রাশিয়া যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপজুড়ে সড়কে দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে বলে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই ফাইভের প্রধান কেন ম্যাককালাম।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের সামনে থাকা নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে বার্ষিক হালনাগাদ বার্তায় এমআই ফাইভ প্রধান এই সতর্ক বাণী দেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
তিনি বলেন, দুই বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিরোধিতা করায় রুশ গোয়েন্দা সংস্থা যুক্তরাজ্যজুড়ে “বেপরোয়াভাবে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা এবং আরও বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল”।
ম্যাককালাম বলেন, ২০২২ সাল থেকে এমআই ফাইভ ইরানের ২০টি চক্রান্তও ভেস্তে দেয়।
তিনি জানান, এমআই ফাইভের বেশিরভাগ কাজ এখনও ইসলামবাদী চরমপন্থা এবং চরম ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়।
কেন ম্যাককালাম সতর্ক করেন, একই সঙ্গে সন্ত্রাস-সম্পর্কিত হুমকি এবং কোনও জাতি রাষ্ট্র থেকে হুমকির জটিল মিশ্রণের অর্থ হল এমআই ফাইভকে ভয়ানক নারকীয় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং হবে।
বিস্তৃত ভাষণে তিনি বলেন:
- তরুণরা ক্রমবর্ধমানভাবে অনলাইন চরমপন্থায় আকৃষ্ট হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৩ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম।
- ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিস্ফোরক দিয়ে ‘গণ হত্যা’ করার ৪৩টি চক্রান্ত শেষ পর্যায়ে ভেস্তে দেওয়া হয়েছে।
- রাষ্ট্রীয় হুমকির বিষয়ে এমআই ফাইভের তদন্তের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
- সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানগুলোর মধ্যে ৭৫ শতাংশ ছিল ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে। বাকি ২৫ শতাংশ ছিল যুক্তরাজ্যের চরম ডানপন্থীদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।
লন্ডনে এমআই ফাইভের কাউন্টার-টেররিজম অপারেশন সেন্টারে ব্রিফিংয়ে ম্যাককালাম বলেন, এমআই ফাইভকে মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো ব্যাপক সংখ্যক ও বিচিত্র ধরনের চরম বিশ্বাস ও মতাদর্শের মোকাবেলা করতে হয়েছিল।
“এখানে আমার ক্যারিয়ারের প্রথম ২০ বছর সন্ত্রাসী হুমকিতে পরিপূর্ণ ছিল। সেসবের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে একটি বড় ইউরোপীয় স্থলযুদ্ধের পটভূমিতে রাষ্ট্র-সমর্থিত হত্যাকাণ্ড এবং নাশকতার ষড়যন্ত্র।”
তিনি সতর্ক করেন, “ইউক্রেনকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার কারণে আমরা এখন পুতিন সরকারের চক্ষুশুল হয়ে উঠেছি। ফলে যুক্তরাজ্যের মাটিতে আরও আগ্রাসন চালোনো হতে পারে।”
তার দাবি, যুক্তরাজ্যের প্রতি বর্তমান সন্ত্রাসের হুমকির মাত্রা যথেষ্ট বাস্তব, যার অর্থ আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।
ম্যাককালাম বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে যে ৭৫০ জনেরও বেশি রুশ কূটনীতিককে ইউরোপ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল গুপ্তচর’।
“এর ফলে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার সক্ষমতা অনেক কমেছে। ব্রিটেন ও তার মিত্ররা যাদের রাশিয়ান গুপ্তচর বলে মনে হত, তাদের কূটনৈতিক ভিসা দিতেও প্রত্যাখ্যান করেছে।”
তিনি বলেন, “রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো ‘তাদের নোংরা কাজ’ করার জন্য প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা এবং অপরাধীদের মতো বিকল্পের দিকে ঝুঁকেছিল। তবে এতে তাদের অপারেশনের পেশাদারিত্ব নষ্ট হয়েছে। ফলে সেগুলো সহজেই মোকাবেলা করতে পেরেছি আমরা।”
