Beta
শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

ভারত থেকে চাল এল সরকারিভাবে, বেসরকারিতে সাড়া নেই

SS-rice-261224
[publishpress_authors_box]

অন্তর্বর্তী সরকার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠানকে যে এক লাখ চাল সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে, তার প্রথম চালান এসেছে। এই ২৪ হাজার ৬৯০ টন সেদ্ধ চাল সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যবহৃত হবে।

কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি উদ্যোগে যে চাল আমদানি করার কথা, সেক্ষেত্রে তেমন সাড়া নেই। দেড়শ ব্যবসায়ীকে সরকার প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার টনের।

গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ সরকারের পতনের পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কূটনৈতিকভাবে দুপক্ষের মধ্যে চেষ্টা চলছে। গত ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বললেন, শেখ হাসিনার অবস্থান দুই দেশের সম্পর্কে বাধা হওয়া উচিত নয়।

কূটনৈতিক এমন জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই ভারত থেকেই সরকারিভাবে আমদানি করা চাল আসা শুরু হয়েছে।

সরকারিভাবে ভারত থেকে চালের প্রথম চালান নিয়ে ‘এমভি টানিস ড্রিম’ জাহাজটি দেশটির কাকিনাড়া বন্দর থেকে বুধবার বিকালে বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছে। এরপর বৃহস্পতিবার ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির ঘটনা এটিই প্রথম। শুধু তাই নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় সরকারি উদ্যোগে প্রথম চাল আমদানি করা হলো।

অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক উৎস থেকে চাল আমদানির জন্য যে উন্মুক্ত দরপত্র ডেকেছে, তারমধ্যে দুটি পৃথক দরপত্রে সবচেয়ে কম দর দিয়ে ১ লাখ টন চাল সরবরাহে অনুমোদন পেয়েছে ভারতীয় দুটি প্রতিষ্ঠান। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

৫০ হাজার টন চাল সরবরাহের প্রথম দরপত্রে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে অনুমোদন পেয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এসএইএল অ্যাগ্রি কমোডিটিজ লিমিটেড। এরপর ডিসেম্বর মাসে ডাকা দ্বিতীয় দরপত্রে আরও ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল সরবরাহের কাজ পেয়েছে ভারতের আরেক প্রতিষ্ঠান বাগাদিয়া ব্রাদার্স।

বন্যা-প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে দেশে চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এর জের ধরে প্রতিনিয়তই দেশে চালের দাম বাড়ছে। সংকট সামাল দিতে সরকারি উদ্যোগে দ্রুত চাল আমদানি করতে দরপত্রের সময় ৪২ দিনের বদলে ১৪ দিন করা হয়েছে। এজন্য সংশোধন করা হয়েছে পিপিআর নীতিমালা। ১৮ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ২ লাখ টন চাল জিটুজি বা সরকারি উদ্যোগে আমদানির জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। দ্রুত চাল আমদানির উদ্যোগের পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পেরিয়ে সেই চাল দেশে এল ২৬ ডিসেম্বর।  

এদিকে দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে চালের সেই সংকট সামাল দিতে নভেম্বরেই বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি উম্মুক্ত করা হয়েছে।  অবশ্য এর আগেই চাল আমদানির শুল্কহার দুই দফা কমিয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে এখন ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এরপরও বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানিতে সাড়া মেলেনি। ফলে চালের বাজারে এর সুফল এখনও আসেনি। চালের বাজারের এই অস্থিরতার মধ্যেই সরকারি উদ্যোগে আনা চালের জাহাজ চট্টগ্রাম পৌঁছল।

এমভি টানিস ড্রিম জাহাজটি মূলত বাংলাদেশ-ভারত উপকূলীয় রুটে চলাচল করে। বাংলাদেশ-ভারত উপকূলীয় জাহাজ চলাচল নীতিমালার আওতায় সেটি মাত্র ৪দিনে ভারতের কাকিনাডা বন্দর থেকে চট্টগ্রাম এল। বাকি জাহাজগুলোও এই রুটে একই উপায়ে চাল সরবরাহ করবে বলে আশা করছে খাদ্য অধিদপ্তর কর্মকর্তারা।

খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, উম্মুক্ত দরপত্রের বাইরে মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে; যেটি দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তির (জিটুজি) ভিত্তিতে।  

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ শাখার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব লুৎফর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আন্তর্জাতিক উম্মুক্ত দরপত্রে যারা অংশ নিয়েছে, যারা আমাদের ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করেছে, তাদের মধ্য থেকেই যোগ্যদের বেছে নেওয়া হয়েছে। চারটি দরপত্রে দুই লাখ চাল সরবরাহের অনুমোদন পেয়েছে মোট চারটি প্রতিষ্ঠান। সেই নামগুলো এই মুহূর্তে আমার মনে নেই।

“এর বাইরে ১ জানুয়ারি ৫০ হাজার টন, ৯ জানুয়ারি আরও ৫০ হাজার টন চাল আমদানির দরপত্র ডাকা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি উদ্যোগে যে ছয় লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটি দিয়েছে, সেই চাল আমদানির প্রক্রিয়া এখন চলছে।”

তিনি বলেন, উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াও মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল জিটুজি ভিত্তিতে আমদানির সরকারি অনুমোদন আছে। সেই প্রক্রিয়া চলছে, আলোচনা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে। শিগগির সেই চাল দেশে আসা শুরু হবে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জরুরিভাবে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সরকারি খাদ্য মজুত বাড়িয়ে সরকারি বিতরণ-ব্যবস্থা সচল রাখার স্বার্থে ৫০ হাজার মেট্রিক টন নন-বাসমতি সিদ্ধ চাল আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলে পাঁচটি দরপত্র জমা পড়ে।

উম্মুক্ত দরপত্রে নির্বাচিত ভারতের এসএইএল অ্যাগ্রি কমোডিটিজ লিমিটেড থেকে ৫৬ টাকা ৫৯ পয়সা কেজিতে ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল আমদানি করা হচ্ছে। প্রতি টন ৪৭১ দশমিক ৬০ ডলার হিসাবে এ চাল কিনতে ব্যয় হবে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৮২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

এরপর দ্বিতীয় দরপত্রের মাধ্যমে আরও ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে ভারতের বাগাদিয়া ব্রাদার্স নির্বাচিত হয়। প্রতি টন ৪৫৬ দশমিক ৬৭ মার্কিন ডলার হিসাবে এ চাল আমদানিতে মোট ব্যয় হবে ২ কোটি ২৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৭৪ কোটি ২০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৫৪ টাকা ৮০ পয়সা।


বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানিতে সাড়া নেই

সরকারি উদ্যোগ যে চাল আমদানি হয়, তার প্রভাব সরাসরি দেশের বাজারে পড়ে না। ভোক্তারা সেই চাল সরাসরি কিনতে পারেন না। কারণ, সেই চাল খোলা বাজারে বিক্রি হয় না। সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমে সেই চাল ব্যবহৃত হয়। আবার সরকার নির্ধারিত স্থানে ওএমএসে সেই চাল বিক্রি হয়। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারে নজর থাকে বেসরকারি আমদানির দিকে।

আগস্টে দেশের ১১টি জেলার ভয়াবহ বন্যার প্রভাবে ১০ লাখ ৮৭ হাজার টন চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়। পরে অবশ্য সেই পর্যবেক্ষণ কমিয়ে ৮ লাখ টনে নামিয়ে আনা হয়। এই অবস্থায় সরকার বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানিতে নজর বাড়ায়। এরই অংশ হিসেবে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল আমদানির শুল্কহার সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রথমে সাড়ে ২৫ শতাংশ করে সরকার। তবুও বেসরকারি আমদানি বাড়েনি। পরে নভেম্বরে এসে সরকার আবারও শুল্কহার কমিয়ে একেবারে দুই শতাংশে নামিয়ে আনে। শুল্কহার একেবারে কমিয়ে আনার পর বেসরকারি আমদানিকারকরা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাল আমদানির অনুমোদন নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বেসরকারি চাল আমদানিতে সুফল মেলেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রায় দেড়শ ব্যবসায়ীকে সরকার প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার টনের।

বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির বিষয়টি দেখভাল করেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লুৎফর রহমান। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ১৪ লাখ ৮১ হাজার টন চাল আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তেমন সাড়া মেলেনি। এরপর আমরা তাদের চাল আমদানি করে সরবরাহ বাড়াতে সময় বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করেছি। দেখা যাক কী হয়।  

“শুল্ক কমানো, ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্রুত অনুমোদন, আমদানিতে সহায়তা- আমরা করে দিয়েছি। কিন্তু চাল আনবেন কি না—সেটা ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করে। সেখানে তো আমরা জোর করতে পারি না। ব্যবসায়ীরা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিলে নানা হিসাব-নিকাশ করেই আমদানির চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এখন পর্যন্ত তারা কেন নেননি সেটি ব্যবসায়ীরাই ভালো বলতে পারবেন।”

বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির অনুমোদন নিয়েছেন চট্টগ্রামভিত্তিক চাল ব্যবসায়ী ওমর আজম। চট্টগ্রামের চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদকও তিনি। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “চাল অনুমোদন নিয়ে আমদানি না করার প্রধান কারণ দুটি। একটি হচ্ছে, ডলারের বিনিময়মূল্যের উঠানামা। দ্বিতীয়টি, দামে পড়তা না হওয়া। ডলারের এত উঠানামার কারণে চাল আমদানিতে ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

“আর ভারত থেকেই চাল আমদানিতে বেশি ঝোঁক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের। কারণ, সেখানে চালের দাম তুলনামূলক কম, আর পরিবহন খরচ সাশ্রয়ী এবং সময় কম লাগে। মিয়ানমার থেকে আনার সুযোগ থাকলেও এখন সেদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেটি আমরা নিতে পারছি না।”

ওমর আজম বলেন, আমদানিতে পড়তা মিলছে না ঠিক, কিন্তু বেসরকারি চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার প্রভাব এখনও বাজারে আছে।

“ধরুন, দেশের এক কেজি স্বর্ণা ধানের সেদ্ধ চাল বাজারে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫৪ টাকা। কিন্তু ভারত থেকে আসা একই চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৩ টাকায়। এখন ভারত থেকে চাল আসার অনুমতি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই চাল কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হবে। ফলে চালের দামে বাজারে একটি ‘সার্কিট ব্রেকার’ এর মতো দাঁড়িয়েছে।

অনুমতি বন্ধ করলেই দাম বাড়ানোর কারসাজির সাথে জড়িতদের পোয়াবারো হবে; তাই বেসরকারি চাল আমদানির এই সুযোগ আরও কিছুদিন উম্মুক্ত রাখা উচিত বলে মনে করেন ওমর আজম।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত