অনেক আগেই হওয়া দরকার ছিল। অবশেষে সেটা হচ্ছে, ঢাকা শহরের সরকারি সাতটি কলেজের উচ্চতর শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তাতেই কি সমস্যার সমাধান হবে আদৌ?
আসলে হবে না। বরং নতুন করে তৈরি হবে আরও নতুন নতুন জটিলতা। কারণ আর কিছু না; দরকারি এই সিদ্ধান্তটা যে প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়াটি মোটেই সঠিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত বিধি অনুসারে কোনও একটা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে কি না, বা অধিভুক্ত থাকবে কি না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটেরই কেবল এখতিয়ার আছে এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটা ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে জানিয়েছে, সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে উপাচার্যের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাত বছর আগে ঠিক এ রকমই একটা ভুল সিদ্ধান্ত থেকে শুরু হয়েছিল এই সংকট। সেদিন, তখনকার সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এই সাত কলেজকে অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত একইভাবে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদনের আগেই মেনে নিয়েছিলেন তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
তারপর, কোনও রকম প্রস্তুতি ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কাঁধে নিতে হয়েছিল সাতটি কলেজের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর ভার। সঙ্গে ছিল, এই সাতটি কলেজ তখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল সেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিশ্বাস্য রকম অসহযোগিতা— এমনকি নিজেদের সিলেবাসে ভর্তি হওয়া, চার বছর পার করে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা অর্ধেক দিয়ে ফেলা শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্ব নেয়নি তারা, ওদেরকেও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁধে। ফলে, খুব স্বাভাবিক কারণেই ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল সাত কলেজের নিরপরাধ এই শিক্ষার্থীদের।
সিলেবাস তৈরি করেছে এক বিশ্ববিদ্যালয়, সেটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের। অর্ধেক পরীক্ষা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, বাকি অর্ধেক অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের— এ রকম একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা থেকে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকার সাত কলেজের যাত্রা। অন্যদিকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া দায়িত্ব নিয়ে তাদের জন্য সময় দিতে গিয়ে হিম-শিম খাচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও; তাই খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে ছিল অসন্তোষ।
দুই পক্ষই গররাজি, এ যেন অভিভাবকের সম্মতিতে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিয়ের মতো। অনিচ্ছুক এই দাম্পত্যের অবসান হওয়াই তো উচিৎ, কিন্তু অবসানের প্রক্রিয়াটিও যে হয়ে গেল চাপিয়ে দেওয়া!
এখন এই দেড় লাখ শিক্ষার্থীর কী হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য বলেছে তারা বর্তমান শিক্ষার্থীদের দায়িত্বটা নেবে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীরা কি আদৌ তা চায়? এই প্রশ্নের চেয়ে বড় প্রশ্ন এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে, চলমান শিক্ষাবর্ষে যে শিক্ষার্থীদের এই সব কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, তাদের ব্যাপারটা কী হবে?
সাত কলেজে চলমান শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল সে অনুযায়ী বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখার বিভিন্ন বিভাগে মোট ২৩ হাজার ৫৩৮টি আসনে ভর্তির জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি ইউনিটের অধীনে সাতটি ইনজিনিয়ারিং কলেজ ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অধীনে ৬টি কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়াও। গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া আবেদনের প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার কথা আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি। হঠাৎ করে গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অনুসারে এই ভর্তি প্রক্রিয়াও বাতিল করা হয়েছে।
তাহলে ভর্তিচ্ছু এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত কী হবে? এই শিক্ষাবর্ষে কি তাহলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করাবে না কলেজগুলো? উপাচার্য ও অধ্যক্ষদের বৈঠকে ‘চূড়ান্ত’ সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই ভর্তি প্রক্রিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে হবে না। তাহলে কিভাবে হবে?
একটা বিকল্প হতে পারে সারা বাংলাদেশের অন্যান্য কলেজের মতো এই কলেজগুলোকেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেরত পাঠানো। সেখানেও সমস্যা, শিক্ষার্থীরা চান না, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, নীতিমালা চূড়ান্ত করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি এই সাত কলেজকে নিয়ে আলাদা একটি বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তো মুখের কথা নয়!
