মিরপুর সড়কের পশ্চিম দিকে ও লেক সড়কের ক্রসিংয়ে ঢাকার শের-ই-বাংলা নগরের বি-ব্লকের ৫ নং প্লটে ছিল তাদের ঠিকানা। হ্যাঁ, এটাই গণভবন, যা ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। মানুষ বাদেও এই ভবনটি ছিল বিচিত্র পোষা প্রাণীর বাসস্থল।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়লে, বাস্তুচ্যুত হয় এইসব প্রাণীরাও।
পনেরো একর জায়গা জুড়ে গণভবন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে সিরামিক ইটের ভবন লাগোয়া জমিতে গোলাপ বাগান, রকমারি ফুলের বাগান, ফলজ গাছ আর সুবিশাল লন ছিল। গণভবনের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত রয়েছে লেইক। আর লেইকের পশ্চিমে আছে শান বাঁধানো ঘাট।
এই বাগান ও লেইকে ফুল, ফসল, শাকসবজি চাষ এবং মৎস্য ও পশুপালন হতো।
টানা দেড়যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে বাস করেছেন। অভ্যুত্থানের দিন খোলা ফটক পেরিয়ে ঢুকে পড়ে ছাত্র-জনতা। কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে গাছপালাও লুট হয়ে যায়।
লেকের মাছও তুলে নিয়ে যান অনেকে। গণভবনের ভেতরে থাকা হাঁস-মুরগি, খরগোশ, কুকুর, বিড়ালও যে যার মতো নিয়ে যান।
প্রাণী কল্যাণ সংস্থা অভয়ারণ্যের হিসেবে, গণভবন লুট হওয়ার আগে সেখানে ২০০ এর বেশি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, গাভী বা গরু ২ টি, বাছুর ২টি, ছাগল ২৬টি, রাজহাঁস ৩০টি, পাতিহাঁস ৬০টি, মুরগি (সংখ্যা জানা নেই), কুকুর ২টি, আনুমানিক ৫০টি খরগোশ, ৬টি বিড়াল এবং বিরল প্রজাতির পাখী অজানা সংখ্যক পাখি।
জার্মান শেফার্ড প্রজাতির দুইটি কুকুরের একটিকে কেউ নিয়ে গিয়ে আবার সেখানেই রেখে যান। চিকিৎসা দিতে এই কুকুরকে উদ্ধার করেন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০২৩’ মুকুটজয়ী শাম্মী ইসলাম নীলা। পরে তিনিও কুকুরটিকে গণভবনে দায়িত্বে থাকা এক সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার কাছে দিয়ে আসেন।
দুটো জার্মান শেফার্ডই উদ্ধার করা হয়েছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন অভয়ারণ্যের নির্বাহী পরিচালক কাওসার শাকিল।
তিনি বলেন, “জার্মান শেফার্ড কিন্তু পেট না। গার্ড ডগ হিসেবে রাখা হয়েছিল। এগুলো (শুঁকে শুঁকে খুঁজে বার করার জন্য) ট্রেইনড করা।
“এগুলো আমরা পিজিআরকে (প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট) বুঝিয়ে দিয়েছি। এটার টেককেয়ার সম্পূর্ণ তাদের। কারণ এটা তাদের প্রপার্টি। এই জার্মান শেফার্ডের একটা র্যাংক আছে। পিজিআরের প্রোটোকল অনুযায়ী ওরা কুকুর দুটোর টেককেয়ার করবে।”
শেখ হাসিনার পার্সিয়ান বিড়ালকে লুট করে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রিও করা হয়েছিল। ৭ আগস্ট এই বিড়াল উদ্ধারের হালনাগাদ জানায় বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।
‘অভয়ারণ্য’ নামে পরিচিতি এই প্রতিষ্ঠানের ফেইসবুকে পাতায় সবার উদ্দেশে বলা হয়, “আমাদের গণভবনের স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে।
“তারা আহ্বান জানিয়েছেন সবাইকে নির্ভয়ে গণভবনের প্রাণীগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমাদের উচিত হবে, এই বিষয়টি আরো জটিল হওয়ার আগেই তাদের এই আহ্বানে সাড়া দেওয়া এবং সহযোগিতা করা।”
এখন পর্যন্ত তিনটি বিড়াল উদ্ধার করা গেছে বলে জানিয়েছে অভয়ারণ্য।
কাওসার শাকিল বলেন, “একটি দেশি বিড়াল আগস্টের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে ৩টি বাচ্চা দিয়েছিল। ওই বিড়াল এবং বাচ্চা তিনটাকেও নিয়ে গেছেন কেউ।
“আমরা ট্র্যাক করতে করতে সৌভাগ্যক্রমে একজনকে খুঁজে পাই যিনি তিনটা ছানা নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি বলেন যে, তার কাছে একটা ছানা আছে বাকি দুটো তিনি দুজনকে আসার পথে দিয়ে দিয়েছিলেন। এরমধ্যে একজন কলেজপড়ুয়া মেয়ে আছে যে বিড়াল পালে। আরেকটা বিড়াল আরেকজন লোককে তিনি দিয়েছেন।”
