দুই বছরের বেশি সময় ধরে চাপের মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠেছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক চার মাস পর এই অবস্থায় এল।
সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বৃদ্ধি এবং অর্থ পাচার না হওয়ায় দেশের অর্থনীতি সুফল পাচ্ছে—এ কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর শনিবার টাঙ্গাইলে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, রিজার্ভ কমবে না, বরং বাড়বে।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
৯ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর থেকে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে আসে।
গত ১১ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ আরও কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করার শর্ত হিসেবে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
এক মাস আগে ২৮ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ১ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স বাড়ছে। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। মূলত এই দুই সূচকের উপর ভর করেই রিজার্ভ বাড়ছে।”
আগামী দিনগুলোতে রিজার্ভ আরও বাড়বে এমন প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা মোটা অঙ্কের বাজেট সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই ঋণগুলো শিগগিরই আসতে শুরু করবে। ডিসেম্বরের মধ্যেই সেগুলো আসবে; তখন রিজার্ভ নিয়ে আর কোনও চিন্তা থাকবে না।”
তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, রমজান মাসকে সামনে রেখে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বেশি পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন। সে কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের আকুর আমদানি বিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের চেয়ে বেশি হবে।
এক বছর আগে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয় কমায় এবং রেমিটেন্স বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথা মতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেখানে গ্রস হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এর আগে কেবল গ্রস হিসাবের তথ্যই প্রকাশ করা হতো।
এখন বিপিএম-৬ ও গ্রস হিসাবের পাশাপাশি রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাবও করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেটি প্রকাশ করা হয় না। কেবল আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
নিট রিজার্ভ হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মোট সঞ্চিতি থেকে সব ধরনের দায়দেনা বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটা। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে গ্রস হিসাবের রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো কম থাকে। আর বিপিএম-৬ হিসাবের চেয়ে কম থাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সে হিসাবে বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর মাস শেষ হতে আরও তিন দিন বাকি (২৯, ৩০ ও ৩০ ডিসেম্বর)। এই তিন দিনে রিজার্ভ আরও বাড়বে; বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারও পাওয়া যাবে। সে হিসাবে আইএমএফের বেঁধে দেওয়া শর্তের চেয়েও নিট রিজার্ভ বেশি থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে উল্লেখ করে।
সবশেষ গত অক্টোবর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ১১০ কোটি (১.১০ বিলিয়ন) ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
গত ২২ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেগবান করতে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক ৫০ কোটি ডলার এবং ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা অনুমোদন করেছে।
মোট ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই বাজেট সহায়তা চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আকু হলো- কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
শনিবার টাঙ্গািইলে ঘাটাইল উপজেলা অডিটোরিয়ামে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ৪০০তম শাখা উদ্বোধন শেষে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত পাঁচ মাসে ৩ বিলিয়ন অতিরিক্ত রেমিটেন্স এসেছে।
“এটা কিন্তু অল্প টাকা নয়। এর কারণ অর্থ পাচার কমে গেছে। অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাচার কমেছে। ফলে অর্থটা বাইরে ডাইভার্ট না হয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে।”
দেশের অর্থনীতি এখন অর্থ পাচার কমে যাওয়ার সুফল পাচ্ছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, “এখন দুর্নীতি নেই, উচ্চ পর্যায়েও দুর্নীতি নেই এবং থাকবেও না। সরকারের প্রত্যেক ব্যক্তি সৎ এবং তারা ভালোভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে রিজার্ভ কমবে না বরং বাড়বে।
“২৬ থেকে ২৮ শতাংশ রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি দেখছি। এটা কিন্তু অল্প টাকা নয়। এর কারণ অর্থ পাচার কমে গেছে। অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাচার কমেছে। ফলে অর্থটা বাইরে ডাইভার্ট না হয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে।”