মূল্যস্ফীতির ঘোড়া ছুটছিল আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিক থেকে, তাতে লাগাম এখনও পরাতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। কেন এখনও বেশি? তার জবাবে তথ্য না লুকানোকে কারণ দেখালেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেছেন, “মূল্যস্ফীতি আগে ৮ বা ৯ শতাংশে আটকে রাখা হলেও এখন কোনও কারচুপি নাই। বিবিএসকে বলা হয়েছে, তথ্য যা আছে, তাই প্রকাশ যেন হয়। এখানে কারচুপির কোনও ব্যাপার নেই। সে কারণে মূল্যস্ফীতি বেশি দেখাচ্ছে।”
শনিবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ব্যাংকিং অ্যালমানাক’র ষষ্ঠ সংস্করণের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত নভেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে আরও বেশি, ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে উঠেছে।
আগের মাস অক্টোবরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো, গত বছরের নভেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের নভেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা পেতে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছিল বাংলাদেশ। ওই মাসই ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরের মাসের শুরুতেই পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। তারপর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আওয়ামী লীগ আমলে কেবল মূল্যস্ফীতিই নয়, পরিসংখ্যান ব্যুরোর নানা তথ্য-উপাত্তে কারচুপি হত বলে অভিযোগ ছিল। এজন্য অর্থনীতিবিদরাও সমালোচনামুখর ছিলেন।
শনিবারের অনুষ্ঠানে সালেহউদ্দিন বিগত ১৫ বছরের তথ্য বিভ্রাট নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “টের পাচ্ছি, কীসের মধ্য দিয়ে গেছে গত ১৫ বছর। মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আয়, জিডিপির হিসাব ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তথ্য বিভ্রাটের পেছনে কিছু আছে ভুল হিসাবায়ন, কিছু আছে রাজনীতিবিদদের নেতিবাচক ভূমিকা; প্রকৃত তথ্য লুকানোর চেষ্টা।”
তবে অন্তর্বর্তী সরকার তা করছে না দাবি করে উপদেষ্টা বলেন, “আমরা কোনও পাওয়ার দেখাতে আসিনি, একটা দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।
“বিগত ১৫ বছরের তথ্য নিয়ে নানা বিভ্রাট রয়েছে। তথ্য লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা এগুলো পরিবর্তন ও সংস্কারের চেষ্টা করছি। কারণ দাতা সংস্থাগুলো আমাদের কাছে নানা প্রশ্ন করে, তারা বোঝাতে চান আগেই কম ছিল ইত্যাদি। এ নিয়ে আমরা তাদের বোঝাচ্ছি আগের তথ্য লুকানো ছিল, আমরা সঠিকটা উপস্থাপন করছি।”
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার ও বইয়ের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বক্তব্য রাখেন।
পুঁজিবাজারে ‘প্লেয়ার ও রেগুলেটরের অনেক দোষ’
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মতো পুঁজিবাজারের অবস্থাও একই রকম থাকার বিষয়টি তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন বলেন, “পুঁজিবাজারের শেয়ার প্রাইস কমে যাচ্ছে বলেই চেয়ারম্যানকে রিমুভ কর বলে মিছিল হচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে অনড় থাকতে বলছি।
“আপনারা জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনছেন, যার কোন অস্তিত্ব নেই। অথচ এ শেয়ার মহা আনন্দে কিনছেন। ন্যূনতম কোনও মূল্য নেই, এগুলো কয়েক দিন পরই ওয়েস্ট পেপার হিসেবে ব্যবহার হবে।”
বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার অভাবের দিকটি দেখানোর পর সালেহউদ্দিন বলেন, “আমি বিনিয়োগকারীদের দায়ী করছি না। পুঁজিবাজারের প্লেয়ার ও রেগুলেটরের অনেক দোষ আছে। আমি মনে করি এটা প্রচার করা দরকার।”
ব্যাংকিং অ্যালমানাকের চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “অর্থনীতিতে এখন পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ চলছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও সন্তোষজনক পর্যায়ে। যথাযথ পদক্ষেপ নিলে অন্য তিনটির ক্ষেত্রেও ২০২৫ সালের মধ্যে ইতিবাচক কিছু দেখা যাবে।”
এই দুটির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ও বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যবসায়িক শ্রেণির (অলিগার্ক) প্রভাব কমানো—এই পাঁচটিকে অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
‘এখন অর্থনীতির চাকা ঘোরানো বা বেগবান করা দরকার’ মন্তব্য করে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর বলেন, “অবশ্য এ কাজ শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের নয়, অন্যদেরও সমান দায়িত্ব আছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ অনেক কিছু করার আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায় (এসএমই) থেকে তৃণমূল পর্যায়ে কীভাবে আস্থার জায়গা তৈরি করা যায় এবং মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে পরিবারগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।”