গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ২০১৫ সালের প্রকাশনা অনুযায়ী, ঢাকা শহরে চলাচলের ক্ষেত্রে রিকশার ওপর নির্ভরশীল ৪০ শতাংশ মানুষ। আর ২০২২ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত জনশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৮ জন। সে হিসেবে প্রতিদিন চলাচলের বাহন হিসেবে রিকশা ব্যবহার করেন ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ।
এই বিপুল সংখ্যক রিকশার চালকদের কেউ গ্রামের ভিটেমাটি হারিয়েছেন, কেউবা শিক্ষাজীবন শেষে চাকরি নামের সোনার হরিণটি ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার অনেকেই আছেন রিকশা চালিয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন, কেউ কেউ চাকরির সামান্য বেতনে জীবন চালাতে ব্যর্থ হয়ে রিকশার হ্যান্ডেল ধরতে বাধ্য হয়েছেন।
স্বাধীনতার আগে শিশু বয়সেই রিকশার গ্যারেজে কাজ শুরু করেছিলেন সিরাজ। সেই সময় সারা মাসে তিনি বেতন পেতেন মাত্র সাড়ে ৭ টাকা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তার বেতন হয় মাসে ৫০ টাকা। কিন্তু সেই টাকায় পরিবার নিয়ে চলা সম্ভব হতো না বলে মিস্ত্রির কাজ বাদ দিয়ে কয়েক বছর রিকশাও চালিয়েছেন। এখন বৃদ্ধ বয়সে আবারও রিকশার মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছেন তিনি। শুরুতে সারা মাসে সাড়ে ৭টাকা বেতন পেলেও এখন প্রতিদিনের হাজিরাই পান ৮০০ টাকা।
রাজশাহীর কাজীরগঞ্জের বাসিন্দা সিরাজ বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লায়। ওই এলাকারই একটি রিকাশার গ্যারেজে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন সিরাজ। পুরো মোহাম্মদপুরেই সিরাজ মিস্ত্রিকে একনামে চেনেন রিকশার মালিক ও চালকরা।
৭০ বছর বয়সী সিরাজ মিস্ত্রি বলেন, “জীবনের ৬০ বছরেরও বেশি সময় রিকশার সঙ্গে কাটিয়েছি। অনেক অনেক চালকের সঙ্গে পরিচয়, চেনাজানা হয়েছে। তাদের কেউ ছাত্র, কেউবা গ্রামের ভিটেমাটি হারানো মানুষ। অনেক শিক্ষিত লোককেও দেখেছি রিকাশা চালাতে। কেউ কেউ আবার সারাদিন চাকরি করে রাতের কিছু সময় রিকশা চালায়। কিন্তু কাউকেই কখনও দেখিনি শখ করে রিকশা চালাতে। যখন কেউ উপার্জনের আর কোনও উপায় খুঁজে পায় না, তখন আসে রিকশা চালাতে। অর্থাৎ মানুষ যখন নিরুপায়, তখনই শুধু রিকশা চালায়।”
সিরাজ মিস্ত্রি যে গ্যারেজে কাজ করেন সেটির মালিক বাবু বিশ্বাস (৩৫)। গ্যারেজটির বয়স ৪০ বছরেরও বেশি। বাবার মৃত্যুর পর গত ১২ বছর ধরে গ্যারেজটি পরিচালনা করছেন তিনি।
বাবু বলেন, “আমার এখানে একজন রিকশাচালক আছেন, যিনি সরকারি চাকরি করতেন। বেতনের টাকায় সংসার চালাতে পারতেন না দেখে চাকরি করার সময়ও তিনি প্রতিদিন অফিস শেষে কয়েক ঘণ্টা রিকশা চালাতেন। এখন অবসর নেওয়ার পরও রিকশা চালাচ্ছেন।
“আরেকজন চালক আছে যিনি রিকশা চালিয়েই ২ ছেলে ও ২ মেয়েকে পড়াশুনা করিয়েছেন। এখন তার বড় ছেলে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেই ছেলে বাবাকে আর রিকশা চালাতে দিতে চায় না। আবার অনেক ছাত্র আছে যারা রিকশা চালিয়েই পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন। তবে রিকশাচালকদের বেশিরভাগই গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ। যারা বছরের নির্দিষ্ট সময় কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, আর বাকি সময় ঢাকায় এসে রিকশা চালান।”
মনসুরাবাদের ১৭ নং সড়কের একটি গ্যারেজের মালিক আল মামুন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রিকশার গ্যারেজ পরিচালনা করেন তিনি। তার গ্যারেজে আছে শতাধিক রিকশা।
মামুন বলেন, “দিন-রাত মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০০ চালক রিকশা নেয় আমার গ্যারেজ থেকে। যারা অসহায়, কিংবা হঠাৎ করে চাকরি হারিয়ে বেকার, সেই সঙ্গে অনেক শিক্ষত মানুষও আমার এখানে রিকশা চালাতে আসেন। আমি এমনও চালক পেয়েছি যিনি এমএ পাস। কিন্তু পড়াশুনা শেষে চাকরি না পেয়ে নিরুপায় হয়ে রিকশা চালাতে এসেছেন।
“আমি সবসময়েই চেষ্টা করি এই ধরনের মানুষদের সহায়তা করতে। তাই বিশ্বাস করে তাদের হাতে রিকশা তুলে দেয়। অনেকে আবার সেই বিশ্বাস ভঙ্গও করে। চালক সেজে তারা রিকশা চুরি করে পালিয়ে যায়। এভাবে আমি ৭-৮টি রিকশা হারিয়েছি।”
রিকশা চালিয়েই নিজের পড়াশোনার খরচ চালান লোকমান হোসেন। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় রিকশা চালাতে আসা লোকমান নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় জানাতে চাননি।
তিনি বলেন, “২০২১ সালে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করি। সেই থেকে রিকশা চালিয়েই নিজের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছি। তার পাশাপাশি এখন হাতে কিছু টাকাও জমিয়েছি। মাঝেমধ্যে রিকশা চালাতে খুবই কষ্ট হয়। শরীরের সেই কষ্ট গায়ে মাখি না। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু যাত্রী পাই যারা খুবই খারাপ আচরণ করে। রিকশাচালকদের মানুষই মনে করে না। তখন মনটা খুব খারাপ হয়। এমনও যাত্রী আছে যারা গায়েও হাত তোলে।”
৭২ বছর বয়সী কুদ্দুস মিয়ার বাড়ি নেত্রকোনায়। ১৮ বছর বয়স থেকেই রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। রিকশা চালিয়েই বড় করেছেন ৪ ছেলেকে। কিন্তু সেই ছেলেরা এখন আর খোঁজ না নেওয়ায় বাধ্য হয়েই এই বৃদ্ধ বয়সেও রিকশা চালাতে হচ্ছে তাকে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শ্যামলীতে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে থাকার সময় কথা হয় তার সঙ্গে। আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “একবার এক যাত্রী রিকশায় ব্যাগ ফেলে যায়। সেই ব্যাগে ছিল স্বর্ণের গহনা, দামি ঘড়ি আর চশমা। আমি ৩ দিন ঘুরে ঘুরে ওই যাত্রীর ব্যাগ ফেরত দিয়েছিলাম। ব্যাগটি ফেরত পেয়ে ওই যাত্রী বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই ঘটনা আজও মনে পড়ে।”
প্রায় ২৫ বছর ধরে রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে জীবন চালাচ্ছেন ভোলার আব্দুল আলী। বর্তমানে মেহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৮নং সড়কের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন তিনি।
আব্দুল আলী বলেন, “বাবার কোনও জমিজমা ছিল না, পড়াশুনাও করিনি। তাই কোনও কিছু করার উপায় না পেয়ে রিকশা চালানো শুরু করেছিলাম। এখনও বন্ধ করতে পারিনি। রিকশা চালিয়ে ৪ মেয়ে ও ২ ছেলেকে বড় করেছি। তিন মেয়ের বিয়েও দিয়েছি।”
রংপুরের মিঠাপুকুরে বাড়ি আবদুল মজিদের। তিনিও ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে রিকশা চালাচ্ছেন। রিকশা চালাতে গিয়ে ১৫ বছর আগে একবার ট্রাফিক পুলিশের হাতে মারধরের শিকার হয়েছিলেন। সেই ঘটনা এখনও ভুলতে পারেননি তিনি।
মজিদ বলেন, “পান্থপথ সিগন্যাল পার হওয়ার সময় এক ট্রাফিক দৌড়ে এসে আমার রিকশা আটকায়। সে নাকি আমাকে থামার সংকেত দিছিল, কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। এরপর ওই ট্রাফিক পুলিশ আমাকে চড়-ঘুষি মেরেছিল।”
ঢাকায় প্রায় ২২ ধরে রিকশা চালান ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন শেখ। বাড়িতে কোনো জমিজমা না থাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় বাধ্য হয়েই রিকশা চালাতে ঢাকা আসেন নাসির। ঢাকার মনসুরাবাদের রিকশার গ্যারেজের ভেতরে একটি মাচায় থাকেন তিনি। সেখানে তার মতো আরও ২০-২৫ জন রিকশাচালকের জায়গা হয়েছে।
নাসির বলেন, প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা রিকশা চালালে ১০০০-১২০০ টাকা আয় হয়। সেই টাকা থেকে মেসে দুপুরে ও রাতে খাওয়ার জন্য খরচ করতে হয় ১২০ টাকা। এছাড়াও সকালের নাস্তাসহ সারাদিনে আরও ২০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। রিকশা চালানোর অবসরে যতটুকু সময় পান, গ্যারেজের চায়ের দোকানে টিভি দেখেন।
এই রিকশাচালকদের অনেকে অবসরে মোবাইল গেমে সময় কাটান, কেউ কেউ খেলেন তাস।