গ্রেপ্তার হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেলেন আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটের দিকে তিনি মুক্তি পান।
এর আগে বিএনপিকর্মী মকবুলকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলাসহ ছয় মামলায়ই তাকে জামিন দেয় ঢাকার আদালত। এর মধ্যে ছিল পল্টন থানার দুটি মামলা ও খিলগাঁও থানার চারটি মামলা।
তখন সাবের হোসেন চৌধুরীর আইনজীবী জানান, তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা আছে। সব মামলায়ই জামিন হওয়ায় তার কারামুক্তিতে আর বাধা নেই।
পল্টন থানায় করা মকবুল হত্যা মামলায় সাবের হোসেনকে সোমবার (৭ অক্টোবর) পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেয় আদালত। এর আগের দিন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রিমান্ড চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়ায় মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাচান।
আদালতে সাবের হোসেন চৌধুরীর আইনজীবী শাহীন তার জামিন আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরোধিতা করে। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে পৃথক ছয় মামলায় তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।
পল্টন থানার দুই মামলায় পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমান।
খিলগাঁও থানার চার মামলায় পাঁচ হাজার টাকার মুচলেকায় তাকে জামিন দিয়েছেন ঢাকার আরেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান।
সাবের হোসেন চৌধুরীর পক্ষে তার আইনজীবী মোর্শেদ আলম শাহীন জামিন চেয়ে শুনানি করেন।
শুনানিতে তিনি বলেন, “মানুষের জীবন আগে। বেঁচে থাকলে তারপর রিমান্ড। আসামি অসুস্থ, ঘাড়ে ব্যথা, ডায়বেটিসের রোগী, হার্টে তিনটা রিং পরানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আসামি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করেন।
“আসামি পরিস্কার রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। মানুষ হিসেবে সবার জন্য সুখে দুঃখে পাশে রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন করেছেন। আসামির মানবিক দিক বিবেচনা করে তার জামিনের প্রার্থণা করছি।”
এরপর বিএনপিপন্থী আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে শুনানিতে বলেন, “এই আসামি অসুস্থ। অথচ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“আসামি জামিনে মুক্তি পেলে ফ্যাসিবাদী সরকারের সাথে হাত মিলাবে। দেশের শান্তি নষ্ট করবে। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভবনাও রয়েছে। তাই আসামির জামিনের বিরোধিতা করছি।”
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিন আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে আদালত থেকে বের হয়ে যান। একই সময়ে তড়িঘড়ি করে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক।
মুহূর্তেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে এজলাসে। কয়েকজন বিএনপিপন্থী আইনজীবী এজলাসে রাখা টেবিল ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। এরপর তারা এজলাস ত্যাগ করে চলে যান।
অস্থিরতা কাটার পর পল্টন থানার দুই মামলায় জামিন শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদেশ অপেক্ষমাণ রাখা হয়। এরপর এই দুই মামলায়ও তার জামিন মঞ্জুর হয়।
তখন সাবের হোসেন চৌধুরীর আইনজীবী শাহীন বলেন, সব কয়টি মামলায় জামিন হওয়ায় সাবের হোসেন চৌধুরীর কারামুক্তিতে আর কোনও বাধা নেই।
মঙ্গলবার শুনানি শেষে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “সাবের হোসেন চৌধুরী সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে মুক্তি পাবেন। তাকে কারাগারে যেতে হবে না।”
বিএনপিকর্মী মকবুল হত্যা মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন মডেল থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হাচান গত ৭ অক্টোবর আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হকের আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ড ফেরত আবেদনে উল্লেখ করেন, গত ৭ অক্টোবর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে, ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত এজাহারনামীয় আসামিদের বর্তমান অবস্থান শনাক্তসহ গ্রেপ্তার ও অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের সনাক্তকরণসহ গ্রেপ্তারের নিমিত্তে ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত আসামির ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আদেশ মঞ্জুর হওয়ার পরে বিধি মোতাবেক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছেন না। কথোপকথনে জানা যায়, তিনি ‘পূর্ব থেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ ও হৃদরোগে আক্রান্ত। তার হার্টে ৩টি রিং পরানো হয়েছে। আসামির বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতিতে পুলিশ হেফাজতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আশানুরূপ তথ্য পাওয়া যাবে না।
আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ৫ দিনের পুলিশি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ না করে আপনার বরাবর প্রেরণ করা হলো। ভবিষ্যতে আসামির সুস্থ্যতা সাপেক্ষে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হবে বলে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
গত ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার সদস্যরা।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর একদফা দাবি আদায়ের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এর আগে ৭ ডিসেম্বর ডিবি পুলিশের হারুন অর রশীদ, মেহেদী হাসান ও বিপ্লব কুমার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে অভিযান চালায়। কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়। এর পাশে অবস্থানরত হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালায়। এতে মকবুল হোসেন নামে এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
সদ্য বিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের এই সদস্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সংসদ বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি। ফলে অন্য সবার মতো পদ হারান সাবের হোসেন চৌধুরীও।
১৯৬১ সালে ফেনীতে জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিবিদ ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকার স্টাডিজ থেকে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন সাবের হোসেন চৌধুরী। এছাড়া তিনি ওয়েস্টমিনস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন।
সাবের হোসেন চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালেই ২০০০ সালের জুনে বাংলাদেশ আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ পায়, মেলে টেস্ট স্ট্যাটাসও।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন সাবের হোসেন চৌধুরী। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক-১ হিসেবে ঢাকা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিবও।
১৯৯৯ সালে তিনি প্রথম নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হন। পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন।