিমালার ১৮ বিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। এ আইন লঙ্ঘনে প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ১ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিবার এ নিয়ে সতর্ক করা হয়, হুঁশিয়ারী দেওয়া হলেও এ কারণে কেউ কখনো শাস্তি পাওয়ার উদাহরণও নেই।
শুক্রবার থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। তারা বলছেন, এটা জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড।
ফেইসবুকে আতশবাজি, ফানুসকে না
চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই এ নিয়ে ফেইসবুকে দুটি ইভেন্ট খোলা হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে থার্টিফার্স্টে আতশবাজি ও ফানুসকে না বলি এবং আনেকটি হচ্ছে থার্টি ফার্স্ট নাইটে ফানুস, পটকা আর আতশবাজি জ্বালানো প্রতিহত করুন।
অসংখ্য মানুষ এই দুটি ইভেন্টে যোগ দিয়ে এই প্রাণীহত্যা, শব্দদূষনের বিরুদ্ধে নিজেদের সংহতি জানিয়েছেন।
রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মো. নাজমুল হোসেন রাজু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নিজেদের একটুখানি আনন্দের জন্য আমরা প্রতিবছর এই অন্যায় এবং অমানবিক কাজ করি। কিন্তু কেউ ঘরের অসুস্থ মানুষ, শিশু, পাখিদের কথা ভাবি না; যেটা আমাদের ভাবা উচিত ছিল। একটা শিশুতো মারা গেল, কত কত পাখি মারা যায়।
“ফানুস পড়ে আগুন লাগার মতো ঘটনাতো আছেই। তাই সচেতনতা বাড়াতে আমরা এই ইভেন্টের আয়োজন করেছি। এখানে মানুষ অনলাইনে অংশ নিয়ে একাত্মতা জানিয়েছেন। ধীরে ধীরে এই সচতেনতা আরও বাড়বে বলে আশা করি।”
আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানোকে ‘না’ বলতে সবার প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।
মানুষ এবং পশুপাখির জন্য আতশবাজির শব্দ কতোটা ক্ষতিকর জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. দেওয়ান সাবরিনা মাসুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পাখি এবং প্রাণীদের শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তাই যে আতশবাজির শব্দ মানুষের কাছে সহনীয়, তা তাদের কাছে আরও অনেক অনেক গুণ বেশি। এই শব্দে তাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ঘটনাও আছে, সেই সঙ্গে পথ খুঁজে না পেয়ে আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা তো আছেই।”
গত বছরগুলোয় এই আওয়াজে শিশু এবং বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে সাবরিনা মাসুক বলেন, “যারা হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিল দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তারা যেকোনো সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এবং সেটা ভয়াবহ আকার নিতে পারে।”
তিনি বলেন, “অতিরিক্ত শব্দের কারণে শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ঘোরা, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়া, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াসহ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।”
প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা জাতীয় কমিটি জানিয়েছে, ১০২ ডেসিবল মাত্রার শব্দদূষণে ১০ মিনিট কোনও শিশু থাকলে সে স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যেতে পারে।
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে আতশবাজির জন্য শব্দদূষণ ১১৩ ভাগ বেশি ছিল, বায়ুমান ছিল ৫০০ একিউআই পর্যন্ত, যা মানুষের সহ্যক্ষমতার তুলনায় নয় গুণ বেশি। একই রাতে প্রায় সহস্রাধিক পাখির মৃত্যু হয়, সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০০টি।
অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি
শুধু ২০২৩ সালের শুরুতেই আতশবাজি পোড়ানো বা ফানুস ওড়ানোর অগ্নিকাণ্ডে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছিল বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
২০২২ সালে প্রায় ১০০ টির মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এমনকী গত বছরে ফানুসের আগুনে মেট্রোরেলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন হয়ে বন্ধ ছিল দুই ঘণ্টার মতো। ২০২০ সালে ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৭২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং ২০১৮ সালে ৪২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৫৬ লাখ ৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
সরকারি জরুরি সেবাদান প্রতিষ্ঠান ৯৯৯ চলতি বছরের শুরুতে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্টের আতশবাজি, পটকা, ফানুসের কথা জানিয়ে বলে, উচ্চ শব্দে গানবাজনা, আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর নিষেধাজ্ঞা এবারও মানা হয়নি।
বরং আগের বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে এই ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’ নম্বরে এই নিয়ে অভিযোগ ছিল সাড়ে আট গুণের বেশি। আর ২০২৩ সালে অভিযোগ এসেছে আড়াই গুণের বেশি।
৯৯৯–এর তথ্য অনুসারে, ৩১ ডিসেম্বর রবিবার রাত ১০টা থেকে পরদিন সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত উচ্চ শব্দে গানবাজনা ও শব্দদূষণ–সংক্রান্ত ৯৭১টি অভিযোগ এসেছে। বাসায় অসুস্থ ব্যক্তি আছেন, কম বয়সী শিশু উচ্চ শব্দে ভয় পেয়ে ঘুমাতে পারছে না বা নিজেরা ঘুমাতে পারছেন না বলে অভিযোগ করা হয়। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ঢাকা মহানগর থেকে।
ফোন কল ছিল ৯৭১টি, ২০২৩ সালে যা ছিল ৩৬৫ টি,২০২২ সালে ছিল ১১২টি।
২০২২ সালে আতশবাজি ও ফানুস থেকে রাজধানীর ছয় জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী ও ধোলাইখাল এলাকায় ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভায়।
বাড়ে শব্দদূষণ-বায়ুদূষণ
ইংরেজি নতুন বছর উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানোর কারণে রাজধানী ঢাকায় গত সাত বছরে আগের দিনের (৩১ ডিসেম্বর) তুলনায় পরদিন (এক জানুয়ারি) বায়ুদূষণ বাড়ে গড়ে ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত সাত বছরে একই কারণে এক দিনের ব্যবধানে শব্দদূষণ বাড়ে গড়ে ৭৪ শতাংশ। শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে ৩০ ডিসেম্বরের (রাত ১১টা থেকে ১টা) সঙ্গে পরদিন ৩১ ডিসেম্বরের (রাত ১১টা থেকে ১টা) তুলনা করা হয়েছে বলে জানান ক্যাপসের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রাতের শুরুতে বায়ু ও শব্দদূষণের তীব্রতা দেখে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এর একটি গবেষণা দল। সেসময় দেখা যায়, ২০২৪ সালের নববর্ষে রাত ১১টা থেকে ১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘণ্টা অর্থাৎ ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বায়ুদূষণের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ বেড়েছিল। প্রথম ঘণ্টায় শব্দদূষণের হার এর আগের দিনের (৩০ ডিসেম্বর) তুলনায় প্রায় ৪২ শতাংশ বাড়ে এবং বেশির ভাগ সময় শব্দের মাত্রা ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবলের মধ্যে ছিল।”
আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, “শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে আছি।”
সোমবার ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় এয়ার (বায়ু) এবং নয়েজ (শব্দ) দূষণ মাপতে যন্ত্র বসানো হয়েছে বলে জানান তিনি। সোম ও মঙ্গলবারের তথ্য হিসাব করার পর পার্থক্য বোঝা যাবে বলে জানান তিনি।
তবে এবার বেশ কয়েকদিন আগে থেকে ফেইসবুকে এ নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করা যাচ্ছে এবার পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
থাকবে মোবাইল কোর্ট
ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষ্যে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস উড়ানো বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর কারণে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ হয়। অতিরিক্ত শব্দদূষণে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও মানসিক চাপের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া ফানুস উড়ানোর ফলে অগ্নিকাণ্ড ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়।
ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস উড়ানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকার ক্লাবগুলোতে এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।