“উনি আরও জানান, এই বাচ্চাটা পালতে চান না। কারণ এটা একেবারেই দুধের বাচ্চা। এটাকে উনার পক্ষে পালা সম্ভব না।”
“আমরা প্রথমে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করি উনার কাছ থেকে। এরপর গণভবনে কথা বলে জানি যে সেখানে নার্সিং মাদার নেই। মানে এত বাচ্চা বিড়াল কেয়ার করার মতো কেউ নাই। কারণ মা বিড়াল না থাকলে তো ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে। তাই আমরা একটা মা বিড়াল খুঁজে বার করে এই ছানা বিড়ালকে তার কাছে রেখে দিয়েছি। ছানা বিড়াল বড় হলে তখন আবার গণভবনে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হবে।”
আরও একটি বিড়ালের খোঁজ মিললেও গর্ভবতী হওয়াতে গণভবনে ফেরত আনা হয়নি এখনও।
“বিড়ালটি যার কাছে আছে তিনি বিড়াল পালেন। উনি টেক কেয়ার করছেন বলে আমরা খোঁজ নিয়েছি। উনি ভিডিও পাঠিয়েছেন। আমরা এসএসএফকেও জানিয়ে রেখেছি। বিড়ালটা বাচ্চা দেওয়ার পরে সুস্থ হলে উনারা নিয়ে আসবেন”, বললেন অভয়ারণ্যের নির্বাহী পরিচালক শাকিল।
অভয়ারণ্যের দ্রুত উদ্যোগে এরমধ্যে ফিরিয়ে আনা গেছে ২টি কুকুর, ৩টি বিড়াল, ১টি রাজহাঁস এবং ১টি মুরগি।
গত ১৩ আগস্ট এই তথ্য ফেইসবুকে ঘোষণা করে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে ‘এই শহর হোক সকল প্রাণীর’ লেখা একটি গ্রাফিতিও পোস্ট করা হয়।
কিন্তু এখন গণভবনে ফেরত আনা প্রাণীগুলোর দেখভাল করবে কারা?
অভয়ারণ্যের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কাওসার শাকিল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আহ্বান জানানোর আগে আমরা এটা আশ্বস্ত করেছি যে, গণভবনে যদি এরা ফেরত আসে তাহলে প্রথমত এদের দেখাশোনা করার লোক থাকবে; দ্বিতীয়ত, এদের খাওয়াদাওয়া-থাকা ইত্যাদির কোনও অসুবিধা হবে না।”
৫ আগস্ট গণভবন থেকে বিরল প্রজাতির পাখি ও মুরগি খোয়া যাওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন কাওসার শাকিল।
“দুটা এক্সোটিক পাখি … এ দুইটা যদি কেউ খেয়ে ফেলে আমাদের খুব কষ্ট হবে। এটা একেবারেই বিরল প্রজাতি।”
“আমাদের কাছে ‘সেক্রেটারি বার্ড’ বলে মনে হয়েছে; কিন্তু ছবি দেখে বুঝতে পারি নাই। তবে হানড্রেড পারসেন্ট শিওর এগুলো রেয়ারেস্ট পাখি।”
এই পাখি এখনও উদ্ধার করতে না পারার কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, “গণভবন থেকে যিনি নিয়েছেন তিনি এখন দিতে অস্বীকার করছেন।”
“যদিও আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, স্ক্রিনশট আছে; উনি সেখানে বলছেন যে, এটা আমার বাবার ট্যাক্সের পয়সায় কেনা, তাই আমি রাখবো।”
রাজহাঁস উদ্ধারের বেলাতেও একই বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে অভয়ারণ্য।
“উনিও (রাজহাঁস নেওয়া ব্যক্তি) বলছেন যে, চোরের বাড়ি থেকে চুরি করলে সেটা কি চুরি বলে? এই দুইজনকে আমরা কোনোভাবে কনভিন্স করতে পারছি না যে এগুলো ফেরত দেওয়া দরকার”, বললেন কাওসার শাকিল।
উদ্ধার করতে না পারা আরও প্রাণী নিয়ে অভয়ারণ্যের পক্ষ থেকে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “খরগোশ, মুরগি, গরু-ছাগল আমরা উদ্ধার করতে পারিনি।
“দুটো এক্সোটিক মুরগিও ছিল। একজন ধরে নিয়ে গেছে। আমরা অনেকবার আপিল (আবেদন) করেছি। কিন্তু কেউ কোনও সাড়া দেয়নি। কোনো হদিসও পাওয়া যায়নি।”
৫ আগস্টের ওই পরিস্থিতির মধ্যেও অভয়ারণ্যের দ্রুত উদ্যোগী হওয়ার তৎপরতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে দেশের রাজনীতি যাই হোক আমাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
“কোনও পার্টি, দল, মত- কোনও কিছুর সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা শুধু প্রাণীকল্যাণের বাইরে আর কোনও কিছু নিয়ে চিন্তাও করি না, কাজও করি না। আমাদের অবস্থান খুবই প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল।”
কেন প্রাণীগুলোকে আবারও গণভবনে ফিরিয়ে আনতে চায় অভয়ারণ্য?
কাওসার শাকিল বলেন, “গণভবনের প্রাণীগুলোকে যখন ধরে নেওয়া হলো, এটা আমরা যখন দেখলাম তখন আমাদের কাছে মনে হলো, প্রথম কথা এই প্রাণীগুলো হচ্ছে পোষা প্রাণী। এগুলো কিন্তু খাওয়ার জন্য না। যদিও ওখানে খাদ্য হিসেবে পরিচিত এরকম প্রাণীও আছে; কিন্তু ওগুলো তো পোষা।”
“আমাদের জায়গা থেকে বলার এটাই যে, এই প্রাণীগুলোকে পোষা হয়েছে; এদের ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নাই এবং গণভবন ওদের বাসা। আমাদের মনে হয়েছে এই প্রাণীগুলোকে ফেরত আনা দরকার। এটা খুব জরুরী। মানুষের কাছে আমাদের আবেদন এইটাই ছিল। কেউ নিজের মনে করে এগুলো নিয়ে যেতেও পারেন না এবং নিজের কাছে রেখে দিতেও পারেন না; তাই (নিয়ে গেলে) ফেরত দেওয়া উচিত।”
যারা গণভবন থেকে পোষা প্রাণী তুলে নিয়ে গেছেন তাদের ‘সচেতন’ করতে সকাল সন্ধ্যার মাধ্যমে অভয়ারণ্যের নির্বাহী পরিচালকের বার্তা হচ্ছে, “প্রথম কথা, এই প্রাণীগুলো আপনার না। দ্বিতীয় কথা, এগুলো খাওয়ার জন্য না।
“এই পেট এনিমেল নিয়ে যদি আপনি আপনার কাছে রেখে দেন সেটা অন্যায় হবে। ওর বাড়ি গণভবন। ও বড় হয়েছেই গণভবনে। ওর যে নিজস্ব আবাসস্থল সেখানে ফেরত দেওয়াটা আপনার দায়িত্ব। আমরা তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কারও থেকে জোর দিয়ে ফেরত আনতে পারব না। তাই আবেদনটুকু করে ছেড়ে দিচ্ছি।”
গণভবন থেকে চুরি যাওয়া প্রাণীগুলো উদ্ধারে কতদিন কাজ করবে অভয়ারণ্য? আর ফেরত আনা প্রাণীগুলোর তদারকির হালনাগাদ কতদিন রাখবে এই প্রতিষ্ঠান?
কাওসার শাকিল বলেন, “গণভবনের নিজস্ব ভেট আছেন। গণভবনের নিজস্ব কর্মী আছে যারা এই প্রাণীদের দেখাশোনা করেন।
“উনারা ফেরত এসেছেন বলে আমাদের জানানো হয়। এরপরেই আমরা (ফেইসবুকে) পোস্ট দিয়ে প্রাণীগুলোকে ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানাই।”
“আমরা দুটো জিনিস করেছি; এক হচ্ছে সবার জন্য যোগাযোগের চ্যানেল ওপেন রেখেছি। যদি কেউ আমাদের মাধ্যমে এক মাস পরেও ফেরত দিতে চায় কিংবা ছয় মাস পরেও ফেরত দিতে চায় আমরা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করব। যদি কেউ নিজেরা গিয়ে দিতে না চান তাহলে আমরা মধ্যস্থতা করে প্রাণীটাকে ফেরত দেব। কারণ ও ওর বাড়িতে যাবে এটা হচ্ছে আমাদের প্রায়োরিটি।”
“দ্বিতীয়ত, পিজিআরের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। গত পরশু দিনও পিজিআর প্রধানের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।”
এছাড়াও অভয়ারণ্যের নিজস্ব ভেট ‘দিনরাত ডাকলেই সেবা দিতে প্রস্তুত’ বলেও জানালেন তিনি।
“তবে গণভবনের ভেট খুবই ভালো। উনি শেরে-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। গণভবনে আসলে উনারা ওয়েল ইকুইপড। উনাদের রিসোর্স অনেক বেশি। আমরা তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবু আমরা ফলোআপটা রেখেছি।
“উনারা এখন পর্যন্ত আমাদের সহযোগিতা করছেন। এখন পর্যন্ত কোনো আপডেইট চাইলে তা দিয়েছেন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের চেষ্টা হচ্ছে এই ছানা, হাঁস, পাখি প্রাণীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা; যাতে এই প্রাণীগুলো ভালো থাকে।”
গণভবনে থাকা প্রাণীর তালিকায় হরিণ না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ওই সময় গণভবনে কোনো হরিণ ছিল না।”
গত ৯ আগস্ট অভয়ারণ্য থেকে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে বলা হয়, “সম্প্রতি গণভবনের প্রাণীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার যে কয়টি ভিডিও এবং ছবি ভাইরাল হয় তার মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যায় একদল লোক একটি হরিণ কাঁধে তুলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে।
“…পরবর্তীতে গণভবন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমরা নিশ্চিত হই যে, এই ভিডিওটি ৫ তারিখের ঘটনার কিংবা গণভবনের নয়।”