বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের জেরে পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি কোন দেশে আশ্রয় নেবেন, এনিয়ে চলছে জোর জল্পনা কল্পনা। এক্ষেত্রে বারবার যুক্তরাজ্যের নাম আসছে।
এমন আলোচনার মধ্যেই মুখ খুললেন যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি রুপা হক। বাংলাদেশি-ব্রিটিশ এই রাজনীতিক মনে করেন, শেখ হাসিনাকে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
সম্প্রতি এনিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্যান্ডার্ডে একটি নিবন্ধ লিখেছেন রুপা হক। লেখার শুরুতেই তিনি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় ব্যান্ডদল বিটলসের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটির প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশ কতটা ‘বিশৃঙ্খল’ ছিল তা নিয়ে গান গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। গত সপ্তাহে তিনি ফের সঠিক প্রমাণিত হলেন। সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতাচ্যুতির মতো ঘটনার প্রতিফলন দেখা গেল। ‘জাতির পিতার’ ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পোড়ানো হয় কুশপুত্তলিকা। আর এর আঁচ ঢাকা থেকে টাওয়ার হ্যামলেট (যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি পৌরসভা) পর্যন্ত লেগেছে।”
যুক্তরাজ্যে বিক্ষোভের আঁচ লাগা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “পূর্ব লন্ডনের রাস্তায় বাংলাদেশিদের বিক্ষোভ দেখে অনেকে তা ‘বর্ণবাদী দাঙ্গা’ হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু আসলে এটি ছিল কোনও জাতিগত সংঘর্ষ নয়, বরং উৎসবমুখর একটি সমাবেশ।
“তারা নিরঙ্কুশ নির্বাচন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অবসানকে উদযাপন করছিল। ফোন সিগনাল ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের যোগাযোগের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হতো, যা তাদের স্বাধীনতার উপর একটি গুরুতর হুমকি ছিল।
“বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা অনেক। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। তাদের মধ্যে বেক-অফ অনুষ্ঠানের প্রতিযোগী নাদিয়া হুসেন ও আমার বোন কনি হক অন্যতম। সম্প্রতি বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জবাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ‘দেখামাত্র গুলি’ করার নীতি অনুসরণ করে অসংখ্য নিরস্ত্র, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনা প্যারিস, রোম, ম্যানচেস্টার ও ট্রাফালগার স্কয়ারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিক্ষুব্ধ করেছে।”
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনকে তিয়ানআনমেন স্কয়ারের সঙ্গে তুলনা করে রুপা হক লিখেছেন, “জাতির পিতার ‘স্বৈরাচারী’ মেয়ে শেখ হাসিনা দেশটির আয়ুষ্কালের বড় অংশই শাসন করেছেন (সর্বত্র তার বাবার ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম স্থাপন নিশ্চিত করে)।”
ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রসঙ্গে রুপা হক লিখেছেন, “দেশ যখন পুড়ছিল, তিনি তখন হেলিকপ্টারে করে ভারতে নির্বাসনে যান। একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সংসদ সদস্য হিসেবে, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশিদের সমস্যা নিয়ে আমার ইনবক্স সবসময় ব্যস্ত থাকে। বর্তমানে আমাকে ‘কসাইকে নিষিদ্ধ করুন’ এবং এর মতো অনেক ইমেইল করা হচ্ছে। কারণ শোনা যাচ্ছে লন্ডন তার পরবর্তী গন্তব্য।
“আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তার রক্তপিপাসু শাসনের অজনপ্রিয়তা এবং অভিবাসন নিয়ে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে এমন একজন হাই প্রোফাইল আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দেওয়া যুক্তরাজ্যের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি রয়েছে। অনেক বাংলাদেশি মনে করেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।”
নিবন্ধের একেবারে শেষের অনুচ্ছেদে তিনি লেখেন, “বাংলাদেশি আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এক প্রকার প্রশান্তি বিরাজ করছে। সরকারের সমালোচনা করলে প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে সৃষ্ট ভীতির পরিবেশ কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। তবে বিপদের আশঙ্কা এখনও বিদ্যমান।
“আশা করা যায়, গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হবে। আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রচলিত দুইটি পরিবারের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা পরিহার করে নতুন পথে অগ্রসর হওয়ার সময় এসেছে।”
এদিকে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির আরেক নেত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। টিউলিপ সম্পর্কে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নতুন সরকারের সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কিছুদিন আগে লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট থেকে ভাড়ার আয় নথিভুক্ত না করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের তদন্তের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে অন্যের মালিকানায় থাকা একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাসের অভিযোগও ওঠে।
২১ লাখ পাউন্ড দামের বাড়িটির মালিক আব্দুল করিম নামে বাংলাদেশি এক ধনকুবের। শেখ হাসিনা ওই ব্যবসায়িকে সিআইপি ঘোষণা করে ভিআইপির মর্যাদা দিয়েছিলেন।
ডেইলি মেইল অনলাইন টিউলিপ সিদ্দিকের কাছে জানতে চেয়েছিল, আব্দুল করিমের বাড়িতে থাকার জন্য তিনি কত টাকা ভাড়া দেন। কিন্তু বারবার প্রশ্ন করা সত্ত্বেও টিউলিপ বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের একজন প্রাক্তন ওয়াচডগ বলেছেন, তিনি যদি বাজার দরের চেয়ে কম ভাড়া দিয়ে থাকেন তবে তার সেটা ঘোষণা করা উচিৎ। টিউলিপ নিজের মালিকানাধীন ফ্ল্যাট থেকেও হাজার হাজার পাউন্ড আয় করছেন।
টিউলিপ সিদ্দিককে তার বাড়িতে বসবাসের অনুমতি দিয়ে আব্দুল করিম কোনওভাবে লাভবান হয়েছেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এসব অভিযোগের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরেক অভিযোগ। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সম্প্রতি সেনানিবাসের গোপন বন্দিশালা ‘আয়না ঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন অনেকে। এদের মধ্যে একজন হলেন ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান। তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ গত ১৭ আগস্ট আরমানের পরিবারের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়, আরমানকে ‘বন্দিশালা’ থেকে মুক্ত করতে টিউলিপ সিদ্দিকের কাছে সহায়তা চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু তারা সহায়তা পাননি।
আরমানের আইনজীবীরা বলছেন, টিউলিপ সিদ্দিক তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবহার করে চাইলে আরমানকে মুক্ত করতে পারতেন। তিনি তা করেননি।
২০১৫ সালে টিউলিপ হ্যাম্পস্টেডের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, “আমার খালা আমাকে সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন। তার কাছ থেকে রাজনীতি সম্পর্কে সবকিছু শিখেছি। সামাজিক ন্যায়বিচার, কীভাবে প্রচার চালাতে হয় এবং কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হয়, এসব শিখেছি।”
টেলিগ্রাফে আরমানের এক আইনজীবীর বক্তব্য উদ্ধৃতি আকারে দেওয়া হয়। এতে ওই আইনজীবী বলেন, “আমি ও আরমানের পরিবার মিলে আরমানকে মুক্তি দিতে টিউলিপ সিদ্দিককে তার খালার কাছে তদবিরের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কোনও সহায়তা করেননি।”
আরমানের পরিবারের এই অভিযোগের বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।