বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও বেড়েছে। তা এতটাই বেড়েছে যে ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে।
রবিবার দিন শেষে আইএমএফ অনসৃত বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার।
এর আগে চলতি বছর ৩০ জুন রিজার্ভ বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে হিসাব করলে রিজার্ভের বর্তমান অঙ্কই সর্বোচ্চ।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম- (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উল্লম্ফন এবং ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৬০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার ঋণ যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স বাড়ছে। চলতি ডিসেম্বর মাসের ২৮ দিনেই প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার এসেছে। রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। এই দুই সূচকের উপর ভর করে রিজার্ভ বাড়ছিল। এডিবির ৬০ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় তা ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।”
খুব শিগগিরই বিশ্ব ব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলার যোগ হলে রিজার্ভ আরও বাড়বে, বলেন তিনি।
তবে সেই স্বস্তি বেশি দিন থাকবে না। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আবার কমে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রমজান মাসকে সামনে রেখে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বেশি পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন। সে কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের আকুর আমদানি বিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের চেয়ে বেশি হবে।
আমদানি ব্যয় কমায় এবং রেমিটেন্স বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথা মতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেখানে গ্রস হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এর আগে কেবল গ্রস হিসাবের তথ্যই প্রকাশ করা হতো।
এখন বিপিএম-৬ ও গ্রস হিসাবের পাশাপাশি রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাবও করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেটি প্রকাশ করা হয় না। কেবল আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
নিট রিজার্ভ হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মোট সঞ্চিতি থেকে সব ধরনের দায়-দেনা বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রস হিসাবের রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো কম থাকে। আর বিপিএম-৬ হিসাবের চেয়ে কম থাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সে হিসাবে বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এতে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ থাকার যে শর্ত আইএমএফ দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে উল্লেখ করে।
সবশেষ গত অক্টোবর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ২১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়।
গত ২২ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেগবান করতে বিশ্ব ব্যাংক ৫০ কোটি ডলার এবং এডিবি ৬০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা অনুমোদন করেছে।
“মোট ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই বাজেট সহায়তা চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
এই ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এডিবির ৬০ কোটি ডলার ইতোমধ্যেই রিজার্ভে যোগ হয়েছে।
আকু হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছিল।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে, এই পাঁচ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় আমদানি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহামারি স্বাভাবিক হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি বেড়ে যায়।
মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। বেড়ে যায় আমদানি খরচ। কমতে থাকে রিজার্ভ।