ম্যাককালাম এর আগেও প্রকাশ্যে রাশিয়ান ও ইরানি উভয় হুমকির বিষয়ে কথা বলেছেন। তবে এর আগে আর কখনও তিনি মস্কোকে এতোটা কঠোর ভাষায় অভিযুক্ত করেননি।
তিনি বলেন, এমআই ফাইভ ইরানের যেসব ষড়যন্ত্র ভেস্তে দিয়েছে তার মধ্যে অন্তত ২০টি চক্রান্ত ব্রিটিশ নাগরিক এবং যুক্তরাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য সম্ভাব্য প্রাণঘাতী হুমকি ছিল।
ম্যাককালাম বলেন, ২০২২ সালে মাহসা আমিনির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আমরা অভূতপূর্ব গতি এবং মাত্রায় যুক্তরাজ্যে একের পর এক চক্রান্ত দেখেছি।
মাহসা আমিনি ইরানের নারীদের জন্য হিজাব পরার বাধ্যতামূলক নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পরে পুলিশি হেফাজতে মারা গিয়েছিলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে এক ভাষণে তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ইরানীদের বিরুদ্ধে ১০টি ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই সংখ্যাটি এখন দ্বিগুণ হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় ধরা পড়ার পরও ইরানের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কমেনি।
তিনি আরও জানান, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলতে থাকায় এমআই ফাইভ “যুক্তরাজ্যে ইরানের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বাড়া বা প্রসারিত হওয়ার ঝুঁকির প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেবে”।
ম্যাককালাম বলেন, রাশিয়া ও ইরানের স্বীকৃত কূটনীতিকদের জন্য এই ধরনের কাজ করা কঠিন বা প্রায় অসম্ভব। তাই তারা এসব কাজের জন্য ক্রমশ আন্ডারওয়ার্ল্ড অপরাধী চক্রের দিকে ঝুঁকছে।
চীনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিরাপত্তাকে জোরদার করতে সাহায্য করেছে।
তবে পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ডেটা এবং তথ্য চুরি করার একটি গোপন কর্মসূচি ছিল এবং “আমরা ২০ হাজার ব্যক্তির সঙ্গে চীনের অস্পষ্ট লেনদেন দেখেছি”।
‘অনলাইন সংস্কৃতির চতুর বোঝাপড়া’
ম্যাককালাম সতর্ক করেন, অনলাইন চরমপন্থায় আকৃষ্ট হওয়া তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে।
সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্তের মুখোমুখি হওয়াদের ১৩ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। সন্ত্রাসবাদে জড়িত হওয়া তরুণদের সংখ্যা গত তিন বছরে তিনগুণ বেড়েছে।
নিরাপত্তা সংস্থা “খুব অল্পবয়সী মানুষদের বিষাক্ত অনলাইন চরমপন্থায় আকৃষ্ট হওয়ার অনেক বেশি ঘটনা দেখছে”।
তিনি বলেন, “চরম ডানপন্থীরা মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে তরুণদেরকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ থেকে অনলাইন সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের একটি চতুর বোঝাপড়ার ইঙ্গিত মিলছে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি চরম পন্থার বিস্তারে ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় ভুমিকা নিয়ে তার উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, অল্পবয়সীরা তাদের বেডরুম থেকেই খুব সহজেই চরমপন্থী উপাদানের সংস্পর্শে চলে আসছে।
চরমপন্থীরা অনলাইনে একাকী বসেই সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,“ইন্টারনেটের অন্ধকার কোণে, কথা বলা সহজ। ঘরের কোণে আর্মচেয়ারে বসে চরমপন্থার প্রচারকারীদের থেকে প্রকৃত চক্রান্তকারীদের খুঁজে বের করা একটি কঠিন কাজ।”
“বেনামি অনলাইন সংযোগগুলোর বেশিরভাগই গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে কিছু কিছু মারাত্মক, বাস্তব ক্রিয়াকলাপের দিকে পরিচালিত করে।”
তিনি জানান, গত মাসে প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, গত জুন পর্যন্ত এক বছরে সন্ত্রাসী অপরাধের সন্দেহে ২৪২ জনকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৭ শতাংশ বা ৪০ জন ১৭ বছর বা তার কম বয়সী।