স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি করছে বাংলাদেশ। আগামী ৩ মার্চ ২৫ হাজার টন চালের একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছবে।
সরকার থেকে সরকার (জি-টু-জি) পর্যায়ে এই চাল আমদানি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগ) জিয়াউদ্দীন আহমেদ।
তিনি মঙ্গলবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মজুত বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। তার অংশ হিসাবেই পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তার প্রথম চালান ২৫ হাজার টন ৩ মার্চ আসবে।”
পাকিস্তান থেকে আতপ চাল আমদানি হচ্ছে। এই চালের দাম ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চালের দামের চেয়ে বেশি বলে হিসাব দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান থেকে আমদানি করা চালের দাম ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চালের দামের চেয়ে প্রতি টনে ২৪ ডলার ৭৫ সেন্ট বেশি।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) পাকিস্তান থেকে আমদানি করা প্রতি টন চালের দাম বেশি পড়েছে ৩ হাজার ১৯ টাকা।
গত ১৪ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে জি টু জি ভিত্তিতে আতপ চাল আমদানির জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব পাকিস্তান ও খাদ্য অধিদপ্তরের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ট্রেডিং করপোরেশন অব পাকিস্তানের চেয়ারম্যান সৈয়দ রাফিও বশির শাহ এবং খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল খালেক এ সমঝোতা স্মারকে নই করেন।
তার আগে ১৬ জানুয়াারি সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানমুখী; চলছে অতীত ভুলে সম্পর্ক বিনির্মাণের প্রয়াস; রাজনীতির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করার পদক্ষেপও এগিয়ে যাচ্ছে।
সে সব পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই পণ্য নিয়ে দুটি জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে সরাসরি পাকিস্তান থেকে। তা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম করাচি থেকে কোনও জাহাজ সরাসরি ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতি টন ৪৯৯ ডলারে পাকিস্তান থেকে চাল (হোয়াইট রাইচ) কিনবে। ২৫ হাজার টন করে দুটি চালাতে আসবে এই চাল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাজারে চালের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। মাঝারি মানের প্রতি কেজি চাল প্রায় ৮০ টাকায় (দশমিক ৬৬ ডলার) বিক্রি হচ্ছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ৬ লাখ টন চাল আমদানির জন্য অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি অনুমোদন দেয়। সে অনুযায়ী পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার টন আতপ চাল রপ্তানির প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশকে।
প্রতি টন ৪৯৯ মার্কিন ডলার হিসাবে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চালের আমদানিমূল্য দাঁড়ায় ২ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০৪ কোটি টাকার মতো।
উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠকে ভারত থেকেও ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। তবে ভারত থেকে সেই চাল আসছে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে কাজটি পেয়েছে সে দেশের গুরুদিও এক্সপোর্টস করপোরেশন।
ভারত থেকে আসা চালের টন প্রতি দাম পড়ছে ৪৫৪ দশমিক ১৪ মার্কিন ডলার। তাতে ৫০ হাজার টন চাল আমদানিতে ব্যয় হবে ২ কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা।
আবার বাংলাদেশ ভিয়েতনাম থেকে যে চাল আমদানি করেছে, তার প্রতি টনের দাম পড়ে ৪৭৪ ডলার ২৫ সেন্ট।
দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার অবসানে নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই নেয় বাংলাদেশ।
তারপর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই গড়িয়েছে। গত দেড় দশকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের শাসনকালে সেই সম্পর্ক নাজুক হয়ে পড়েছিল।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের পর, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নতির পথে আছে। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কও শুরু হয়েছে। এই চাল আমদানির মাধ্যমে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর দুই দেশের সরকারের মধ্যে সরাসরি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পুনরায় শুরু হতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি দ্য ডিপ্লোমেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণে বাংলাদেশকে ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিজেদের কাছে আনতে পারলে ষোল আনাই লাভ পাকিস্তানের।
তার পরিবর্তে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখানো হয়নি বিশ্লেষণী ওই প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, অর্থনীতি নিয়ে খাবি খাওয়া পাকিস্তানের বাংলাদেশকে কিছু দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। ভারত বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশকে, তা দিতে পারবে না পাকিস্তান।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়, যা বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বাণিজ্যিক লেনদেনের বহু গুণ। ফলে সেই দিক থেকেও বাংলাদেশের কাছে ভারতের বিকল্প হতে পারবে না পাকিস্তান।
পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে তা আরও স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশের মোট আমদানি ও রপ্তানির তুলনায় পাকিস্তানের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি ১ শতাংশেরও কম।
গত অর্থ বছরে বাংলাদেশ মোট ৬ হাজার ৬৭২ কোটি ৫১ লাখ (৬৬.৭২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করে, তার মধ্যে পাকিস্তান থেকে আমদানি হয় ৬২ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পণ্য।
অন্যদিকে ওই অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয় ৪ হাজার ৪৪৬ কোটি ৯৭ লাখ (৪৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলার। তার মধ্যে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছিল ৬ কোটি ১৯ লাখ ডলারের পণ্য।
স্বল্প আমদানি-রপ্তানির মধ্যেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পাল্লা পাকিস্তানের দিকেই ভারী। অর্থাৎ যতটা আমদানি বাংলাদেশ করে, রপ্তানি তার চেয়ে অনেও কম হয়।
ফলে সেদিক থেকেও বাংলাদেশের লাভের সম্ভাবনা কম। আবার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজ হলেও যে আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাবে, তেমন কোনও আশাও দেখছেন না অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
শুধু বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সহজ হবে বলে মনে করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
আমদানি-রপ্তানির চিত্র
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পাকিস্তানের দিকে পাল্লা হেলে রয়েছে। বাণিজ্যের পরিমাণ বেশি হলেও ভারতের ক্ষেত্রেও চিত্র একই।
বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। অর্থাৎ চীনের পরই ভারতের অবস্থান। চীন থেকে আসে ২৫ শতাংশ পণ্য।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ভারত থেকে আমদানি হয় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বিপরীতে
১৫৬ কোটি ৯২ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল দেশটিতে। কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যেও চলতি অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভারতে ৮০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পাকিস্তানে ৬ কোটি ১৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। এর বিপরীতে সে দেশ থেকে ৬২ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশ মোট ৬ হাজার ৬৭২ কোটি ৫১ লাখ (৬৬.৭২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। অনদিকে রপ্তানি থেকে আয় করে ৪ হাজার ৪৪৬ কোটি ৯৭ লাখ (৪৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলার। এটা স্পষ্ট করে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের খুবই নগন্য পরিমাণ চলে পাকিস্তানের সঙ্গে।
করাচি থেকে বাংলাদেশে সরাসরি যে দুটি জাহাজ এসেছে, তাতে এসেছে ফেব্রিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট ও ডলোমাইট। এর বেশিরভাগই বস্ত্র শিল্পের কাঁচামাল।
পাকিস্তান থেকে গত বছর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে তুলা। এছাড়া আরও যেসব পণ্য আসে বাংলাদেশে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আসে সিমেন্টের কাঁচামাল।
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া ছিল প্রায় ৭৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়, এমন পণ্যের যে তালিকা পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়েছে, তার পেপার ও পেপারবোর্ড লেবেল, ছেলেদের শার্ট, মেডিক্যাল সার্জিক্যাল ও ডেন্টাল ইকুইপমেন্টও রয়েছে।
বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যে ৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে ছিল কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক।
এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে পাকিস্তানে; বিপরীতে দেশটি থেকে আমদানি হয় ৮৪ কোটি ডলারের পণ্য।