বাংলাদেশের আইন অনুসারে নতুন একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার হয় জাতীয় সংসদের মাধ্যমে নতুন একটি আইন প্রণয়নের, এ মুহূর্তে সেই সুযোগ নেই। অবশ্য আজকাল তো আর আইন-কানুনের তোয়াক্কা করাই হচ্ছে না কোনও ক্ষেত্রেই, তো ধরে নিলাম জাতীয় সংসদের অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে সে জন্য তো ন্যূনতম একটা সময় লাগবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ আমলে যখন উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন এ জন্য গঠিত ‘নাথান কমিশন’ ও পরবর্তীকালে ‘স্যাডলার কমিশন’ প্রায় সাত বছর কাজ করে তৈরি করেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য এ রীতি অনুসরণ করা হয়নি; বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের খসড়াই তৈরি করা হয়েছে কপি-কাট-পেস্ট করে, শিক্ষা দর্শন বিষয়ে অনভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে। তবে সেই কপি-কাট-পেস্ট পদ্ধতিতে আইন তৈরি করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতেও সময়ের প্রয়োজন। আইন হবে, সেই আইন অনুসারে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে, লোকবল নিয়োগ হবে, সিলেবাস তৈরি করা হবে তারপর না শিক্ষার্থী ভর্তি!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাত কলেজের সমস্যাটা কিন্তু শুধু এই বাস্তবের কারণেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে আছে ‘ইগোর লড়াই’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের ইগো, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ইগো। নইলে, তারা যে সব দাবি করে, তার মধ্যে অনেকগুলোতেই অসঙ্গতি আছে। হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই সাতটি কলেজের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে সেবা দেওয়া একটু কঠিন, কিন্তু অসম্ভব ছিল না।
এই সাতটি কলেজ ছাড়াও কিন্তু আরও প্রায় দুইশত প্রতিষ্ঠান আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। সাতটি ইনজিনিয়ারিং কলেজ আর ছয়টি গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজের কথা তো একটু আগেই উল্লেখ করা হলো। এছাড়াও আছে একশ’র কাছাকাছি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ আর প্রায় সমান সংখ্যক নার্সিং ইনস্টিটিউট। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে তো এমন আলোচনা হয় না। এতগুলো প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাকমতো চললে মাত্র সাতটা কলেজ কেন চলতে পারবে না?
শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াগুলোতে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে সমস্যাটা কোথায়। যে ‘পাঁচ দফা’ দাবিতে তারা এবারের আন্দোলন শুরু করেছে, সেটার অন্যতম হলো কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ। কিন্তু এই দাবি বাস্তবায়নের উপায় তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই, এটা করতে হবে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। অন্য একটি দাবিতে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘‘তাদের পড়ান এক শিক্ষক, প্রশ্ন করেন অন্য জন, খাতা দেখেন অন্য জন সে কারণে সমন্বয়ের অভাব’’। পৃথিবীজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় আর অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষা পদ্ধতিটাই এ রকম।
সবগুলো কলেজকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করে দিলে হয়ত এ সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। কিন্তু এ সমস্যার আসল সমাধান হলো, শিক্ষার মানে উন্নয়ন। কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়, নাম যা-ই হোক আসলে তো উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সেটাই। যদি প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ থাকে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকে শেখার সংস্কৃতি, তাহলে তো কে প্রশ্ন করছে আর কে মূল্যায়ন করছে সেটা কোনও ব্যাপার হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখানে সেটাই শুধু ব্যাপার নয়, কেন অনেক ছাত্র পাস করতে পারছে না, তুলনামূলক কম নাম্বার পাচ্ছে বিস্ময়করভাবে সেটাও প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এই সাত বছরে যে কয়েকবার মৌখিক পরীক্ষার জন্য কোনও কলেজে যাওয়ার দুর্ভাগ্য হয়েছে, শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের বহর আমাকে বিস্মিত করেছে। কেন এমন হয়, তার উত্তর প্রায় সব সময়ই এক— তারা তো ক্লাসই করে না!
সাত কলেজের আসল সংকট এই শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা, যেন-তেনভাবে সার্টিফিকেট পাওয়া নয়, তাদেরকে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী করে তোলা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফিরিয়ে আনার পরও এই দিকে নজর দেওয়া হয়নি, ভবিষ্যতেও যদি এই বিষয়টি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এই সংকট কোনোদিনই শেষ হবে না।
কলেজ হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়, জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যটাই যদি অর্জন না হয়, তাহলে আর এই পরিবর্তনের অর্থ কী!
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: khademulhaque@du.ac.bd