Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫

শ্রদ্ধা-স্মৃতির পথ পেরিয়ে বাবা-মায়ের কবরে সমাহিত রনো

নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা আর রাজনৈতিক সহকর্মীদের স্মৃতির পথ পাড়ি দিয়ে সোমবার সমাহিত হয়েছেন হায়দার আকবর খান রনো। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা আর রাজনৈতিক সহকর্মীদের স্মৃতির পথ পাড়ি দিয়ে সোমবার সমাহিত হয়েছেন হায়দার আকবর খান রনো। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরে সমাহিত হয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো।

সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই তাকে কবর দেওয়া হয়। কবরের পাশে ভিড় করেছিলেন রনোর রাজনৈতিক সহকর্মী থেকে শুরু করে শুভানুধ্যায়ীরা।

গত শনিবার রাতে ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে মারা যান বামপন্থী এই রাজনীতিবিদ। তার মরদেহ রাখা হয় শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে।

বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরেই শায়িত হয়েছেন রনো। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরেই শায়িত হয়েছেন রনো। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সেখান থেকে সকালে মরদেহ নেওয়া হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। সিপিবির সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বিভিন্ন গণসংগঠন ও দলের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা হায়দার আকবর খান রনোর প্রতি জানান।

এ সময় সিপিবির সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, “ষাটের দশকের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা একে একে চলে যাচ্ছেন। ষাট দশকের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যূত্থান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে হায়দার আকবর খান রনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। রনো যে মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করতেন, মুক্ত মানুষের মুক্ত বিশ্ব গড়ার সেই লড়াই আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব।” 

পল্টনে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রনোর মরদেহ নিয়ে বের হয় একটি শোক র‌্যালি। যেটি গিয়ে মেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

সেখানে দুপুরে হায়দার আকবর খান রনোকে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গার্ড অব অনার।

রাষ্ট্রও সম্মান জানিয়েছে কমরেড হায়দার আকবর খান রনোকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
রাষ্ট্রও সম্মান জানিয়েছে কমরেড হায়দার আকবর খান রনোকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংস্কৃতি ফ্রন্ট, গণজাগরণ মঞ্চ, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা প্রবীণ এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

কেবল সংগঠনের ব্যানারেই নয়, অনেকেই এসেছিলেন পছন্দের রাজনীতিবিদ বা প্রিয় মানুষকে শেষবারের মতো দেখতে। 

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “তিনি জাতির একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। যিনি আজীবন দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের মানুষ তাকে স্মরণ করবে আজীবন।” 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “হায়দার আকবর খান রনোর চলে যাওয়া বাংলাদেশের আদর্শবাদী রাজনীতিতে বিশাল শূন্যতা তৈরি করল। তিনি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তা দেখে যেতে পারেননি।”

হায়দার আকবর খান রনো প্রত্যেকটি সংকটময় সময়ে জনগণের পক্ষে লড়াই করেছেন বলে উল্লেখ করেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, “প্রয়োজনে কৌশলী হয়েছেন কিন্তু আদর্শকে তিনি কোনোদিন ছেড়ে দেননি।”

স্মৃতিচারণ করেন ও শ্রদ্ধায় প্রবীন এই রাজনীতিককে স্মরণ করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।

মুক্ত মানুষের মুক্ত বিশ্ব গড়ার যে স্বপ্ন হায়দার আকবর খান দেখেছিলেন, তা এগিয়ে নেওয়ার শপথই হয়ত নিলেন তার সহযোদ্ধারা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
মুক্ত মানুষের মুক্ত বিশ্ব গড়ার যে স্বপ্ন হায়দার আকবর খান দেখেছিলেন, তা এগিয়ে নেওয়ার শপথই হয়ত নিলেন তার সহযোদ্ধারা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে হায়দার আকবর খানের মেয়ে রানা সুলতানা বলেন, “কমরেডদের মৃত্যু নেই। আমার বাবা আজীবন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন নিয়েই তিনি এতদিন বেঁচে ছিলেন। মানুষের জৈবিক মৃত্যু হয়, কিন্তু তিনি তার চিন্তা, লেখা, আদর্শের মধ্য দিয়ে আজীবন বেচে থাকবেন।”

এ সময় সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রনোর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে নেওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানেই বাবা-মায়ের কবরে শায়িত হন তিনি।

১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন হায়দার আকবর খান রনো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬০ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচত হন। ছাত্রজীবন শেষে যুক্ত হয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনে।

১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি গঠন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। 

স্বাধীনতার পর রনো ও তার সহকর্মীরা মিলে ১৯৭৩ সালে গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। পরে ১৯৭৯ সালে দলের নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। প্রথম থেকেই তিনি এই দলের পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন।

শেষবারের মতো হায়দার আকবর খানকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
শেষবারের মতো হায়দার আকবর খানকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও জোরালো ভূমিকা ছিল তার।

২০০৯ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে পুরনো দল সিপিবিতে যোগ দেন হায়দার আকবর খান। ২০১২ সালে তাকে দলটির সভাপতিমণ্ডরীর সদস্য হন। সর্বশেষ ছিলেন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে।

রাজনীতির পাশাপাশি ৩০টির বেশি বই লিখেছেন তিনি। ২৪ বছর বয়সে তার লেখা ‘সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা’ বইটি ছিল পাকিস্তান আমলে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক প্রথম তাত্ত্বিক গ্রন্থ।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- শতাব্দী পেরিয়ে, ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা, কোয়ান্টাম জগৎ-কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন রাজনীতিবিদ ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত