রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তনের পর চাপে থাকা এস আলম গ্রুপ তাদের ছয়টি কারখানা এক দিনের নোটিসে বন্ধ করে দিয়েছে।
মঙ্গলবার এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ ও প্রশাসনের প্রধান মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিনের সই করা এই সংক্রান্ত নোটিস তাদের কারখানাগুলোর সামনে টানিয়ে দেওয়া হয়।
সেখানে কারখানা বন্ধের কারণ ব্যাখ্যা না করে বলা হয়েছে ‘অনিবার্য কারণবশত’। গ্রুপটির কর্মকর্তাদের কেউ এনিয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ব্যাংক হিসাব জব্দ করাসহ সরকারের নানা পদক্ষেপে তাদের কারখানা চালানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কারখানা চালু রাখার জন্য কোনও কিছুই তো বাকি নেই। ব্যাংক থেকে শুরু করে কাঁচামাল আমদানি সবকিছুই তো ব্লক করে রাখা হয়েছে। পণ্য আমদানি কাঁচামাল না পেলে উৎপাদন চালু রাখার কোনও সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় নির্দেশেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
বন্ধ ছয়টি কারখানা হলো- এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড–নফ, এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড ও ইনফিনিটি সি আর স্ট্রিপস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায় গোষ্ঠীর বেশিরভাগ কারখানা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে মইজ্জারটেক এলাকায় অবস্থিত। শুধু এস আলম পাওয়ার জেনারেশন বাঁশখালীতে।
বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোতে অন্তত ১২ হাজার কর্মী কাজ করে। মঙ্গলবার সকালে কারখানায় এসে বন্ধের ঘোষণা দেখে কর্মীরা বিক্ষোভও করে।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে এস আলম গ্রুপ একেচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পেয়েছিল। সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয় তারা। বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারে এই গ্রুপটির নামই সবার আগে আসে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম গ্রুপও পড়ে বিপাকে। সাতটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারায় তারা।
এস আলম গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি হলেও কখনোই সেটি প্রকাশ পায়নি। ১ ডিসেম্বর তাদের কাছে পাওয়া ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ ফেরত পেতে মামলা করে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এই ধরনের মামলা এস আলমের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম।
সর্বশেষ ১৯ িডসেম্বর এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং পরিবারের ৯ সদস্যের ১২৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। দুদকের একটি মামলায় চট্টগ্রামের আদালত এই নির্দেশ দেয়। ফলে সবদিক থেকেই এস আলম গ্রুপ ব্যবসা-বাণিজ্যে আটকা পড়ে।
এর মধ্যেই গত ১৮ ডিসেম্বর নিজেদের বিনিয়োগ ধ্বংসের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ।
সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসাবে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে এই নোটিস পাঠান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টাদের। তাতে বলা হয়, সরকার ছয় মাসের মধ্যে সমাধান না দিলে তারা আন্তর্জাতিক সালিশি কার্যক্রম শুরু করবেন।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় এস আলমের আইনজীবীরা এই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়।
সেই নোটিস পাঠানোর খবর বাংলাদেশে প্রকাশের পরদিনই একসঙ্গে ছয়টি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিল এস আলম গ্রুপ।
এই শিল্প গোষ্ঠীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানা বন্ধ হবে এমনটা তারা আগেই আঁচ করতে পারছিলেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সিদ্ধান্ত হবে, তারা বুঝতে পারেননি।
৩৯ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের সর্বমোট ১৩ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধরলে তাদের সম্পদমূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
তাদের ডজন দুয়েক কোম্পানিতে কর্মীর সংখ্যা ২ লাখের মতো।