Beta
রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

মিয়ানমার ফিরতে লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ

বুধবার কুতুপালং ১ নম্বর ইস্ট ক্যাম্পের মাঠে গণসমাবেশ করে  রোহিঙ্গা যুবকদের সংগঠন ‘ইসলামি মাহাসা’।
বুধবার কুতুপালং ১ নম্বর ইস্ট ক্যাম্পের মাঠে গণসমাবেশ করে রোহিঙ্গা যুবকদের সংগঠন ‘ইসলামি মাহাসা’।
[publishpress_authors_box]

নিজ দেশ মিয়ানমার ফিরে যেতে কক্সবাজারে উখিয়ায় গণসমাবেশ করেছে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গা।  

বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) উখিয়া কুতুপালং ১ নম্বর ইস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঠে রোহিঙ্গা যুবকদের সংগঠন ‘ইসলামি মাহাসা’ নামের একটি সংগঠন এ সমাবেশ আয়োজন করে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া সমাবেশ শেষ হয় দুপুর ১টায়।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গার অধিকাংশই রয়েছে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে। নতুন করে অনুপ্রবেশের কারণে সেখানে তাদের সংখ্যা বাড়ছে।

সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমারে নির্মম নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তাদের শরণার্থী জীবনকে খাঁচাবন্দি পাখির জীবনের সঙ্গে তুলনা করেন।

তারা বলছেন, শরণার্থী জীবন খুবই কষ্টের। এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে, নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোনও বিকল্প নেই।

ধারণা করা হচ্ছে, বিভিন্ন বয়সী প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা সমবেত হয়েছিল এ গণসমাবেশে। সেখানে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার, মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরাল ভূমিকা দাবি করে বিভিন্ন স্লোগান দেয়।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা গত কয়েক দশক ধরেই নিপীড়নের মুখে রয়েছে। আর তাতে অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

মিয়ানমারের সেনাদের হাতে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গার দলে দলে বাংলাদেশে আসতে থাকেন আশ্রয়ের জন্য। সেসময় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ প্রথমে রাজি না হলেও পরে মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। ওই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরেও পাঠানো হয়।

সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশ মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে ফিরে যেতে প্রস্তুত। জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ হবে। রোহিঙ্গাদের দাবিসমূহ মিয়ানমার সরকার মেনে নিলে আমরা ফিরে যাব।”

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সম্প্রতি রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে আরাকান আর্মির শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ফিরতে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যা করে যাচ্ছে। এর আগে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সঠিক ও ন্যায় বিচার হয়নি। রোহিঙ্গা নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা দ্রুত করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।

ডা. জোবায়ের আরও বলেন, “রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো নিশ্চিত করা হলে আমরা স্বেচ্ছায় মিয়ানমার চলে যাব। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সারা জীবন থাকার জন্য আসেনি। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিয়েছে, থাকার জন্য জমি দিয়েছে, ঘর দিয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা করেছে। নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। আমরা (রোহিঙ্গারা) বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের কাছে সারা জীবন ঋণী হয়ে থাকবো।”

সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা মাওলানা রাহমত করিম বলেন, “ক্যাম্পের এমন জরাজর্ণী বন্দি জীবন মানুষের জন্য না। এখানে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তার জন্য রোহিঙ্গারা কৃতজ্ঞ। এখন বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ন্যায়সঙ্গত ফেরতে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”

সমাবেশে মাওলানা জহির আহমেদ, কাওয়ালি হামিদ, মাওলানা আব্দুর রশিদ, মাওলানা দিল মোহাম্মদসহ অনেক রোহিঙ্গা আলেম এবং যুবক বক্তব্য রাখেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সিরাজ আমিন জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের গণসমাবেশ হয়েছে। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে এ সমাবেশ করেছে।

কক্সবাজারের শরাণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বন্ধসহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে এই সমাবেশ আয়োজন করা হয়।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তৎপর কোস্ট গার্ড : মহাপরিচালক

মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক সংঘাত ও সহিংসতার জেরে আরও ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে আরও অনেক রোহিঙ্গা।

এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা ঠেকাতে কোস্ট গার্ড সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীর মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল জিয়াউল হক।

বুধবার টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনে মিয়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন এবং শাহপরীর দ্বীপের শীতার্ত ও অসহায় মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণকালে তিনি একথা জানান।

কোস্ট গার্ড মহাপরিচালক বলেন, “কক্সবাজারের টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় এবং সে দেশের পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। নদী পথে এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কোস্ট গার্ড তৎপর রয়েছে। নদী পথে আমাদের টহল জোরদার রয়েছে।

“ফলে নদী পথে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশে ব্যর্থ হচ্ছে। তাছাড়া সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের আমরা প্রতিহত করছি। মূলত কিছু দালালের মাধ্যমে অন্য পথে ঢোকার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা।”

এসময় স্থানীয় জনগণকে এ বিষয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক বলেন, “নিরাপত্তার জন্য দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে কোস্ট গার্ড। মিয়ানমারের ঘটনা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। মিয়ানমারের জান্তা ও আরাকান আর্মির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলতেছে। যুদ্ধ এমন একটা পর্যায়ে এসেছে, আরকান আর্মির সঙ্গে জান্তা বাহিনীর পরাজয় হচ্ছে।

“দুই পক্ষের গোলাগুলির কারণে সীমান্তের মানুষেরা একটু ভয় থাকে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কোস্ট গার্ড সদস্যরা সীমান্তের বাসিন্দাদের পাশে রয়েছেন।”

জিয়াউল হক বলেন, বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তা এবং জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে কোস্ট গার্ড সদস্যরা। এসব কাজ করার জন্য কোস্ট গার্ডের জনবল বাড়ানো দরকার।

দীর্ঘদিন ধরে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের সরকার ২০১৭ সালের পর আর কোনও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টাও চালানো হচ্ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে প্রক্রিয়া থেমে যায়।

গত বছরের নভেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিও যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করে সেনা সরকারের সঙ্গে লড়াই শুরু করে। এতে রাখাইনের রোহিঙ্গারা ফের বিপাকে পড়ে। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেরকে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করে। ফলে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ছাড়া মিয়ানমারে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। 

গত ২০ ডিসেম্বর ব্যাংককে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিস সাঙ্গিয়ামপোংসার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এই অভিমত জানান। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বিস্তৃত রোডম্যাপের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য পরিস্থিতি ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়া রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত